তারাবীহ নামাজের গুরুত্ব ও ফযীলত
ওয়ান নিউজ ডেক্সঃ আরবী মাস সমূহের মধ্যে রমজান ইবাদতের বসন্তকাল। নবী করীম সা. এ প্রসঙ্গে ঘোষণা করেছেন, হে লোক সকল! নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে এক মহান মাস (রমজান) সমাগত। এ মাসে এমন একটি রাত রয়েছে, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। আল্লাহপাক এ মাসের রোজাকে ফরয করেছেন, আর কিয়ামুল লাইল তথা তারাবীহ নামাযকে করেছেন সুন্নাত। যে ব্যক্তি রমজান মাসে একটি নফল আমল করলো, সে যেন অন্য মাসের একটি ফরজ আমল করলো। আর যে এ মাসে একটি ফরজ আমল করলো, সে যেন অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আমল করলো। (ইবনে খুজাইমা: ১৮৮৭) রমজানুল মুবারকের আদায়কৃত সুন্নাত ইবাদতসমূহের মধ্যে সালাতুত তারাবীহ শ্রেষ্ঠ একটি ইবাদত।
আরবী তারাবীহ শব্দটি একবচন এর বহুবচন হলো তারবীহাতুন। যার অর্থ ক্ষণিক বিশ্রাম গ্রহণ করা বা আরাম করা। রমজান মাসে এশার নামাজের পর যে বিশ রাকআত সুন্নাত নামাজ আদায় করা হয়, তাকে তারাবীহ বলে। যেহেতু নামাজী প্রতি দুই সালাম (অর্থাৎ চার রাকআত) পর পর বিশ্রাম গ্রহণ করে থাকেন, সেজন্য এরকম নামকরণ করা হয়েছে। (আল কামূসুল ফিকহী: ১/১৫৫)
দিনের বেলা সিয়াম আর রাতে ক্বিয়াম রমজানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সিয়াম যেমন জীবনের সকল পাপ মোচন করে, ক্বিয়াম তথা তারাবীহও তেমনি। রাসূল সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সাওয়াবের আশায় রমজান মাসে রাত্রি জাগরণ করে তারাবীহ নামায আদায় করবে, তার বিগত জীবনের সমস্ত গুনাহ্ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারী: ৩৭)
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা রমজানের রোজাকে তোমাদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন। আর আমি (রাসূল) তোমাদের জন্য এ মাসের তারাবীহ নামাযকে সুন্নাত করে দিলাম। যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখবে এবং তারাবীহর নামাযজ আদায় করবে, সে গুনাহ থেকে সে দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে যে দিন মা তাকে জন্ম দান করেছিলেন।’ (নাসায়ী: ২২২২) তারাবীহ রমজানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। রমজানের রোজার পরিপূর্ণ বরকত ও ফায়েজ প্রাপ্তিতে তা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সারাদিন কষ্ট করে রোজা রেখে ইফতারের পর যখন শরীর ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে যায়, আল্লাহর বান্দা মনীবের খুশীর নিমিত্তে আবার তারবীহ নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। এটা আল্লাহ পাকের কাছে অত্যন্ত প্রিয় আমল।
সিয়াম ফরজ হওয়ার পর থেকেই তারাবীহর প্রচলন চলে আসছে। ফুকাহায়ে কেরাম সকলেই একমত তারাবীহ নামাজ পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য সুন্নত। ইমাম আযম আবূ হানীফা র. এবং মালেকী মাযহাবের কয়েকজন আলেম একে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বলে রায় দিয়েছেন। (ফাতাওয়ায়ে শামী: ২/৪৩) এটা ইসলামের নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ সা. এ নামাজের ব্যাপারে ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করেছেন। তিনি নিজে এ নামাজ কয়েক আদায় করেছেন, কিন্তু উম্মতের ওপর তা ফরজ হয়ে যাওয়ার ভয়ে সাহাবীদেরকে নিয়ে সদা-সর্বদা পড়েননি। সাহাবায়ে কেরামও এ নামাজকে খুবই গুরুত্ব প্রদান করতেন। তবে তখন এ নামাজ সম্মিলিতভাবে আদায় করা হতো না; বরং রাসূল সা. তাঁর জীবদ্দশায় মাত্র দুই বা তিনদিন অঘোষিতভাবে জামাআতের সাথে তারাবীহ নামাজ আদায় করেছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম পরদিন আবার তারাবীহ পড়তে আসলে রাসূল সা. আসেননি। তিনি ভোরে সকলকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি তোমাদের কর্মকান্ড লক্ষ্য করেছি। তবে এ আশঙ্কায় আমি তোমাদের কাছে বের হয়ে আসিনি যে, এই (তারাবীহ) নামাজ তোমাদের ওপর ফরজ হয়ে যাবে। (মুসলিম: ২৫৪২)
