জামানত হারিয়েই চলেছেন বিএনপি’র প্রার্থীরা

ডেস্ক নিউজ:
নির্বাচনে জামানত বাজেয়াপ্তের মধ্যেই রয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর সংসদের যত আসনে উপনির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে একটি বা দুটি ছাড়া সবক’টিতেই বিএনপি’র প্রার্থীরা তাদের জামানত হারিয়েছেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনেও দলের ৬০ শতাংশ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। অবশ্য শপথ না নেওয়ার কারণে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের শূন্য হওয়া আসনে দলের মনোনীত প্রার্থীর জয় হয়। এদিকে সংসদ নির্বাচন ছাড়াও স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচনগুলোতেও বিএনপি প্রার্থীদের জামানত টিকছে না।

২০২০ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের বিভিন্ন উপনির্বাচন এবং এ সময়ে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার পরিষদের সাধারণ ও উপনির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে, মনোনয়নপত্র কেনার সময় একজন প্রার্থীকে জামানত হিসেবে ২৫ হাজার টাকা নির্বাচন কমিশনে জমা রাখতে হয়। নির্বাচনে কোনও আসনে প্রদত্ত ভোটের আট ভাগের একভাগ ভোট যদি কোনও প্রার্থী যদি না পান, তাহলে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। প্রদত্ত ভোটের আট ভাগের একভাগ বা তার বেশি ভোট পেলে জামানত হিসেবে রাখা ২৫ হাজার টাকা ফেরত দেওয়া হয়। কোনও প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হলে অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয়।

বৃহস্পতিবার (১২ নভেম্বর) জাতীয় সংসদের সিরাজগঞ্জ-১ ও ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দুটি উপনির্বাচনের কোনোটিতেই বিএনপির প্রার্থীরা তাদের জামানত রক্ষা করতে পারেনি।

ঢাকা-১৮ আসনে আওয়ামী লীগের হাবিব হাসান ৭৫ হাজার ৮২০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম বিএনপির এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন পেয়েছেন পাঁচ হাজার ৩৬৯ ভোট। এ আসনে মোট ভোট কাস্ট হয়েছে ৮১ হাজার ৮১৮ ভোট। ফলে বিএনপির প্রার্থীর জামানত রক্ষায় দরকার ছিল ১০ হাজার ২২৭ ভোট। কিন্তু তিনি তার অর্ধেকের মতো ভোট পেয়েছেন।

একই দিনে সিরাজগঞ্জ-১ আসনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী তানভীর শাকিল জয়। তিনি এক লাখ ৮৮ হাজার ৩২৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সেলিম রেজা পেয়েছেন মাত্র ৪৬৮টি ভোট। নির্বাচনে মোট কাস্টিং ভোট এক লাখ ৮৮ হাজার ৯৭৩। এক্ষেত্রে প্রার্থীদের জামানত রক্ষায় অন্তত ২৩ হাজার ৬০০ ভোটের দরকার ছিল।

গত ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ঢাকা-৫ আসনে মোট ভোট পড়ে ৪৯ হাজার ১৪১টি। এরমধ্যে বিএনপির প্রার্থী সালাউদ্দিন পান মাত্র দুই হাজার ৯২৬ ভোট। জামানত রক্ষায় তার ভোটের দরকার ছিল ছয় হাজার ১৪৩ ভোট। এ আসন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. কাজী মনিরুল ইসলাম ৪৫ হাজার ৬৪২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন।

একই দিনে অনুষ্ঠিত নওগাঁ-৬ আসনের উপনির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থীর জামানত রক্ষা হয়নি। ওই আসনে মোট প্রদত্ত এক লাখ ১১ হাজার ৯৪২ ভোটের মধ্যে বিএনপির শেখ মো. রেজাউল ইসলাম পান চার হাজার ৬০৫ ভোট। এ আসনে নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. আনোয়ার হোসেন (হেলাল) এক লাখ পাঁচ হাজার ৫২১ ভোট পেয়ে জয়ী হন। এ আসনে বিএনপি প্রার্থী জামানত রক্ষার প্রয়োজনীয় সংখ্যার ৯ হাজার ৩৮৮ ভোট কম পেয়েছেন।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত পাবনা-৪ উপনির্বাচনে ভোট পড়ে দুই লাখ ৫০ হাজার ৬৮৪টি। এরমধ্যে বিএনপির হাবিবুর রহমান হাবিব পাঁচ হাজার ৫৪৮ ভোট। এখানেও বিএনপি প্রার্থী ব্যর্থ হন জামানত রক্ষার প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোট পেতে। এ আসনে জামানত রক্ষায় বিএনপি প্রার্থীর ৩১ হাজার ৩৩৫ ভোট পাওয়ার দরকার ছিল।

