বাঙালি বিয়ে করায় রাঙামাটিতে পাহাড়ি মেয়েকে নির্যাতন

এম.কামাল উদ্দিন, রাঙামাটি : বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করায় গলায় শেকল দিয়ে বেঁধে টানা প্রায় দুই মাস ধরে শারিরীক ও অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে রাঙামাটির পাহাড়ি মেয়ে জোসনা চাকমার (২২) ওপর। স্বগোত্রের দুর্বৃত্তরা সম্প্রতি জেলার নানিয়ারচর এলাকায় তার ওপর এ নির্যাতন চালায় বলে অভিযোগ করেন ঘটনার শিকার জোসনা চাকমা।
নানিয়ারচর উপজেলার নানাকুরুম নামক দুর্গম পাহাড়ি গ্রামবাসী জহর লাল চাকমা ও রত্না চাকমার মেয়ে জোসনা চাকমা বলেন, গত বছর ১৮ নভেম্বর দুপুরের দিকে বাড়ির বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। তারা নিজেদের ইউপিডিএফের লোক বলে পরিচয় দেয়। এরপর গলায় শেকল দিয়ে বেঁধে বদলিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আটকে রাখা হয় তাকে। এভাবে টানা প্রায় দুই মাস ধরে আটকে রেখে তার ওপর বেধড়ক মারধর ও অমানুষিক নির্যাতন চালায় স্বগোত্রের দুর্বৃত্তরা। শেষে সুযোগ বোঝে জীবনবাজি রেখে পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন তিনি।

গভীর রাতে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন রাঙামাটি সদরের কুতুকছড়ি সেনাক্যাম্পে। বৃহস্পতিবার সকালে রাঙামাটি প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে ঘটনার বর্ণনা দেন জোসনা চাকমা। এ সময় তার স্বামী অপু চন্দ্র সিংহ উপস্থিত ছিলেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জোসনা চাকমা বলেন, তিনি ২০০৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর চলে যান চট্টগ্রামে গার্মেন্টস চাকরিতে। থাকতেন চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকায়। সেখানে পরিচয় ঘটে কুমিল্লার আলীশ্বর গ্রামের বাসিন্দা স্বপন চন্দ্র সিংহ ও গীতারাণী সিংহের ছেলে অপু চন্দ্র সিংহের সঙ্গে। ধর্মে তারাও বৌদ্ধ। অপু চন্দ্র সিংহ চট্টগ্রামে টেলিটক কাস্টমার কেয়ারে চাকরি করতেন। এক পর্যায়ে একে অপরের মধ্যে ভালো লাগা আর মন দেয়া-নেয়া থেকে জন্ম নেয় দু’জনের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার।

এর শেষ পরিণতির এক পর্যায়ে গত বছর ১৮ জুলাই চট্টগ্রামে আদালতের মাধ্যমে বিয়ের হলফনামা সম্পাদন করি। পাশাপাশি ধর্মীয় রীতিমতেও তা সম্পাদন করি।

এরপর স্বামী-স্ত্রী চট্টগ্রামে বসবাসের কয়েক মাস পর বাবা-মা’র সম্মতি ও পরামর্শে সামাজিকভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে দু’জনেই নানিয়ারচরের নানাকুরুমের আমাদের গ্রামের বাড়ি যাই।
জোসনা বলেন, বাবা-মা বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয় গত বছর ১৮ নভেম্বর। দুপুরের দিকে অতর্কিত বিয়ে বাড়ি গিয়ে হানা দেয় অস্ত্রধারী চার যুবক। তারা সবাই উপজাতি। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে আমাদের বর-কনে দু’জনকেই অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ডেকে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। তখন তারা নিজেদের ইউপিডিএফের লোক পরিচয় দেয়। পরে রাস্তার অর্ধেক পথ থেকে আমার বর অপু চন্দ্র সিংহকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে কিছুক্ষণ পর পাঠানোর কথা বলা হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমাকে গলায় শেকল দিয়ে বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

ওই সময় নিজের জাতির ছেলে রেখে কেন বাঙালি বিয়ে করেছি, সেই অপরাধে আমার ওপর দিনরাত বেদম মারধর ও অমানুষিক নির্যাতন চালায় দুর্বৃত্তরা। এভাবে প্রথমে রাঙামাটি সদরের কুতুকছড়ির ডলুছড়ির কালাবিচা চাকমার বাড়িতে তিন সপ্তাহ, চোংড়াছড়ির শান্তি চাকমার বাড়িতে প্রায় এক সপ্তাহের অধিক এবং শেষে শুকরছড়ির আনন্দ মণি চাকমার বাড়িতে তিন সপ্তাহ রাখা হয়েছে। পরে অবশ্য শেখলের বাঁধা খুলে দেয়া হয়। এর মধ্যে অস্ত্রের মুখে জোরপূর্বক ডিভোর্স লেটারে আমার স্বাক্ষর নেয়া হয় এবং অন্যের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার জন্য ঠিকঠাক করা হয়।

সর্বশেষ জীবনবাজি রেখে আনন্দ মণি চাকমার বাড়ি থেকে ১৬ জানুয়ারি গভীর রাতে পালিয়ে এসে কুতুকছড়ি সেনাক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছি। পরদিন নানিয়ারচর থানায় পুলিশের নিরাপত্তা হেফাজতে পাঠান সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

১৮ জানুয়ারি রাঙামাটি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির করে আমার ইচ্ছাতে স্বামীর কাছে হস্তান্তর করেন আদালত। তাকে বাঁচাতে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়ায় আদালত, সেনাবাহিনী ও পুলিশের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন জোসনা চাকমা।
সংবাদ সম্মেলনে অপু চন্দ্র সিংহ ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখ করে বলেন, সেনাবাহিনী ও পুলিশ সহায়তা না করলে আমার স্ত্রী জীবিত ফিরে আসার কোনো সুযোগ ছিল না। তিনি ঘটনার জন্য তীব্র নিন্দ ও প্রতিবাদ জানিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.