হিমছড়ি জাতীয় উদ্যানে বন্যহাতি দুটি বাচ্চা দিয়েছে

মোঃ নেজাম উদ্দিন,
কক্সবাজারের হিমছড়ির জাতীয় উদ্যানে দুটি বন্য হাতির বাচ্চা জন্ম দিয়েছে। চুনতি অভয় আরন্যের বাইরে প্রথম কোন জাতীয় উদ্যানে হাতির বাচ্চা জন্ম হয়।উখিয়া টেকনাফের হাতি গুলো হিমছড়ির জাতীয় উদ্যানে আশ্রয় নিলে সেখানে দুটি বাচ্চা জন্ম দিয়েছে বলে বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে। এতোদিন এশিয়ান হাতির প্রজনন ক্ষেত্র হিসাবে পরিচিত ছিল চট্রগ্রামের চুনতি বন্যপ্রাণী অভয় আরণ্যকে । রোহিঙ্গা ও বনখেকোদের কারণে বন কম হলে চুনতি অভয় আরণ্যে হাতি যাওয়া পথ বন্ধ হয়ে গেলে হাতির একটি পাল হিমছড়ি জাতীয় উদ্যানে আটকে পড়ে। সেই হাতির পাল গত কয়েকমাস আগে বাচ্চা দিয়েছে বলে জানান হিমছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুজ্জামান। এদিকে উখিয়া টেকনাফের বন রোহিঙ্গাদের কারণে ধ্বংস হয়ে গেলে অনেক হাতির পাল দিক হারিয়ে লোকালয়ে ডুকে পড়ে আর তাতে বিদ্যুৎস্পর্শ হয়ে অনেক হাতি মারা পড়েছে কক্সবাজারে । এমন মুহুর্তে হাতির দুটি বাচ্চা জন্ম হওয়া হিমছড়ির জাতীয় উদ্যানকে হাতির অভয় আরণ্য বলা চলে বলে মনে করছে অনেক পরিবেশবাদীরা।
হিমছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুজ্জামান জানান, এই কয়েক মাসের মধ্যে হিমছড়ি জাতীয় উদ্যানে আমি হাতির বাচ্চা দেখেছি। যাদের বয়স হবে ২ থেকে ৩ মাস এবং আরেকটির বয়স হবে ৬ মাসের মতো। এটি আমাদের জন্য আনন্দের খরব।কারণ আমরা রাতদিন পরিশ্রম করে এই হাতির পাল সংরক্ষণ কাজে নিয়োজিত আছি।

বনবিভাগ সূত্রে জানান, হাতি সংরক্ষণে নানান ধরণের পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়েছে । হাতির খাদ্য ও পানির কোন অভাব যেন না হয় সেদিকে কাজ করে যাচ্ছে । একটি হাতির খাবার ও পানি দেড়শ থেকে দুইশত লিটার প্রয়োজন পড়ে। আর তা এখন হাতিগুলো হিমছড়ি বন থেকে পাচ্ছে বিধায় আমাদের অতিরিক্ত কোন খাবার দিতে হচ্ছেনা । যার কারণে হিমছড়ি জাতীয় উদ্যানে থাকা হাতির পালগুলো লোকালয়ে আসার প্রয়োজন পড়ছে না।
কামরুজ্জামান জানান, হাতিগুলো চলাচলের জন্য যেসব করিডোর রয়েছে তা এখন বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজের কারণে তা বন্ধ হয়ে গেছে যার কারণে এই হাতির পাল চট্রগ্রাম অথবা বান্দরবানের দিকে যেতে পারছে না বলে এখানে অবস্থান নিয়েছে।
এদিকে কক্সবাজার বনবিভাগের উত্তর ও দক্ষিণ এর বিভাগীয় দপ্তরগুলো অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে প্রতিনিয়ত অভিযান পারচালনা করলেও কোন অদৃশ্যবলে আবারো তারা দখলে চলে আসে। আর তাতে হাতির চলাচল বিঘ্ন হচ্ছে বলে মনে করছে বিশ্লেষকগণ। এদিকে হাতির আবাসস্থল দিন দিন সংকুচিত বা দখলে চলে যাওয়ার কারনে বন্য হাতির প্রাকৃতি আবাসস্থল দিন দিন কমতে শুরু করেছে ফলে হাতিগুলো লোকালয়ে আসে ক্ষয়ক্ষতি করছে দেশের অনেক জেলায় । দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়। ন্যাড়া হচ্ছে পাহাড়। জলাধার সংকুচিত, ফলে বনের বৃহৎ প্রাণী হাতির চলাচলের পথ হারিয়ে গেছে। বাসস্থানের সংকট দেখা দিয়েছে। সেসঙ্গে নেই প্রজনন ভূমি। ফলে বড় ধরনের বিপদে পড়েছে হাতি। ঝুঁকি বেড়েছে মানুষেরও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাতিকে উন্নয়নের সাথী করতে হবে। তার বসতি ও বিচরণ এলাকা রক্ষায় উদ্যোগী হতে হবে। না হলে দেশে কোনো রকমে টিকে থাকা হাতি আরও বিপন্ন হয়ে পড়বে। এমন সময় হাতির বাচ্চা দেওয়াকে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন অনেকেই ।

