ও জেরুজালেম!
আনিস আলমগীর
মক্কা, মদিনা এবং বায়তুল মুকাদ্দাস হচ্ছে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মীয় স্থান। বিশ্বের ৫৬টি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ বহু বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতদ্বৈততা পোষণ করে থাকে। কিন্তু এ তিনটি ধর্মীয় পবিত্র স্থান সম্পর্কে কারো মধ্যে কোনও মতপার্থক্য নেই।
অক্টোবর মাসে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে সৌদি আরব ডেকে নিয়ে ছিলো আর প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে বলেছিলেন তোমরা জেরুজালেম ছেড়ে যাও জেরুজালেম হবে ইসরায়েলের রাজধানী আর তোমরা তার পার্শ্ববর্তী শহর আবুদিসকে তোমাদের রাজধানী কর। নিউেইয়র্ক টাইমস বলেছে এ বিষয়ে সৌদি প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দুই মাস সময় দিয়েছেন।
২৩ বছর আগে সম্পাদিত অসলো চুক্তি অনুসারে আবুদিস শহর একটা ‘বি’ ক্যাটাগরির শহর। আর চুক্তি অনুসারে এ শহরে ইহুদী আর ফিলিস্তিনীদের দ্বৈত শাসন কায়েম রয়েছে। মুহাম্মদ আব্বাসের সৌদি আরব সফর শেষ হওয়ার পর পরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি স্বরূপ তেল আবিব থেকে আমেরিকান দূতাবাস জেরুজালেম স্থানান্তরের আদেশে সই করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিষয়টি ছিলো ইসরায়েল, সৌদি আরব এবং আমেরিকার মধ্যে পূর্ব পরিকল্পিত।
১৯৯৫ সালের অসলো চুক্তিতে জেরুজালেমের অধিকার উভয় রাষ্ট্রের সম্মতির ভিত্তিতে নির্ধারণের বিষয়টি স্থির ছিলো। সৌদি আবরকে দিয়ে জেরুজালেমের উপর থেকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অধিকার বঞ্চিত করার নীল-নকশা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে ইসরায়েল। অনুতাপের বিষয় হল সৌদি আরবই ইসরায়েলের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নগ্নভাবে সাহায্য করছে। সৌদি আরব হচ্ছে মক্কা ও মদিনার হারেমের খাদেম। অনুরূপ খাদেমগীরীর জন্য তারা মুসলিম বিশ্বের আধ্যাত্মিক নেতাও। এখন তারা আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের অধিকার হারালো। পুরো মুসলিম বিশ্বের কাছে আর আগের মর্যদার আসন পাবে না।
জেরুজালেম মুসলিম বিশ্বের আরেকটি পবিত্র স্থান। মসজিদে আল-আকসার অবস্থান জেরুজালেমে। আর এটা হচ্ছে মুসলমানদের প্রথম কেবলা। হযরত মুহাম্মদ (স.) মেরাজে গিয়েছিলেন এই মসজিদ থেকে। অবশ্য খ্রিস্টান আর ইহুদীদের পবিত্র ধর্মস্থানও জেরুজালেম। এই কারণেই জাতিসংঘ ১৯৪৭ সালে কারো তত্ত্বাবধায়নে এ শহরটি দেয়নি।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল জেরুজালেম দখল করেছিলো। ইসরায়েল জেরুজালেম দখল করেছে ৫০ বছর অন্য কোনও প্রধানমন্ত্রী জেরুজালেমে রাজধানী স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেয়নি। নেতানিয়াহুই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি তেল-আবিব থেকে রাজধানী জেরুজালেমে আনার উদ্যোগ নিচ্ছেন। পূর্বে রাজধানী পরিবর্তনের কথা যে একেবারে হয়নি তাও নয়। তবে বিদেশীরা বলেছেন তারা তাদের দূতাবাস জেরুজালেমে নেবেন না। এ কারণে ইসরায়েলের কোনও প্রধানমন্ত্রীই বেশী তৎপর ছিলেন না।
ট্রাম্পের তেল-আবিব থেকে দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত কেউই সমর্থন করেনি। জাতিসংঘ, ফ্রান্স, বৃটেন রাশিয়া, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেউই একমত হননি। অর্থাৎ আমেরিকা দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে নিলেও অন্য কেউ নেবে না। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসন বলেছেন ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ হবে।
আমেরিকার এ সিদ্ধান্তের পর থেকে সমগ্র ফিলিস্তিনে বিক্ষোভ চলছে। শুক্রবার নামাজের পর আল-আকসা মসজিদ থেকে মুসলমানেরা খোদ জেরুজালেমেই বিক্ষোভ করেছে। গাজায় হামাসের উপর ইসরায়েলিরা বোমা নিক্ষেপ করেছে এ পর্যন্ত চারজন বিক্ষোভকারী ইসরায়েলীদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে। প্রত্যেক মুসলিম দেশে বিক্ষোভ হচ্ছে। হামাস-হিজবুল্ল্যাহ তৎপর হলে মধ্যপ্রাচ্যে পুনরায় শান্তি ও শান্তি প্রক্রিয়া ভূলুণ্ঠিত হবে। গত শুক্রবার খোদ ওয়াশিংটনে বিক্ষোভ হয়েছে হোয়াইট হাউস এর সামনে। বিক্ষোভের পর তারা জুমার নামাজও আদায় করেছে প্রেসিডেন্ট পার্কে।
আমেরিকা জানে তাদের দূতাবাস স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত মুসলমানের আবেগে আঘাত লাগবে। বিশ্বের ১৫০ কোটি মুসলমানের আবেগকে উপেক্ষা করে তারা এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা নিয়েও আমেরিকার কোনও উদ্বেগ নেই। কারণ আমেরিকার এ সিদ্ধান্তের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির আগুন জ্বলবে। এ বিষয়টা আমেরিকা খুব ভালভাবেই অবগত রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটা ‘ইনতিফাদা’ বা ‘গণঅভ্যুত্থান’ আমেরিকা উস্কিয়ে দিল, বিশেষ করে তার উন্মাদ প্রেসিডেন্ট।
