জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, ভোগান্তি বাড়বে সাধারণ মানুষের

ডেস্ক নিউজ
জ্বালানির বাড়তি দাম মূল্যস্ফীতি উসকে দেওয়ার শঙ্কা তৈরি করছে। দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বেড়ে গেছে এলপিজি সিলিন্ডার ও অটোগ্যাসের দাম। এতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে কতটা আগুন লাগে সেটিই এখন দেখার বিষয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বিকল্প চিন্তা করতে পারতো বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, দাম যখন বাড়ানোই হয়েছে সেক্ষেত্রে জনগণকে কীভাবে স্বস্তি দেওয়া যায় সেই বিষয়টিও এখন বিবেচনা করা উচিত।

মোটাদাগে বিবেচনা করলে এখন যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন উভয় ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে। যেহেতু পরিবহন ব্যয় বাড়বে, সঙ্গত কারণে পণ্যের দামে এর প্রভাব পড়বে। মানুষকে আগের চেয়ে বেশি দামে সব ধরনের পণ্য কিনতে হবে। এছাড়া দেশে সেচ মৌসুমের আগে ডিজেলের দাম বৃদ্ধি করায় কৃষির খরচ বাড়বে। কৃষিতে খরচ বাড়লে স্বাভাবিকভাবে ধানের দামও বাড়বে। যদি ধানের দাম না বাড়ে তাহলে উল্টো কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে এলপিজির দাম বাড়াতে রান্নার খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি হোটেল রেস্টুরেন্টে খাবারের দাম বাড়বে। কারণ, দেশের একটি বড় অংশ এখন এলপিজি ব্যবহার করে। দেশের প্রায় সব এলাকায় এখন পরিবহনে এলপিজির ব্যবহার বাড়ছে। বিশেষ করে ছোট যানবাহন অটোগ্যাস ব্যবহার করছে। ফলে একেবারে প্রান্তিক মানুষের পরিবহন ব্যয়ও বাড়বে। যা নিয়ন্ত্রণে রাখাই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে।

গতকাল বুধবার (৩ নভেম্বর) রাতে হঠাৎ করেই জ্বালানি বিভাগের পক্ষ থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধি করা হয়। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আজ বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) বিইআরসি এলপিজির নভেম্বরের দাম ঘোষণা দেয়। তাতে বেসরকারি এলপিজির ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ৫৪ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে বেড়েছে পরিবহনে ব্যবহৃত অটোগ্যাসের দামও। প্রতি লিটারে আড়াই টাকা বাড়িয়েছে কমিশন। এমন এক পরিস্থিতিতে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি ) দামও বিশ্ববাজারে বাড়ছে। সরকার সেখানেও লোকসান দিচ্ছে বলে আবাসিকসহ সব ধরনের গ্রাহকের গ্যাসের দাম বাড়ানোর আলোচনাও শুরু হয়েছে। এদিকে তেল ও গ্যাসের দাম বাড়লে লোকসানের দোহাই দিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য দ্রুত প্রস্তাব দিতে পারে বিতরণ কোম্পানিগুলোও।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমদানি নির্ভর হলে এমন পরিস্থিতি হতেই পারে। তবে সরকারের উচিত ছিল আরও কিছু দিন দেখা। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দাম না বাড়িয়ে কিছু দিন দেখে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি নির্ভর দেশগুলো সত্যিই বিপদে পড়েছে। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা বললে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়বে। এমনিতেই করোনার কারণে বিনিয়োগ প্রায় স্থবির ছিল। মূল্যস্ফীতি বাড়বে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ অবস্থার দিকে যেতে পারে।

তামিম বলেন, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চিন্তা হচ্ছে, একটা জিনিসের দাম আগেই অনেক বেশি বাড়িয়ে রেখেছে ব্যবসায়ীরা। সেটা কিনতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এখন তেল ও এলপিজির অজুহাতে আরও দ্বিগুণ দাম বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা হতে পারে। অনানুপাতিক হারে যে মূল্যবৃদ্ধি করে সেটি সরকারকে রোধ করতেই হবে। না হলে ভোগান্তি আরও বেশি হবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখন বিশ্ববাজারে যেহেতু জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে এবং সরকার যেহেতু এটি আমদানি করে এবং গ্রাহক পর্যায়ে যেহেতু এটি বিক্রি হয়, সুতরাং এই পরিস্থিতিতে বিপিসিকে একটি বড় লোকসানে পড়তে হচ্ছে। আমরা চাইছিলাম, এই লোকসান পোষাতে সরকার ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে দিক, যাতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ না পড়ে। কারণ, ভোক্তার এখন আয়ের যে পরিস্থিতি সেই বিবেচনায় বাড়তি এই ব্যয় নেওয়ার মতো সক্ষমতা অনেকেরই নেই। সরকারকে এখনই এই মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বর্ধিত আকারে ওএমএস কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। আমদানি বাড়াতে হচ্ছে। এখন জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, এরপর এলপিজির দাম বৃদ্ধির এই প্রেক্ষাপট এক ধরনের অজনপ্রিয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে করি।

তিনি বলেন, এর ফলে মূল্যস্ফীতিতে সরাসরি বড় প্রভাব আমরা দেখতে পাবো। সরাসরি পরিবহন ব্যয় বাড়বে। পণ্য পরিবহন ব্যয় বাড়বে। বাড়তি ব্যয়ে পরিবহন করা পণ্যের দামও বাড়বে। সাধারণ মানুষ যেসব পণ্য কিনে সেখানে এর প্রভাব পড়বে। এমনকি আমদানি করা পণ্যের দামেও এর প্রভাব পড়বে।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ডিজেলের দাম বাড়ায় সেচের ওপর প্রভাব পড়বে। কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। আমরা ধারণা করছি এটি সাময়িক। বেশি দিন এই পরিস্থিতি থাকবে না। সাময়িকভাবে সরকার এই চাপ নিতে পারতো। শহরাঞ্চলের অপ্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় কাজ করেন সেখানে এর প্রভাব অনেক বেশি পড়বে।

এমন পরিস্থিতি কীভাবে সরকার সামাল দেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে সরকারকে আসলে একটি প্যাকেজ দিতে হতে পারে। যাতে সাধারণ মানুষকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে অথবা ওএমএস কার্যক্রম আরও বাড়িয়ে, কম মূল্যে পণ্য সরবরাহ করে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো করতে পারে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে মূল্য বাড়ানো কমানোর ক্ষেত্রে সরকারের দুর্বলতা রয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেউ মানে না। বাড়তি দামের সঙ্গে মিলে আরও বাড়তি চাপ তৈরি হয় সাধারণ মানুষের ওপর।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.