১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত যশোর-৬ আসনে মোট ভোট কাস্ট হয় এক লাখ ২৯ হাজার ৬৭টি। এরমধ্যে বিএনপির প্রার্থী আবুল হোসেন আজাদ পান দুই হাজার ১২ ভোট।

একই দিনে অনুষ্ঠিত বগুড়া-১ আসনের উপনির্বাচনে মোট ভোট পড়ে এক লাখ ৫০ হাজার ৭৪৬ ভোটি। এরমধ্যে বিএনপির প্রার্থী একেএম আহসানুল তৈয়ব জাকির পান ৬৬৪ ভোট।

অবশ্য করোনা সংক্রমণের কথা বলে বিএনপি যশোর-৬ ও বগুড়া-১ আসনের উপনির্বাচন ভোটের আগেই বর্জনের ঘোষণা দেয়।

গত ২১ মার্চ অনুষ্ঠিত বাগেরহাট-৪ ও ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের জামানত রক্ষা হয়নি। তবে একই দিনের অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৩ আসনের উপনির্বাচনে অল্পের জন্য জামানত রক্ষা হয় বিএনপির প্রার্থী মইনুল হাসান সাদিকের। ওই আসনে জামানত রক্ষায় তার দরকার ছিল ২০ হাজার ১৩০ ভোট। তিনি পান ৪১ হাজার ৪০৮ ভোট।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা ২৫৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামানত হারান ১৫২ জন।

সংসদ নির্বাচন ছাড়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচনেও বিএনপি প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।

গত ২০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত যশোর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী নুর উন নবী ও ২০ অক্টোবর মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী চৌধুরী নাদিরা আক্তার, ১০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত চাঁদপুর পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির আক্তার হোসেন মাঝি, একই দিনে অনুষ্ঠিত ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে বিএনপির এজিএম বাদল আমিন তাদের জামানত রক্ষা করতে পারেননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির সমন্বয়ক ও দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেসব নির্বাচনের কথা বলছেন তার কোনোটিতেই নির্বাচন হয়নি। সবকিছু একতরফা হয়েছে। নির্বাচনের নামে তামাশা হচ্ছে। এজেন্টদের মারধর ও বের করে দেওয়া হয়। বিএনপির নেতাকর্মীদের কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয় না। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। নির্বাচন কমিশন আর সরকার যুক্তি করে এসব করছে। গণসংযোগ থেকে শুরু করে পদে পদে বিএনপির প্রার্থীসহ নেতাকর্মীদের বাধা দেওয়া হয়।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এত কিছুর পরেও আমরা গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনে অংশ নেই। সরকার ও নির্বাচন কমিশন কতটা নিচে নামতে পারে, সেটা জনগণকে দেখানোর জন্য আমরা ভোট করি। তবে নির্বাচনের নামে চলমান এই তামাশার বিষয়ে আমাদের নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে।’

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপির মধ্যে একটা সংকট আছে। তাদের নেতৃত্ব সংকট রয়েছে। তবে এটা জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার মতো কারণ হতে পারে না। কারণ, নেতৃত্ব সংকট থাকলেও তাদের কর্মী কিন্তু রয়েছে। আমাদের মনে হচ্ছে, নির্বাচনের নামে প্রহসন হওয়ার জন্যই সরকারি দলের প্রার্থী ছাড়া সবার জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। মানুষ ভোটদান থেকে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিরত রাখা হচ্ছে। আর এই বিষয়টিকে সত্য ধরে নিলে তা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত।’

সিরাজগঞ্জ-১ আসনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে বিজয়ী প্রার্থী পরাজিত প্রার্থীর চেয়ে ৪০০ গুণের বেশি ভোট পেয়েছে। এর অর্থ কোনও বিরোধী পক্ষ নেই। সরকারি দলের মনোনয়ন পেলেই নির্বাচনি বৈতরণী পার হবে। যার কারণে ভোটাররা নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক নয়।’ বাংলা ট্রিবিউন

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.