হযরত নূমান বিন বশীর রা. বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সা. এর সঙ্গে রমজানের ২৩ তারিখ রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত নামাজ আদায় করলাম। অতঃপর ২৫ তারিখ অর্ধেক রাত পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে নামাজ আদায় করেছি। এরপর তাঁর সঙ্গে ২৭ রমজানেরও নামায আদায় করলাম, মনে হতে লাগলো যে আমরা বুঝি ‘ফালাহ’ পাব না। সাহাবায়ে কেরাম সাহরীকে ফালাহ বলতেন। (নাসায়ী: ১৬০৬)
নবী পাক সা. সে সময় কত রাকআত তারাবীহ পড়েছেন, সে মর্মে হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সা. রমজানে মাসে ২০ রাকআত তারাবীহ এবং (পরে) বিতর নামায পড়তেন। (ইবনে আবী শাইবা: ৭৭৭৪)
এরপর রাসূলুল্লাহ সা.–এর ওফাত হয়ে গেল। প্রথম খলীফা আবু বকর রা.–এর যুগে তারাবীহ নবী করীম সা.–এর রেখে যাওয়া পদ্ধতিতেই চলছিল। (বুখারী: ২০০৯) পরবর্তীতে হযরত ওমর রা.–এর যুগে জামাআতবদ্ধ হয়ে রাতের প্রথমাংশে তারাবীহ পড়া হতো, যার প্রচলন এখন পর্যন্ত সাড়া বিশ্বে প্রচলিত আছে। বিশিষ্ট তাবেয়ী আব্দুর রহমান ইবনে আব্দুল কারী র. বলেন, ‘আমি রমজান মাসে ওমর রা.–এর সঙ্গে মসজিদের দিকে বের হলাম, তখন লোকেরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে (তারাবীহ) নামাজ পড়ছিলেন। কেউ একা পড়ছেন, আবার কেউ কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে পড়ছিলেন। তখন ওমর রা. বললেন, এদের সকলকে যদি একজন কারীর (ইমামের) অধীনে একত্রিত করে দিই, তাহলে ভালো হয়। এরপর তিনি তাদেরকে উবাই ইবনে কাব রা.–এর পিছনে জামআতবদ্ধ করে দিলেন। আরেক রাতে আমি তাঁর সঙ্গে বের হয়ে দেখলাম, লোকেরা এক ইমামের সঙ্গে জামআতে তারাবীহ পড়ছেন। তখন এ দৃশ্য দেখে ওমর রা. বললেন, এটি কতই না উত্তম বেদআত। তবে রাতের যে অংশে তোমরা দাঁড়াও তার থেকে ওই অংশ উত্তম, যে অংশে তোমরা ঘুমিয়ে থাকো, অর্থাৎ শেষ রাত। বর্ণনাকারি বলেন, তখন রাতের প্রথমাংশে তারাবীহ পড়া হতো। (বুখারী: ৮১৩)
ওমর রা.–এর সময় থেকে সাহাবায়ে কেরামের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ২০ রাকআত তারাবীর প্রচলন শুরু হয়। সাহাবায়ে কেরামের ঐক্যমত মোতাবেক জামাআতের সাথে ২০ রাকআত তারাবীর ব্যাপারে কোনো সন্দেহ পোষণ করা উচিত নয়। ইয়াযীদ ইবনু খুসাইফা র. বলেন হযরত সায়েব ইবনু ইয়াযীদ রা. বলেছেন, তাঁরা (সাহাবা ও তাবেয়ীন) ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.–এর যুগে রমজান মাসে ২০ রাকআত তারাবীহ নামাজ পড়তেন। তিনি আরও বলেছেন, তাঁরা নামাযে শতাধিক আয়াতবিশিষ্ট সূরাসমূহ পাঠ করতেন। (বায়হাকী: ৪৩৯৩) ওমর রা.–এর শাহাদাতের পর তৃতীয় খলীফা ওসমান রা.–এর খিলাফাতের সুদীর্ঘ সময় পর্যন্ত তারাবীহ নামাজ ২০ রাকআত করে আদায় করা হতো। যেমন বায়হাকীর হাদীসে রয়েছে, ওমর রা.–এর যুগে তাঁরা (সাহাবি এবং তাবেয়ীগণ) শতাধিক আয়াত বিশিষ্ট সূরা সমূহ তিলাওয়াত করতেন এবং ওসমান রা. এর যুগে দীর্ঘ নামাজের কারণে তাদের কেউ কেউ লাঠি সমূহে ভর দিয়ে দাঁড়াতেন। (বায়হাকী: ৪৩৯১) এই হাদীসে ইঙ্গিত রয়েছে ওসমান রা.–এর যুগেও ২০ রাকাআত তারাবীহ পড়া হতো। উপরন্তু তিনি নতুন কোনো ফরমান জারি করলে তা অবশ্যই ইতিহাসে সংরক্ষিত থাকতো। আলী রা.–এর যুগে তারাবীহ নামাজের রাকআত সম্পর্কে তাবেয়ী আব্দুর রহমান আস সুলামী র. বলেন, আলী রা. রমজানে ক্বারীদের ডেকে আদেশ করলেন, তারা যেন লোকদের নিয়ে ২০ রাকআত তারাবীহ পড়েন। (বায়হাকী: ৪৩৯৫)
পূরো রমজানে একবার কুরআন খতম করা সুন্নাত। এটা কোরআন নাযিলের মাস। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, রমজান মাস হলো সেই মাস যাতে কোরআন নাযিল করা হয়েছে। (সূরা বাকারা: ১৮৫) ব্যক্তিগতভাবে কোরআন খতম করার পাশাপাশি মাহে রমজানে তারাবীহ নামাজের মাধ্যমেও ২০ রাকআত নামাজের মাধ্যমে প্রথম সাত দিনে দেড় পারা এবং পরবর্তী বিশ দিনে এক পারা করে সাতাশ দিনে গোটা তিরিশ পারা কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা যায়। কোরআন শরীফ পাঠ করা এবং শ্রবণ করার এক অনিন্দ্য সুন্দর মাধ্যম হলো তারাবীহ।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তারাবীহ নামাজের গুরুত্ব ও ফযীলত অনুধাবন করার ও তা পালন করে আল্লাহর পক্ষ থেকে মাগফিরাত হাসিল করার তাওফীক দিন। আমীন।
লেখক : মাওলানা মোহাম্মদ বদরুজ্জামান রিয়াদ
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.