নব-নিয়মে ডুবন্ত সমাজের হাহাকার!!
লেখক, মাহবুবা সুলতানা শিউলি কলামিস্টঃ
সামিয়া,একটি ছদ্ম নাম। বাবা-মায়ের আদরের সবচেয়ে ছোট মেয়ে। ওরা পাঁচ বোন। কোন ভাই নেই তাদের। বাবা স্কুল শিক্ষক। মা গৃহিনী, ঘর সংসার দেখাশুনা করেন। অভাব অনটনের সংসারেও বাবা মেয়েগুলিকে লেখাপড়া করিয়েছেন।
সামিয়ার বড়, মেঝ, সেজ ও ছোট আপুর ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে। বড় আপা এইচ. এস. সি. পর্যন্ত পড়েছে। বাকিরাও গ্রামের কলেজ থেকে ডিগ্রী পাশ করেছে।
এত কষ্ট করে তাদের পড়াশুনা করানোর পরও তাদের বিয়ের সময় এবং বিয়ের পরবর্তী আয়োজন গুলি করতে করতে বাবা যেন পঙ্গু হয়ে গেছেন। মায়েরও যেন সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। এখন ৫ম মেয়ে সামিয়ার পালা। সবে এইচ. এস. সি. শেষ করেছে। কিন্তু তার শারিরিক গঠন একটু বাড়ন্ত হওয়ায় দেখতে অনেক বড় দেখা যায়।
গায়ের রং শ্যামলা ধাঁচের। তার আপুরা যথেষ্ট ফর্সা থাকার কারণে তাদের বিয়ের যৌতুকের ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা হয়নি। কিন্তু সামিয়ার গায়ের রং কালো, দেখতে একটু বয়সী দেখার কারণে ভাল প্রস্তাব আসছিল না। তবে সবার ছোট ও আদরের কম মেধাবী মেয়ে। সেইজন্য ওর লেখাপড়ার প্রতিও তেমন মনোযোগ নেই।
সামিয়াকে নিয়ে ওর মায়ের চিন্তার শেষ নেই। যাই হোক, মোটামুটি ভাল একটা ছেলের সন্ধান মিলল। ওদের সামিয়াকে বেশ পছন্দ হয়েছে। অর্থাৎ যথেষ্ট যৌতুকের বিনিময়ে তারা সামিয়াকে ঘরে তুলতে রাজি। বরপক্ষ যেদিন সামিয়াকে দেখতে আসবে। সেদিনের আয়োজনের জন্য বাবা ধারকর্জ করে বিশ হাজার টাকা যোগাড় করেছেন। ঐ টাকা দিয়ে প্রথম পর্বের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করলেন যথা সময়ে।
এবার ২য় পর্ব, হাতে নেই এক পয়সাও। অন্য বোনদের পড়ালেখার খরচ ও তাদের বিয়েতে খরচ করে বাবা একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেছেন। বাবা-মায়ের চোখে ঘুম নেই। টেনশনে টেনশনে নিঃশেষ হয়ে গেছেন। কোন উপায় না দেখে তারা আত্নীয়-স্বজনের ধারস্ত হলেন। এবার আত্নীয়-স্বজনও সবাই বিরক্ত। আগেও তাদের বার বার সাহায্য-সহযোগিতা করতে হয়েছে।
এবার যেন কোন আত্নীয়ও আর সাহায্য করতে চাচ্ছেন না। কিন্তু সামিয়ার বাবা-মায়ের জ্বালাতনে সবাইকেই কিছু না কিছু সাহায্য করতে হয়েছে। শেষ সম্বল একটা ছোট জমি ছিল, সেটিও বিক্রি করতে বাধ্য হলেন। আরো কিছু ধার দেনা করে যা যোগাড় হলো তা দিয়ে অপারক হলেও বিয়ের যৌতুক থেকে শুরু করে সকল আয়োজন শেষ করলেন। সামিয়াও বাবা-মাকে কাঁদিয়ে, নিজেও অনেক কান্নাকাটি করে বিদায় নিলো।
হে আমার পাঠক,এখানেই শেষ নয়। বিয়ের কদিন পরেই এবার ফিরতি নামের আরেক নাটক। সেই নাটকের প্রয়োজনে আবারো ২০-২৫ হাজার টাকার গচ্ছা গেলো। তারপর মেয়ে বাপের বাড়ি যাবে, দু’তিন দিন থাকবে। শ্বশুর বাড়ি ফেরার সময় আবারো এটা-ওটা-সেটা কত কিছু করে মেয়ের সাথে করে পাঠাতে হবে। সেই জন্য আবারও ১৫-২০ হাজার টাকার ধাক্কা। নাটক এখানেও শেষ হতে পারত কিন্তু হয়নি!!
