এই লেখাটি ছোটদের জন্য

বড়রা এই লেখাটি পড়তে পারবে না তা নয়। কিন্তু আমার ধারণা বড় মানুষেরা-যাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুল কলেজে পড়ে তারা এই লেখাটি পড়ে একটু বিরক্ত হতে পারেন! কীভাবে কীভাবে জানি আমাদের দেশের লেখা পড়াটা হয়ে গেছে পরীক্ষা নির্ভর। এই দেশে এখন লেখাপড়ার সাথে শেখার কোনো সম্পর্ক নেই, পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ায় বিশাল একটা সম্পর্ক। বাচ্চারা স্কুল কলেজে কিছু শিখলো কী না সেটা নিয়ে বাবা মায়ের কোনো মাথাব্যথা নেই, পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেলো কী না কিংবা জিপিএ ফাইভ পেলো কী না সেটা নিয়ে তাদের ঘুম নেই। পরীক্ষায় বেশী নম্বর পাওয়াটা এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে সে জন্যে মা বাবারা রাত জেগে প্রশ্ন ফাঁস হল কিনা সেটি ফেসবুকে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন কোথাও যদি পেয়ে যান তাহলে তার সমাধান করিয়ে ছেলেমেয়েদের পিছনে লেগে থাকেন সেটা সুস্থ করানোর জন্যে। পরীক্ষার হলে গিয়ে পরীক্ষার ঠিক আগে আগে বের হওয়া এমসি কিউ প্রশ্নগুলো নিজেদের স্মার্টফোনে নিয়ে এসে সেগুলো তাদের ছেলে মেয়েদের শেখাতে থাকেন। এখানেই শেষ হয় না এতো কিছুর পরেও যদি পরীক্ষার ফলাফল ভালো না হয় তাদের এমন ভাষায় গালাগাল আর অপমান করেন যে বাচ্চাগুলো গলায় দড়ি দেয়ার কথা চিন্তা করে। আমাদের দেশে কীভাবে কীভাবে জানি এরকম একটা ‘অভিভাবক প্রজন্ম’ তৈরি হয়েছে যারা সম্ভবত এই দেশের লেখাপড়ার জন্যে সবচেয়ে বড় একটা বাধা। কাজেই যদি এরকম কোনো একজন অভিভাবক এই লেখাটি পড়া শুরু করেছেন তাহলে তাকে অনুরোধ তিনি যেন শুধু শুধু আমার এই লেখাটি পড়ে সকাল বেলাতেই তার মেজাজটুকু খারাপ না করেন। তবে পড়া বন্ধ করার আগে সিংগাপুরের একটা স্কুলের প্রিন্সিপালের অভিভাবকদের কাছে লেখা একটা চিঠি পড়ার জন্যে অনুরোধ করছি। চিঠিটা বাংলায় অনুবাদ করলে হবে এরকম :

প্রিয় অভিভাবকেরা

আপনাদের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা কয়েকদিনের মাঝেই শুরু হবে। আমি জানি আপনাদের ছেলেমেয়েরা যেন পরীক্ষায় ভালো করে সে জন্যে আপনারা নিশ্চয়ই খুব আশা করে আছেন।

কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখবেন, ছাত্রদের ভেতরে যারা পরীক্ষা দিতে বসবে তাদের মাঝে নিশ্চয়ই একজন শিল্পী আছে যার গণিত শেখার কোনো দরকার নেই।

একজন নিশ্চইয় ভবিষ্যৎ উদ্যোক্তা আছে যার ইতিহাস কিংবা ইংরেজী সাহিত্যের প্রয়োজন নেই।

একজন সঙ্গীত শিল্পী আছে যে রসায়নে কতো নম্বর পেয়েছে তাতে কিছু আসে যায় না।

একজন খেলোয়াড় আছে তার শারীরিক দক্ষতা পদার্থ বিজ্ঞান থেকে বেশী জরুরী, উদাহরণ দেয়ার জন্যে স্কুলিং এর কথা বলতে পারি।

যদি আপনার ছেলে বা মেয়ে পরীক্ষায় খুব ভালো নম্বর পায় সেটা হবে খুবই চমৎকার। কিন্তু যদি না পায় তাহলে প্লিজ তাদের নিজেদের ওপর বিশ্বাস কিংবা সম্মানটুকু কেড়ে নেবেন না।

