ওষুধ কোম্পানির কাছে বিক্রি হচ্ছে ডাক্তার

মোঃ নেজাম উদ্দিন, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার

  আজ বুধবার সকাল ১১টা।ককসবাজার সদর হাসপাতালের নিচতলা। এক রোগীকে ঘিরে ধরেন দুই যুবক। একজন রোগীর হাতের প্রেসক্রিপশন দেখছেন এবং অন্যজন মোবাইলফোনে ছবি তুলছেন। এর কারণ নিজেদের কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রিপশনে ডাক্তার লিখেছেন কিনা যাচাই করে দেখা। জানা গেল ওই যুবকরা ইডরাল ড্রাগ ল্যাবরেটরিজ নামের একটি অপরিচিত ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভ। একইদিন হুবহু দৃশ্য দেখা গেল কক্সবাজার ড়িজিটাল হাসপাতালেও। ডাক্তারের কক্ষ থেকে এক মহিলা রোগী বের হওয়ার পরই একসঙ্গে হুমুড়ি খেয়ে তার হাতের প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলতে থাকেন এসিআই, রেনেটাসহ অন্তত ছয়টি ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভ। কেবল এ দুইটি হাসপাতালেই নয়, শহরের প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও প্রাইভেট চেম্বারে ওষুধ কোম্পানিগুলোর রিপ্রেজেনটেটিভরা ডাক্তারদের কক্ষ থেকে রোগী বের হওয়া মাত্রই ঘিরে ধরছেন এবং প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলছেন। কেন প্রেসক্রিপশনের প্রতি এমন শকুনের দৃষ্টি-অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল নিজেদের কোম্পানির ওষুধ লেখার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন ও দামি গিফট দেওয়া হচ্ছে ডাক্তারদের। তাই ‘নূন খাই যার গুন গাই তার’-প্রবাদটি ডাক্তাররা ঠিকমতো পালন করছেন কিনা রিপ্রেজেনটেটিভরা পরখ করে দেখছেন প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে। শুধু কি নগদ টাকা? গাড়ি, খাবার, এয়ারকুলার, ফ্রিজসহ দামি গিফট, দেশে-বিদেশে সেমিনারে স্পন্সর, সবই করা হচ্ছে ওষুধের কাটতি বাড়িয়ে মুনাফা লাভের আশায়। এমনও শোনা গেছে একটি নামি ওষুধ কোম্পানি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের পড়ার খরচও বহন করছে, যেন ভবিষ্যতে ডাক্তার হয়ে ওই কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। কোনো কোনো কোম্পানি স্বপ্রণোদিত হয়েই ডাক্তারদের নগদ টাকা অফার দিচ্ছে। কিন্তু লাগামহীন কমিশন দিতে গিয়ে একসময় মাথায় হাতও পড়েছে। কমিশনের তুলনায় ওষুধ বিক্রির টাকা কম হওয়ায় পথে বসেছে ওই কোম্পানি। এমনই একটি কোম্পানি লিয়ন ফার্মা। ডাক্তারদের কমিশন দিতে গিয়ে খরচ এতটাই বেড়ে গেছে যে লিয়নের মালিকের অন্য একটি বড় ব্যবসায় ধস নেমেছে। ওই ব্যবসার লাভ থেকেই ওষুধ কোম্পানির শুরু হয়েছিল। লিয়ন ফার্মার অন্তত ৫০০ রিপ্রেজেনটেটিভ রয়েছেন। তাদের একেকজন মাসে কম করে হলেও ৪০ হাজার টাকা কমিশন বাবদ বণ্টন করছেন ডাক্তারদের মধ্যে। কোনো ডাক্তারকে মাসে ৫শ থেকে ১৫শ, আবার কাউকে আরো বেশি। একইভাবে কমিশন দিচ্ছে আরএকে ফার্মাসিউটিক্যালসও। কিন্তু বেশি কমিশন দিয়ে ওষুধ ব্যবসা জমাতে পারেনি। তবে বেশিরভাগ কোম্পানিই কমিশন ও গিফট থেরাপিতে (পদ্ধতি) সফল। যেমন মোটা অংকের কমিশন ও গিফট দিয়েও ওষুধ ব্যবসা চাঙা করেছে ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল। কোম্পানিটি প্রতিমাসে ডাক্তারদের প্রায় ৩ কোটি টাকা নগদ এবং চার কোটি টাকার গিফট দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এত কমিশন দিয়েও বাজারে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে কোম্পানিটি। সদ্য প্রতিষ্ঠিত সেন্ট্রাল হাসপাতালে প্রায়ই ঘুরতে দেখা যায় কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভদের। নগদ টাকা কমিশন না দিলেও দেশে-বিদেশে স্পন্সর এবং ফ্ল্যাট, গাড়ি, ফ্রিজ, কলম, প্যাড,ব্যাগ, মগ, ওষুধ, এয়ারকুলারসহ দামি গিফট দিচ্ছে প্রায় সব ওষুধ কোম্পানিই। এই তালিকায় বাদ নেই স্কয়ার, বেক্সিমকো, রেনেটা, অপসোনিন, নোভারটিস, ইনসেপ্টা, সনোফি, এসিআই, একমি, বিকন-এর মতো বড় কোম্পানিগুলোও। শোনা যাচ্ছে একটি বড় কোম্পানির তরফ থেকে একজন নামকরা ডাক্তারকে ফ্ল্যাটও উপহার দেওয়া হয়েছে। তার ফ্ল্যাট প্রাপ্তি দেখে লোভ সামলাতে না পেরে একই মাপের আরো একজন ডাক্তার ফ্ল্যাট চেয়ে বসে আছেন। তবে তিনি বসেই আছেন। অর্থাৎ এখনো ফ্ল্যাট নামক ভাগ্যদেবী ধরা দেয়নি তার কাছে। ওষুধ কোম্পানির পক্ষ থেকে নগদ টাকা, ফ্ল্যাটসহ দামি গিফট প্রদানের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির উপদেষ্টা ও জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মমিনুল হক বলেন, ফ্ল্যাট তো কোটি টাকার ব্যাপার। কোনো কোম্পানি ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছে কিনা জানি না। গডনোউজ। তবে যেকোনো অনৈতিক কাজই তো অপরাধ। ওষুধ বিক্রি বাড়াতে কমিশন দেওয়া তো আরো অনৈতিক। যিনি দেবেন এবং যিনি নেবেন সমান অপরাধী। এ ধরনের অনৈতিক কাজ না হলে কোম্পানিগুলো আরো ভালো উপাদান দিয়ে উন্নতমানের ওষুধ তৈরি করে রোগীদের উপকার করতে পারবে এবং বিদেশে বাংলাদেশের ওষুধের সুনাম আরো অনেক বেড়ে যাবে। এখন বিশ্বে ওষুধ শিল্পে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন দেশে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। ভালোমানের ওষুধ তৈরি করায় ইউরোপেও কদর বাড়ছে বাংলাদেশি ওষুধের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ওষুধ কোম্পানির মালিকের তথ্যমতে দেশে প্রায় তিনশ কোম্পানির ২৪ হাজার ব্রান্ডের ওষুধ তৈরি হচ্ছে। আর বছরে বিক্রি হয় ১২ হাজার কোটি টাকার ওষুধ। তার প্রায় অর্ধেক টাকাই যাচ্ছে ডাক্তারদের নানা বায়না মেটাতে। তিনি বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলোর কমিশনের অফার ডাক্তাররা লুফে নিচ্ছেন খুশিমনে। বিশেষ করে দেশে-বিদেশে সেমিনারের নামে ডাক্তাররা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। দেশের সেমিনারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সোসাইটির নামে চাঁদাবাজি এবং আর বিদেশের সেমিনারে যাওয়ার জন্য ব্যক্তিগতভাবেই বেশি চাঁদা আদায় হচ্ছে। মাঝেমধ্যে বিদেশে দলগতভাবেও সেমিনারে যাওয়া হচ্ছে । মজার ব্যাপার হচ্ছে- হৃদরোগ, লিভার, মেডিসিন, সার্জারিসহ ১০টি বিষয়ে মূলত ওষুধের ব্যবহার বেশি হলেও দেশে ডাক্তারদের সোসাইটি আছে শতাধিক। সম্মেলন, সেমিনার ইত্যাদি বলে কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে টাকা আদায় করছে এসব চিকিৎসক সোসাইটি। সেমিনারের নামে বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে যে অর্থ আদায় হয় তার বেশিরভাগই তারা মেরে খান সেমিনারের কথা বলে,

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.