হামাস এরই মধ্যে ‘ইনতিফাদা’র ডাক দিয়েছে। অসলো চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিলো আমেরিকার ব্রোকারির ফলে। আমেরিকা চুক্তিটির বাস্তবায়নের জন্য বিশেষভাবে যত্নবান ছিলো না, যে কারণে ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে এবং জেরুজালেমে গত ২৩ বছরে ৮ লক্ষ ইহুদি বসতি গড়ে তুলেছে। অসলো চুক্তির ভিত্তিতে ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল এ দুই রাষ্ট্রের ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের পরে আর কোনও প্রেসিডেন্ট এ চুক্তি বাস্তবায়নে যত্নবান হননি।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে তো ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু উপেক্ষা করেই চলেছেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার কংগ্রেসে বক্তৃতার জন্য আহ্বান জানালো। তিনি ওয়াশিংটন আসলেন-কংগ্রেসে বক্তৃতা দিলেন অথচ প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য হোয়াইট হাউসে যাননি। তখন কংগ্রেসে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো। যখনই হোয়াইট হাউসে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন তারা মুসলিস সেন্টিমেন্টকে উপেক্ষা করেছেন। আর ইসরায়েলের পরামর্শে মধ্যপ্রাচ্যের নীতি নির্ধারণ করেছেন।
রিপাবলিকানরা কখনও অনেস্ট ব্রোকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি। যে কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বিরাজমান সমস্যার কোনও সমাধানই গত ৬৯ বছরে সম্ভব হয়নি। আমেরিকা ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্বই বিপন্ন করে ফেলেছে। ইরাকের আর লিবিয়ার আজকের অবস্থার জন্য শতাংশে আমেরিকাই দায়ী এবং তা করা হয়েছে ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য। মিশরের প্রেসিডেন্ট মুরশিকে সরানো হয়েছে আর জেনারেল সিসিকে প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে- একই কারণে।
এখন ইরানকে নিয়ে খেলা শুরু হয়েছে। ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো ইরান নিউক্লিয়ার্স উইপন বানাচ্ছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের ৭০তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অভিযোগ করলেন ইরান আনবিক বোমার অধিকারী হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা উদ্যোগ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য এবং জার্মানীকে নিয়ে কমিটি করে দিয়েছিলেন আর এ কমিটি ইরানের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছে যা জাতিসংঘও অনুমোদন দিয়েছে। এ চুক্তির বিনিময়ে জাতিসংঘ ইরানের উপর থেকে আরোপিত বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিযে ইসরায়েল আর সৌদি-আরবের অসন্তুষ্টির সীমানা নেই।
সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। আর ইরান, তুরস্ক হচ্ছে তার পথের কাঁটা। এখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলছেন তারা ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত পরমাণু চুক্তি বাতিল করবে। অথচ এ চুক্তি এককভাবে আমেরিকা সম্পাদন করেনি। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য, প্লাস জার্মানী এ চুক্তির স্বাক্ষরদাতা। অপর সাক্ষর দাতারা চুক্তি বহাল রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের সঙ্গে জাতিসংঘও রয়েছে কারণ জাতিসংঘ চুক্তিটি অনুমোদন করেছে।
ট্রাম্পের ছেলে মেয়েদের বিয়ে সাদী হয়েছে ইহুদীদের সঙ্গে। ট্রাম্প পরিবার ইহুদি প্রভাবিত পরিবার। সর্বোপরি ট্রাম্প রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তিও নন। সুতরাং তাকে দিয়ে মুসলিম বিশ্বের কোনও ক্ষতি করানো ইসরায়েলের পক্ষে অসম্ভব নয়। বিশ্বে মুসলমানদের সংখ্যা ১৫০ কোটি অর্থাৎ সারাবিশ্বের জনসংখ্যার ২২% শতাংশ। আর ইহুদিদের জনসংখ্যা হচ্ছে ১ কোটি ৪০ লক্ষ।
মুসলিম বিশ্বের অনৈক্যই মুসলমানদের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। এখন থেকে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের ব্যাপারে মুসলিম নেতাদের জোরালো ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। ওআইসি ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে মুসলিম উম্মার ঐক্যের ডাক দিতে পারে। আশা করি বর্তমান চেয়ারম্যান এরদোগান আগামী বৈঠকে তা করার চেষ্টা করবেন।
আনিস আলমগীর : শিক্ষক ও সাংবাদিক।
anisalamgir@gmail.com
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.