তাদেরকে বলবেন, এটা নিয়ে যেন মাথা না ঘামায়, এটা তো একটা পরীক্ষা ছাড়া আর কিছু না। তাদেরকে জীবনে আরো অনেক বড় কিছুর জন্যে প্রস্তুত করা হচ্ছে।

তাদেরকে বলেন, পরীক্ষায় তারা যত নম্বরই পাক, আপনি

সব সময় তাদের ভালোবাসেন, এবং কখনোই পরীক্ষায় নম্বর দিয়ে তাদের বিচার করবেন না। প্লিজ, এই কাজটা করেন, যখন এটা করবেন দেখবেন আপনার সন্তান একদিন পৃথিবীটাকে জয় করবে। একটা পরীক্ষা কিংবা একটা পরীক্ষায় কম নম্বর কখনোই তাদের স্বপ্ন কিংবা মেধাকে কেড়ে নিতে পারবে না।

আরেকটা কথা, প্লিজ, মনে রাখবেন শুধু ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়াররাই এই পৃথিবীর একমাত্র সুখী মানুষ নয়।

অনেক শুভেচ্ছার সাথে প্রিন্সিপাল

(চিঠিটাতে স্কুলিং নামে একটা ছেলের কথা বলা হয়েছে, এই বাচ্চা ছেলেটি অলিম্পিকে সাঁতারে সোনার মেডেল পেয়েছিল!)

সিংগাপুরের স্কুলের এই প্রিন্সিপালের চিঠিটা আসলে শুধু তার দেশের ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের জন্যে নয়, আমাদের দেশের অভিভাবকদের জন্যেও সত্যি। আমরা ভুলে যাই কিংবা হয়তো জানিই না যে একজন শিশুর অনেক রকম বুদ্ধিমত্তা থাকতে পারে এবং তার মাঝে আমরা শুধু লেখাপড়ার বুদ্ধিমত্তাটাই যাচাই করি। এই লেখাপড়ার বুদ্ধিমত্তা ছাড়াও তার অন্য বুদ্ধিমত্তা দিয়েও যে একটা ছেলে বা মেয়ে অনেক বড় হতে পারে সেটা আমাদের বুঝতে হবে। আমি অনেকদিন থেকে ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে আসছি, যতই দিন যাচ্ছে ততই আমার কাছে স্পষ্ট হচ্ছে পরীক্ষার ফলের সাথে একজনের জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার দেখা যে ছেলেটি বা মেয়েটি এই সমাজ দেশ কিংবা পৃথিবীকে সবচেয়ে বেশি দিয়েছে সে পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে তা কিন্তু সত্যি নয়।

০২
আইনস্টাইন অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন, তার কথাগুলোর মাঝে যে কথাটা আমার সবচেয়ে প্রিয় সেটি হচ্ছে: ‘কল্পনা করার শক্তি জ্ঞান থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ!’ আইনস্টাইন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ছিলেন, জ্ঞানের গুরুত্বটুকু যদি কেউ বুঝতে পারে সেটি বোঝার কথা তার মতো একজন বিজ্ঞানীর। কিন্তু এই মানুষটিই কিন্তু জ্ঞান থেকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন কল্পনা শক্তিকে। কারণটা কী?

সেটি বোঝার জন্য আমাদের রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হবে না, একটু খানি চিন্তা করলেই বোঝা যায়। আমরা যেটাকে জ্ঞান বলি সেটা আমরা চেষ্টা চরিত্র করে পেয়ে যেতে পারি। যদি আমরা কিছু একটা না জানি, খুঁজে পেতে তার কিছু বই এলে সেগুলো ঘাটাঘাটি করে, জার্নাল পেপার পড়ে, অন্যদের সাথে কথা বলে আমরা সেগুলো জেনে যেতে পারি। সোজা কথায় জ্ঞান অর্জন  করতে পারে, সেটা অর্জন করতে চাই কীনা কিংবা তার জন্যে পরিশ্রম করতে রাজী আছি কীনা সেটা হচ্ছে একমাত্র প্রশ্ন।

কিন্তু যদি আমাদের কল্পনাশক্তি না থাকে তাহলে কী আমরা চেষ্টা চরিত্র করে, খাটাখাঁটুনি করে সেই কল্পনাশক্তি অর্জন করতে পারব?

