অদম্য উৎসাহ আর অনুপ্রেরণায় এগিয়ে চলছে হাত বিহীন রায়হানের পথচলাঃ

জে,জাহেদ ফিচার লেখকঃ সেক্সপিয়র বলেছিলেন,পৃথিবী একটি নাট্যশালা। মহাজ্ঞানী শিব খেরা বলেন,কঠোর পরিশ্রম আর সাধনা করে যান -ইচ্ছা পুরণ হবেই। সত্যিই বড় বিচিত্র কষ্টের সুখকর কাহিনী। দু-হাত নেই, তবু থেমে থাকেনি রায়হানের পপথচলা আর পড়াশুনা । মুখ দিয়ে লিখেই সে এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। পুরা নাম তার বাহার উদ্দিন রায়হান। জম্ম কক্সবাজার শহরের চকরিয়া উপজেলার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নে । বর্তমানে মানব জীবনে উন্নত জীবন পেতে হলে অবশ্যই শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। সে কথা বুঝতেই পেরেছিলো রায়হান। যদিও ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ স্কুল পালিয়েছেন। নজরুল তো বেশি পড়তেই পারল না। লালন তো বুঝলইনা স্কুল কি!! তারপরেও আজ মানুষ তাদেরকে নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করছে। অ্যান্ড্র কার্নেগীকে ময়লা পোশাকের জন্যই পার্কেই ঢুকতে দেয়নি!! অথচ ৩০বছর পরে উনি সেই পার্কটি কিনে ফেলেন। আর সাইন বোর্ড লাগিয়ে দেন”সবার জন্য উন্মুক্ত। এটাই ইতিহাস দুনিয়ায়। স্টিভ জব শুধু মাত্র ১দিন ভালো খাবারের আশায় ৭ মাইল দুরে পায়ে হেটে গির্জায় যেতেন। আজ স্টিভ জবস কোথায় অবস্থান করেছে। ভারতের সংবিধান প্রনেতা বাবা আম্বেদকর নিম্ন বর্নের হিন্দু ছিলেন বলে স্কুলের বারান্দায় বসে বসে ক্লাস করতেন। পরে ভারতের ইতিহাসে তার নাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বাজার থেকে চাঁদা তুলে পড়ালেখা করেছেন। শেখ সাদী রঃ) এর চেহারা যথেষ্ট কদাকার ছিল,লতা মুঙ্গেশকরের চেহারা মোটেই সুশ্রী নয় । তৈমুর লেং খোড়া ছিলেন,নেপোলিয়ন বেটে ছিলেন,শচীন টেন্ডুলকারের উচ্চতা সবার জানাই আছে। আব্রাহাম লিংকনের মুখ ও হাত যথেষ্ট বড় ছিলো। আইনস্টাইন নিজের বাড়ির ঠিকানা ও ফোন নাম্বার মনে রাখতে পারতেন না। সুতরাং শিক্ষা নয় মুল বিষয় হলো ইচ্ছা শক্তি বড় জিনিস। অদম্য উৎসাহ আর প্রবল ইচ্ছা শক্তিই বদলে দিচ্ছে বাহার উদ্দিন রায়হানের জীবন। ইতিহাসের বড় বড় দার্শনিক,বিজ্ঞানী,কবি,পন্ডিতগণ সফল হয়েছেন শুধু একটি কারনে সেটা হলো নিজের কঠোর পরিশ্রম ও উৎসাহ আর স্থির পথচলায়। এসব থাকলে কোন কিছুই আপনার উন্নতির পিছনে বাধা হতে পারেনা। যদি কোন কিছু বাঁধা হয়ে দাড়ায় তবে তা আপনার ভিতরের ভয়। ভয়কে দুরে রেখে জয় করতে শিখুন সাফল্য তোমার পায়ে লুটাবে। অন্যদিকে বাবার মুখ দেখার সুযোগ হয়নি রায়হানের, মায়ের গর্ভে থাকার সময়ই পাড়ি জমিয়েছে না ফেরার দেশে । কেবল মা-ই আছে, আর কোন ভাই বোন নেই । সেই ছোট বেলা থেকেই অনেক কষ্টে লালন পালন করেছেন রায়হানকে, বাড়ির পাশে খেত-খামার করে সংসারের খরচ জুগিয়েছেন অসহায় মা। নিয়তির বড় নিষ্ঠুর পরিনাম। জন্ম থেকেই এমন প্রতিবন্ধকতা ছিলো না রায়হানের। পেছনের ঘটনা ২০০৪ সালের দিকে, সে তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। বাড়ির সামনে তখন বিদ্যুতের নতুন খুঁটি লাগানো হচ্ছিলো। সেই খুঁটিগুলো ছিলো তার বাড়ির সামনে গাছের পাশ দিয়েই। একদিন সকালে গাছে একটি পাখি আটকে যেতে দেখে সে। বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করে। কিন্তু’ পাখিটি বের হতে পারেনা। এ অবস্থা দেখে সন্ধ্যার দিকে সে নিজেই গাছে উঠে গেল পাখিটিকে ছাড়িয়ে দিতে। গাছে চড়ার পর হাত দিতেই হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পায় সে। এরপর আর কিছু মনে নেই । হুঁশ ফিরতে নিজেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করে সে। দুর্ঘটনার কারণে ছয় মাস হাসপাতালে পড়ে থাকতে হয় তাকে, পুরোপুরি সেরে উঠতে এরপর আরো দুই বছর চলে যায়। এসময় অন্যেরাই সব কাজে তাকে সহায়তা করতেন। কিন্তু এভাবে নিজেকে পরনির্ভরশীল দেখতে খুব বাঁধে ছোট রায়হানের। নিজে নিজে সব কিছু করার দিকে মনোযোগ দেয় সে। ২০০৬ সালে ভর্তি হয় তৃতীয় শ্রেণিতে। কনুই দিয়ে লিখতে তখনো ভালোমতো অভ্যস্ত হতে না পারায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়নি। তখন থেকেই শুরু তার পথচলা। মুখ দিয়ে লিখে একে একে পাশ করেছে জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা, এবং অবশেষে পাবলিক ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পাওয়া । শারীরিক অক্ষমতাকে জয় করার চেষ্টা করেছে সে প্রতিটি ক্ষেত্রে । পড়ালেখার অদম্য ইচ্ছা তাকে নিয়ে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে । এত শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বিভিন্ন সামাজিক কাজে নিয়োজিত আছে রায়হান, নিজগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছে ইয়ূথ হাঙ্গারসহ বিভিন্ন সমাজ সেবা সংগঠনের। মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে তৈরি করছে জনসচেতনতা। সে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে দিতে চায় শিক্ষার আলো। ভবিষ্যতেও হতদরিদ্র মানুষের জন্য কিছুর করার স্বপ্ন তার। বর্তমান সময়ে মানুষ মানুষের জন্যই দয়া দেখায় না , সেখানে এই মানুষটি একটি পাখীর জন্য নিজের অঙ্গ খুঁয়েছেন ! তাকে কি স্যালুট না দিয়ে পারা যায়। কবি বলে জীবে প্রেমে যেজন,সেজন ঈশ্বর। কেনোনা কতো বিচিত্র জগত। বিচিত্র রায়হানের মন, পশু পাখির প্রতি গভীর ভালোবাসা মুগ্ধ করেছে আমাদের। কত বড় হৃদয়ের মানুষ রায়হান, বন্দি পাখির কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজের জীবনে গুনতে হয় বড় দুর্ঘটনাজনিত নিজের ক্ষতির। সাবাস রায়হান,জীবে প্রেমের দৃষ্টান্তে মানবের মাঝে হাজার বছর ধরে বেচে থাকবে আমাদের মনে। প্রান ভরে শ্রদ্ধা করি নত মস্তকে রায়হান তোমায়। শিক্ষা জগতে বড় সাফল্যে নিয়ে ফিরবে একদিন। সেদিন আর কষ্ট থাকবেনা রায়হান তোমার নীড়ে।স্যালুট তোমায়!!

জে,জাহেদ সাংবাদিক ও লেখক

zahednews1987@gmail.com

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.