অন্যদিকে সংশ্নিষ্টরা জানান, প্রাকৃতিক খাবার সংকট, আবাসস্থলে মানুষের বসবাস বেড়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ, প্রাকৃতিক ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ায় বন্যহাতিকে খাবার ও পানির সন্ধানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হচ্ছে। এতে প্রতিনিয়ত হাতি ও মানুষ মুখোমুখি হচ্ছে। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। গত বছর ২৮আগষ্ট কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাসিয়াখালী রেঞ্জ এর মানিকপুর বিটে ১৮ থেকে ২০টি হাতি লোকালয়ে চলে আসে। ধারনা করা হচ্ছে খাবারের সন্ধানে হাতিগুলো লোকালয়ে ডুকে পড়ে।এদিকে চট্রগ্রামের দক্ষিনের জেলা কক্সবাজারে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা আসার কারনে কক্সবাজারের দক্ষিণ বনবিভাগের অধিনে থাকা প্রায় ৬ হাজার একর সংরক্ষিত বন উজাড় করে ফেলে রোহিঙ্গারা । ফলে হাতির আবাসস্থল না থাকায় তারা অনেকসময় দলবেধে লোকালয়ে হামলা করে খাবারের সন্ধানে। তবে জেলার বিভিন্নস্থানে ঘুরে দেখা গেছে জবরদখল করে লেবু বাগান ও মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে পড়েছে প্রভাবশালী মহল। বনবিভাগের জমি দখল করে পাহাড় ন্যাড়া করে তারা সেখানে লেবু বাগান করছে যার ফলে হাতির থাকার স্থান এখন না থাকার কারনে তারা লোকালয়ে এসে হামলা করছে।
এদিকে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন ও বন বিভাগের তথ্য মতে, গত ১৮ বছরে দেশে মানুষের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে ৯০টি হাতি। করোনাকালেও ১২টি হাতি হত্যা করা হয়েছে। আর ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত হাতির আক্রমণে মানুষ মারা গেছে ৪০ জন।
গত কবছরের মধ্যে চারটি হাতির একটি বার্ধক্যজনিত কারণে এবং তিনটি রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। তা হলো খুটাখালীতে ১টি, জোয়ারিয়ানালাতে ১টি, ঈদগাওতে ১টি, ও পানেরছড়ায় ১টি। তিনি আরো জানান, হাতির প্রাকৃতিক আবাসস্থল তৈরি করার জন্য সম্প্রতি ফাসিয়াখালীতে ১শত হেক্টর ও মেধা কচ্ছপিয়াতে ২০ হেক্টর স্থায়ী বনায়ন করা হয়েছে। আর হাতির সুবিধার জন্য ওযাটার হোম করাি হয়েছে যেন পানি পেতে সমস্যা না হয়। আমরা বনকর্মীরা সবসময় বনরক্ষায় কাজ করঠি আশা করছি সকলের সহযোগিতা পাবো।
গবেষণায় ৯টি বিভাগীয় বন অফিসের আওতায় হাতি চলাচলের ১১টি রুট চিহ্নিত করা হয়েছিল, যার মোট দৈর্ঘ্য ১৫১৮ কিলোমিটার। কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে হাতির বিচরণের পথ দ্রুত কমে আসছে। গত ছয় বছরে বন্ধ হয়ে গেছে হাতি চলাচলের তিনটি করিডোর। এসব কারণে নিয়মিত চলাচলের পথ ব্যবহার করতে পারছে না হাতি। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে পাহাড়ি বনাঞ্চলে ছিল বেশ কিছু হাতি চলাচলের করিডোর। কিন্তু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে নষ্ট হয় এগুলো। কক্সবাজারে গত তিন বছরে প্রাণ গেছে সাতটি বন্যহাতির।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন সময় হাতির বাচ্চা দেওয়া মানে এখনো হাতির অভয় আরন্য রয়েছে । আমাদেও তা রক্ষ করতে হবে। অন্যদিকে ভারত ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে হাতি চলাচলের জন্য যে দুটি পথ রয়েছে তার মধ্যে নাইক্ষ্যংছড়ি হয়ে চকরিয়া পর্যন্ত পথটি অন্যতম। কিন্তু হাতি চলাচলের শতবর্ষ প্রাচীন এই পথের ওপর গত কয়েক বছরে শত শত রাবার বাগান, লোকালয়, বাণিজ্যিক বন বাগান গড়ে ওঠায় প্রতি বছরই নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দোছড়ি, জারুল্যাছড়ি, লেম্বুবছড়িসহ আশপাশের এলাকায় হাতির আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটিকে হাতির জন্য আরেকটি বড় বিপদ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। রেলপথটি গেছে বন্যহাতির অন্যতম তিন বিচরণক্ষেত্র চুনতি ও ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে। এই প্রকল্পে পড়েছে হাতি পারাপারের অন্তত ২১টি পথ।
কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ সরওয়ার আলম জানান, হাতি বাচ্চা দেয় ২২ মাস পরপর। আমাদেও জন্য এটি খুশির সংবাদ যে হিমছড়ি জাতীয় উদ্যানে একুিট হাতির পাল সম্প্রতি বাচ্চা দিয়েছে । এবং সেখানে কোন ধরনের খাবার সংকট হচ্ছেনা এখনো। বাচ্চা দেওয়ার অর্থ হচ্ছে এখনো হিমছড়িতে হাতির পাল থাকার মতো একটি জায়গা রয়েছে । আমরা চ্ষ্টো করছি এই জাতীয় উদ্যানকে হাতির অভয় আরণ্য করে এটি যেন প্রাকৃতিভাকে হাতি প্রজনন কেন্দ্র হয়ে উঠে। সেক্ষেত্রে স্থানীয় সকলের সহযোগিতা দরকার বলে আমি মনে করছি।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.