পারব না। শত মাথা কুটলেও আমরা কল্পনাশক্তি বাড়াতে পারব না। এটা নিয়ে আতংকিত হবার কিছু নেই। কারণ, যখন একটা শিশু জন্ম নেই তার ভেতরে অন্য সব কিছুর সাথে প্রচুর পরিমান কল্পনাশক্তি থাকে। আমাদের কাজ খুব সহজ, সেই কল্পনাশক্তিটুকুকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আর কিছু নয়।

আমরা মোটেও সেটা করি না। শুধু যে করি না তা নয় সেটাকে যত্ন করে নষ্ট করি। আমি লিখে দিতে পারি এই দেশের অনেক অভিভাবক মনে করেন যে ভালো লেখাপড়া মানে হচ্ছে ভালো মুখস্ত করা। সবাই নিশ্চয়ই এটা লক্ষ্য করেছে যে অনেক ছেলেমেয়েকে বই নিয়ে পড়তে বসার কথা বললে তারা চোখ বন্ধ করে মুখস্ত করা শুরু করে। আমি নিজের চোখে পত্রিকায় একটা স্কুলের বিজ্ঞাপন দেখেছি যেখানে বড় বড় করে লেখা আছে, ‘এখানে মুখস্ত করানোর সুবন্দোবস্ত আছে!’ আমার মনে হয় আমি যদি দেখতাম সেখানে লেখা আছে ‘এখানে মাস্তানী শেখার সুবন্দোবস্ত আছে’ তাহলেও আমি কম আতংকিত হতাম।

যে কেই ইচ্ছে করলে আমার কথাটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। যে বাচ্চা স্কুলে যেতে শুরু করেনি, যাকে এখনো লেখাপড়া শুরু করানো হয়নি তাকে যে কোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলে নিজের মতো করে উত্তর দিয়ে দেবে।

একটু চেষ্টা করলেই তার ভেতর থেকে কাল্পনিক বিষয় বের করে নিয়ে আসা যাবে, ছোট একটা কাপড়ের পুতুলকে ‘বউ’ হিসেবে কল্পনা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেবে। এক টুকরো লাঠিকে একটা ‘গাড়ি’ হিসেবে কল্পনা করে ছোট্ট শিশু সারা বাড়ি ছুটে বেড়াবে। কিন্তু সেই শিশুটি যখন ভালো স্কুলে লেখাপড়া করবে, অভিভাবকরা উপদেশ দিবে প্রাইভেট টিউটর তাকে জটিল বিষয় শিখিয়ে দেবে, কোচিং সেন্টার মডেল পরীক্ষার পর মডেল পরীক্ষা নিয়ে তাকে প্রস্তুত করে দেবে, তখন আমরা আবিস্কার করব সে যে জিনিষগুলো  শিখেছে তার বাইরে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। বানিয়ে কিছু লিখতে পারে না, কল্পনা করতে পারে না। একটা আস্ত মানুষকে আমরা পুরোপুরি রোবোট বানিয়ে ফেলি।

একজন শিশুর কল্পনাশক্তিকে বাঁচিয়ে রাখা অনেকটা তার মস্তিষ্ককে অক্ষত রাখার মতো। শিশুটি অনেক কিছু শিখেছে কিন্তু তার মস্তিষ্কের সর্বনাশ করে ফেলেছে তার কাছে আমরা খুব বেশী কিছু চাইতে পারব না। তার তুলনায় সজীব আছে, সৃষ্টিশীল আছে তার কাছে আমরা অনেক কিছু আশা করতে পারি।

মনে আছে একবার কোনো এক জায়গায় বেড়াতে এসেছি এবং একটা শিশু আমাকে দেখে ছুটে এসে আমার সাথে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছে। আমি এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে আবিস্কার করলাম এইটুকুন একটা শিশু কিন্তু সে কত কিছু জানে এবং আরো জানার জন্যে আমার কাছে তার কতো রকম প্রশ্ন, আমি উত্তর দিয়ে শেষ করতে পারি না। কিছুক্ষণ পর তার মায়ের সাথে দেখা হলো। মা মুখ ভার করে আমার কাছে অভিযোগ করে বললেন, ‘আমার এই ছেলেটা মোটেই লেখাপড়া করতে চায় না, দিনরাত গল্পের বই পড়ে। প্লিজ, তাকে একটু উপদেশ দিয়ে দেবেন যেন সে একটু খানি লেখাপড়া করে?

