ডেস্ক নিউজ:
আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ছে ক্রমশ। এর প্রভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও বেড়েছে সয়াবিনসহ সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম। গত বছরের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম ছিল ৭০০ ডলার। চলতি এপ্রিলে এসে সেই অপরিশোধিত সয়াবিনের টন দাঁড়িয়েছে ১৪শ’ ৫০ ডলারে। এমন পরিস্থিতিতে দেশীয় বাজারে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে সয়াবিন তেলের দাম। সরকারের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দর নির্ধারণ করে দিলেও তা বাজারে গিয়ে টিকছে না। এমনটা চলতে থাকলে কোথায় গিয়ে যে দাঁড়াবে সয়াবিন তেলের দাম তা বলা মুশকিল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে বাংলাদেশের ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী মিলগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন আবারও প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৩ টাকা বাড়ানোর সুপারিশ করে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের কাছে আবেদন করেছে। ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ব্যবসায়ীদের সুপারিশের আবেদনপত্রটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে, কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এখনও এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি।
সরকারের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বাজারে এখন প্রতিকেজি খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা দরে। যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ১৩৫ থেকে ১৪৫ টাকা। এছাড়া বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতিলিটার বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকা থেকে ১৪০ টাকা। কোম্পানিভেদে পাঁচ লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৬৬০ টাকা।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও বাণিজ্য সচিব জাফর উদ্দিনের নেতৃত্বে করা পর্যবেক্ষণে ব্যবহার্য বিভিন্ন নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পাশাপাশি এসব পণ্যের বাজারে মোটামুটি স্থিতিশীল থাকলেও ভোজ্যতেলের দাম খানিকটা বেড়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অনুবিভাগের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল কর্তৃক নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায়, বিগত এক বছরে বিশেষ করে রমজান মাসে ভোজ্যতেলের বাজার দর এ সময় বেশ খানিকটা বেড়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ভোজ্যতেলের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। জুন, ২০২০-এর পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেহেতু, ভোজ্যতেল একটি আমদানিনির্ভর পণ্য, সেহেতু ভোজ্যতেলের বাজার দর মূলত নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজার দরের ওঠানামার ওপর। ভোজ্যতেলের মোট চাহিদার ৯৫ ভাগেরও বেশি আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। তাই সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় বাজারেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। তবে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম যেভাবে বেড়েছে, স্থানীয় বাজারে সেই পরিমাণে বাড়েনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, গত এক বছরের আন্তর্জাতিক বাজার দর পর্যালোচনায় দেখা যায়, এক বছর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম যেখানে কেজি প্রতি ৫২ দশমিক ১১ টাকা ছিল, বর্তমানে তার মূল্য ১৩৫ দশমিক ৮৪ টাকা। অর্থাৎ এই সময়ে সয়াবিন তেলের আন্তর্জাতিক মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৬০ শতাংশ। একই সময়ে স্থানীয় বাজার দর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এক বছর আগে খোলা সয়াবিন তেলের বাজার দর ছিল ৮৮ থেকে ৯৩ টাকা, কিন্তু বর্তমানে তা ১২০ থেকে ১২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রয় হচ্ছে। অর্থাৎ এই সময়ে স্থানীয় বা দেশীয় বাজারে মূল্য বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৩৫ শতাংশ।
স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজার দর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে ১৬০ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, একই সময়ে দেশীয় বাজারে এই মূল্য বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৩৫ শতাংশ। পাশাপাশি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিং টিম সার্বক্ষণিক বাজার মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং পর্যালোচনার ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক বাজার দর যে পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, স্থানীয় বাজার দর সেই তুলনায় অনেক কম বৃদ্ধি পেয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের পারস্পরিক সহযোগিতামূলক মনোভাবের কারণে বাজার দর এতটা কম রাখা সম্ভব হয়েছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতি জটিলতার মধ্যেও বিশ্বে সয়াবিন তেলের উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে বেড়েছে দাম। বিশ্লেষকরা বলছেন, উৎপাদক দেশগুলো রফতানি বাড়িয়েছে, একই সঙ্গে ডলারের বিপরীতে সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মুদ্রা ডলারের তুলনায় শক্তিশালী হওয়ায় নাকি তেলের দাম বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী সয়াবিন তেলের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৮০ লাখ টন। ২০২০ সালে এসে সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী বিভিন্ন দেশে সয়াবিন উৎপাদিত হয়েছে ৬ কোটি ১০ লাখ টন। উৎপাদনকারী দেশগুলো সয়াবিনের রফতানি শুল্ক বাড়ানোর কারণেই আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম বেড়েছে। করোনার কারণে সয়াবিন তেলের উপজাত পণ্য সয়ামিলের (সয়াবিন থেকে তৈরি খাবার) চাহিদা কমে যাওয়ার কারণেও বেড়েছে সয়াবিন তেলের দাম।
উল্লেখ্য, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সয়াবিন তেল উৎপাদন করে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল। ২০১৯ সালে চীন ১ কোটি ৮০ লাখ টন ও যুক্তরাষ্ট্র ৮০ লাখ টন সয়াবিন তেল উৎপাদন করে, যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের প্রায় ৪৫ শতাংশ। বাকিটা উৎপাদন করে ব্রাজিল। মার্কিন বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনডেক্সবক্সের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর থেকেই সয়াবিন থেকে তৈরি প্রাকৃতিক জ্বালানি বায়োডিজেলের উৎপাদন কমে গেছে। এতে বেড়েছে সয়াবিন তেলের উৎপাদন।
জানা গেছে, উৎপাদনকারী দেশগুলোর চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বে উৎপাদিত সয়াবিন তেলের মাত্র ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ বা ১ কোটি ২৬ লাখ টন তেল আসে আন্তর্জাতিক বাজারে। বিশ্বে সয়াবিন তেল আমদানিকারক দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। সবচেয়ে বেশি তেল আমদানি করে ভারত। এরপরই আছে আলজেরিয়া। এ বছর চীনও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সয়াবিন তেল কিনছে।
সয়াবিন তেলের মূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ী সয়াবিন তেলের দাম আগের যেকোনও সময়ের তুলনায় বেশি। ফলে দেশি বাজারেও এর প্রভাব পড়ছে। তবে আগামীতে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি যদি হয় তাহলে আমরাও এর সুফল পাবো।
এদিকে ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে বর্তমান দামে সয়াবিন তেল বিক্রি করা সম্ভব নয়। তাই আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি, যাতে বিদ্যমান দর পুনর্নির্ধারণ করে। তিনি জানান, গত এক বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। ৭০০ ডলারের সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৪শ’ ৫০ ডলারে। দেশীয় বাজারে কিন্তু সেই হারে দাম বাড়েনি।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.