কিছুদিন পর রমজান মাস চলে আসলো। পাঠক খুশি তাইনা, কারণ রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ। কিন্তু সামিয়ার বাবা-মা আতংকিত। কালো মেয়েটার শ্বশুরবাড়িতে বস্তা বস্তা ইফতারির আইটেম যে পাঠাতে হবে আবারো।
হায়! আর কয়েকদিন পর খুশির ঈদ। কিন্তু সামিয়ার বাবা-মা কি খুশি? সামিয়ার শ্বশুর-শ্বাশুড়ী, শ্বাশুড়ীর ৫ বোন, শ্বশুরের ৪ ভাই – ৫ বোনের জন্য শাড়ি, ভাইদের জন্য পাঞ্জাবী, সামিয়ার ৩ ননদের জন্য শাড়ী, ভাসুর ও ভাসুরের বউয়ের জন্য শাড়ি উপহার, ননদের স্বামীর জন্য উপহার ও বাচ্চাদের জন্য কাপড় চোপড় পাটাতে হবে। কিন্তু কিভাবে,ধার দেনায় এক গলা বরাবর হয়েছে। না পাটালে আবার সামিয়ার উপর কি কি হতে পারে, আন্দাজও করতে পারিনা। কেননা অন্যান্য বউদের বাসা হতে পাটাবে।
তারও কিছুদিন পর। আহ কি খুশী! সামনে কুরবানী ঈদ। সামিয়ার বাবা-মা এখন কি করবে? আস্ত একটা গরু না হোক, একটা বড় সাইজের ছাগলতো দিতেই হবে। কিন্তু বিয়ের প্রথম বছর গরু পাঠাতে না পারাটা যেন অত্যন্ত অপমানকর অবস্থা!! এভাবে একের পর কত বাহনা আর মেয়ের শ্বাশুরবাড়ির আবদার পুরণে টাকা হজম ভরপুর।
এবার একটা সুখবর এলো। সামিয়া মা হতে চলেছে। যে শিশু পৃথিবীতে এখনো আসেনি, তার জন্য সামিয়ার মাকে ডজন ডজন নকশী কাঁথা সেলাই করতে হচ্ছে। শরীরটা যেন শেষ হয়ে গেল। আর পারছেন না। শরীরে যেন আর কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই, তবুও তো এ দায়িত্ব থেকে পরিত্রাণের কোন সুযোগ নেই।
দিন ঘনিয়ে এলো। ফুটফুটে একটা পুত্র সন্তানের মা হলো সামিয়া। নাতিকে দেখতে যাবে সামিয়ার বাবা-মা। দোলনা ও একটা স্বর্ণের চেইনতো দিতেই হবে। তারও কিছুদিন পর বাচ্চার আকিকা দিতে হবে। যেহেতু ছেলে বাচ্চা, নানু বাড়ি থেকে গরু দিতে হবে। কিন্তু কিভাবে?
ফুটফুটে বাচ্চাটি বড় হচ্ছে, তার ছোট ছোট দাঁত উঠেছে। এখন নানু বাড়ি থেকে তার জন্য পোলাও-মুরগীর রোস্ট পাঠাতে হবে। মানে ছোট বাচ্চাটির নাম দিয়ে বাকীরা তা গিলে খাবে!! এভাবে নাটক চলতেই থাকে কণে পরিবারের উপর চাপ অনন্তকাল। আমাদের সমাজ অন্ধ,গুনে ধরা উইপোকায় ধরেছে চেপে সমাজটাকে। দিন দিন নিত্য নতুন দিবস আর সামাজিক ভ্রান্ত নিয়মে অতিষ্ট মধ্যবিত্ত পরিবার,যাতাকলে পিষ্ট আমার নিম্নশ্রেণীর অভিভাবক।
এ ধরণের বানানো আনুষ্ঠানিকতা করতে যেয়ে একজন মানুষের ওপর মানুষিক ও শারিরীক যে চাপ সৃষ্টি হয়, সে চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অনেকে প্যারালাইসিস কিংবা বহুমুত্র রোগে নিমজ্জিত অনেকে আজ।
এখন প্রশ্ন হলো? এগুলি কি সামাজিকতা নাকি সামাজিক ব্যাধি? মেয়ে নামক বিচিত্র প্রাণী গুলি কি মানুষ? নাকি মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা কিংবা অধিকার পাবার জন্য তার বাবা-মাকে মরে মরে বাচঁতে হবে!! সাধ্য নেই তবে সাধের লাগাম টানতে ক্লান্ত শরীরে ভাঁজ পড়েছে ?
এসবের বিনিময়ে মেয়ে যেন শ্বশুরবাড়িতে একটু শান্তিতে থাকতে পারে। এসবের বিনিময়ে মেয়ের সুখের ব্যবস্থা করে বাবা মা। জানিনা সমাজে কত মেয়ে এত আবদার পুরণ করতে পারে বা সুখী হতে পারে। তার কোন সমীক্ষা দেখিনি। যারা সামর্থ্যবান তাদের জন্য বিষয়টি হয়তো কিছুটা সহনীয়, কিন্তু সামিয়ার বাবা-মায়ের মতো মানুষ গুলোর কি অবস্থা আজ।
এই মানব সমাজ কি কোনদিনও ভেবে দেখেছে? কে বানিয়েছে এমন নিয়ম-কানুন? বাংলাদেশের গ্রামীন সমাজসহ দেশের আনাচে কানাচে ক্যান্সারের মত এমন সামাজিক ব্যাধির পরিধি দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। পরিবর্তন হচ্ছে দেশ কিন্তু এ ব্যাধি নিরাময় তো দূরের কথা আরো যেন এর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে বহুগুন। নতুন নতুন নিয়মে ভারি হচ্ছে অসহায় কণে পরিবারের বুক। তাহলে বাংলাদেশ কি সামাজিকতার নামে এ সামাজিক ব্যাধি থেকে কখনো মুক্তি পাবে?
নাকি নিয়ম ভুলে অনিয়মে ডুবেছে সমাজ। নয়তো আজীবন এভাবে বিয়েতে কণে পরিবার বড় অসহায় হয়ে থাকবে। আমাদের সামাজিক প্রথায় আইন মৃত হয়ে নীরব রয়েছে। তা ঠিক তবে জাগ্রত হয়েছে শ্বশুরবাড়ি নানা আবদার। জানিনা কণেদের এমন বিয়েতে কতো পরিবার আজ নিঃস্ব। তবে সাধ্য নেই তবুও সাধ পুরণে ক্লান্ত আমার অসহায় মা বাবারা।
______________________________________
লেখক: মাহবুবা সুলতানা শিউলি,
সদস্য, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ,
কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.