আমি তার মাকে বললাম, ক্লাশ এইটে ওঠার আগে কোনো লেখাপড়া নেই। সে এখন যা করছে তাকে সেটাই করতে দিন, কারণ সে একেবারে ঠিক জিনিসটা করছে।

তারপর ছেলেটিকে ফিস ফিস করে বললাম, তুমি তোমার স্কুলে গিয়ে তোমার সব বন্ধু বান্ধবকে আমার কথা বলবে, যে আমি বলেছি ক্লাশ এইটের আগে কোনো লেখাপড়া নেই। এখন যা মন চায় তাই করো, গল্পের বই পড়, ছবি আঁকো, ক্রিকেট খেলো।

আমার কথা শুনে মা বেচারীর হার্টফেল করার অবস্থা। আমি জানি এই ছোট ছেলেটিকেও এক সময় স্কুল, শিক্ষক, অভিভাবক, প্রাইভেট টিউটর আর কোচিং সেন্টার মিলে সাইজ করে ফেলবে। তারপরেও আমি আশা করে থাকি, এই ছোট বাচ্চাগুলো হয়তো তাদের অসম্ভব প্রাণশক্তি, স্বপ্ন আর কল্পনার শক্তিতে টিকে থাকবে। তাদের কেউ কেউ হয়তো রোবোট নয়, সত্যিকার মানুষ হয়ে বড় হবে।

মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রাখা বা কল্পনা না করার ক্ষমতাকে ধরে রাখার একটা খুব সহজ উপায় আছে সেটা হচ্ছে বই পড়া। সারা পৃথিবীই এখন খুব দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, ইন্টারনেট ফেসবুক এই সব প্রযুক্তির কারণে আমাদের শিশুরা বই পড়ার জগৎ থেকে সরে আসতে শুরু করেছে। আগে পৃথিবীর সব শিশুরা মাথা গুঁজে বই পড়তো, তাদের চোখের সামনে থাকতো ছোট একটি বই কিন্তু তাদের মাথার ভেতরে উন্মুক্ত হতো কল্পনায় বিশাল একটা জগৎ। এখন এই শিশুদের চোখের সামনে থাকে কম্পিউটার কিংবা ট্যাবের স্ক্রিন, সেখানে তারা দেখে চকচকে ছবি, কিংবা ভিডিও কিংবা চোখ ধাঁধানো গ্রাফিক্সের কম্পিউটার গেম। তাদের মাথার ভেতরেও থাকে সেই একই ছবি একই ভিডিও কিংবা একই গ্রাফিক্স, কল্পনার বিশাল একটা জগৎ আর উন্মুক্ত হয় না। কী দুঃখের একটা ব্যাপার।

আমি জানি আজ হোক কাল হোক পৃথিবীর সব বড়বড় জ্ঞানী গুণী মানুষেরা বলবেন ছোট ছোট শিশুদের ইন্টারনেট কম্পিউটার গেম আর ফেবসুকের জগতে পুরোপুরি ছেড়ে দেয়ার কাজটা একেবারে ঠিক হয়নি। তাদেরকে আরো অনেক বেশি বই পড়তে দেয়া উচিত ছিল।

বই মেলা আসছে। আমি সব অভিভাবকদের বলব, শিশুর হাত ধরে তাকে বই মেলায় নিয়ে আসুন। তাকে কয়েকটা বই কিনে দিন। একটা ছোট শিশুকে যদি একটিবার বই পড়ার অভ্যাস করিয়ে দিতে পারেন। তাহলে আপনি সারা জীবনের জন্যে নিশ্চিন্ত হয়ে যাবেন।

ছেলেমেয়ে মানুষ করার এতো সহজ উপায় থাকতে আমরা কেন তাদের ভবিষ্যত নিয়ে দুর্ভাবনা করি?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : কথাসাহিত্যিক; অধ্যাপক, শাবিপ্রবি।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.