সাজানো উঠোনে নতুন বই
ছাপাখানা আর বই আবিষ্কার সভ্যতার এক বিরাট ঘটনা। একটি ভালো বই একটি প্রজন্মকে পাল্টে দিতে পারে। বই মানুষকে সব সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে এক প্রসন্ন পর্বে পৌঁছে দিতে কাজ করে নিরন্তর। পাঠাগারকে বলা যেতে পারে সমাজের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ। পাঠাগারে বসে যারা এমনকি রাজনীতির আলাপও করেন, তাদের দৃষ্টি থাকে সবসময় কল্যাণের পথে, সংস্কৃতির আলোর পথে। বই ছাড়া জীবন মানে মৃতের মতো বেঁচে থাকা। জ্ঞানের সবচেয়ে উঁচু স্তর হলো লাইব্রেরি। বইয়ের ভুবনে ডুবে থাকা মানুষ খুব সহজেই মানসিক বিপন্নতাকে জয় করতে পারে। বই তাই আমাদের মৌলিক চাহিদার অনন্য এক উপাদান হয়ে উঠেছে দিন দিন। মানবিক চেতনার উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে কেবল বই। সভ্য জগতে বই ছাড়া একদিনও কি বেঁচে থাকা সম্ভব? দেখা, পড়া, বলা আর শোনাÑ এই চারে তৈরি হয় শিক্ষার প্রাথমিক ধাপ। যে বই পড়ার অভ্যাস করেছে, তার পক্ষে এই প্রাথমিক ধাপে দাঁড়িয়ে দুঃখকে জয় করা সহজ। প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষ মূলত একেকটি চলন্ত লাইব্রেরি। বইকে আমরা খুব সহজেই করে তুলতে পারি আমাদের প্রতিদিনের গৃহসামগ্রী। আদর্শ বাড়ি বলতে এমন এক বাসস্থানকে বোঝায়, যেখানে একটি পড়ার ঘর আছে। আর প্রতিটি বাড়িতে লাইব্রেরি গড়ে তোলার আন্দোলন হতে পারে যেকোনো সমাজ-রূপান্তরের বিরাট মুভমেন্ট। সকালে ঘুম থেকে উঠে বই পড়তে পারি আমরা, আবার রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পড়তে পারি পছন্দের কোনো বই। অফিস-আদালতে, ড্রয়িংরুমে, রেস্তোরাঁয় টেবিলে টেবিলে অন্তত একটি বই রাখা যায়। ভ্রমণকালে সাথে নেয়া যায় কিছু বই। কেউ হয়তো কোনো লেখককে অপছন্দ করতে পারেন, কিন্তু বইকে নয়। আর এ কথাও ঠিক, প্রচুর বাজে বইয়ের চেয়ে একটি ভালো বই উত্তম।
১ ফেব্রুয়ারি শুরু হতে যাচ্ছে মাসব্যাপী বইমেলা। আর শুধু বইমেলা বলি কেন একে। সারা দেশের এমনকি প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রতীক্ষার মিলনমেলা এটি। এর মূলে আছে একুশের চেতনা; ভাষার প্রতি বাঙালির অসীম প্রত্যয় ও জেগে থাকার প্রেরণা। লেখালেখি, দেশপ্রীতি, ভাষাপ্রীতি, সাহিত্যচিন্তা, সমালোচনা, প্রচারণা, বেচাকেনা তো আছেই। আছে এই মেলাকে ঘিরে সাংস্কৃতিক আয়োজন, লিটলম্যাগ মুভমেন্ট, আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া, গল্পগুজব, দেখা-সাক্ষাৎ। সব মিলিয়ে এ সত্যিই এক অনন্য প্রাণের মেলা।
প্রতি বছর মেলায় আবির্ভাব ঘটে নতুন লেখকের। কোনো কোনো বছর নতুন নতুন বই নিয়ে হাজির হয় নতুন নতুন প্রকাশনা সংস্থা। নতুন দর্শনার্থী কিংবা নতুন ক্রেতার সমাগমও কম হয় না। একদিকে পুরনোদের আসা-যাওয়া, লেখা ও ছাপার, কেনা ও উপহারের আর অটোগ্রাফের পুনরাবৃত্তি, অন্য দিকে নতুনদের বিস্ময়ভরা চোখ ও মন। আলোচনার মঞ্চে নতুন নতুন বিষয়ের ওপর আলোকপাত ও পর্যালোচনা, শিশু-প্রহরে শিশু-কিশোর ও অভিভাবকদের আনাগোনা ও উন্মাদনা, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বিচিত্রমুখী প্রদর্শনী। টেলিভিশনে মাঝে মধ্যে সরাসরি সম্প্রচার, পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ।Ñ এই হলো বইমেলা। এই প্রাণের মেলায় আনন্দের সাথেই মিশে আছে প্রবল বাণিজ্য। বাংলা একাডেমি এবং বাংলা বাজারের প্রায় সব প্রকাশনা সংস্থা এ সময় বছরের সেরা ব্যবসা করে ফেলেন। সারা বছরের টুকটাক খুচরা বিক্রি কিংবা সাপ্লাইয়ের জন্য ধরাধরি করার ওপর নির্ভর করে তাদের। বিশেষ করে বাংলাবাজারের প্রকাশকদের, ব্যবসা ও সংসার খুব একটা চলে না। এই মেলায় তারা প্রচুর পুঁজিও বিনিয়োগ করেন। তাই লাভের আশার পাশাপাশি ঝুঁকির চিন্তাও একেবারে পিছ ছাড়ে না।
মাসব্যাপী মেলা হলেও প্রথম সপ্তাহ কাটে স্টল-প্যাভিলিয়ন সাজানো-গোছানোর কাছে। মূলত মেলা জমতে থাকে দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষ দিকে। এর মধ্যে অবশ্য শুক্রবার ও শনিবার ছুটির দিনে পরিবার-পরিজন নিয়ে দর্শনার্থী ও ক্রেতারা আসেন মেলায়। ভ্যালেন্টাইন ডে থেকে শুরু করে একুশে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেলায় থাকে প্রচুর ভিড়। আর প্রকাশকরাও টার্গেট করেন ওই ১৪ থেকে ২১ তারিখ। নতুন বইও বেশি ঢোকে ওই সময়। মাসের শেষে মেলায় আবার ভাটা পড়ে। তখন কেবল ভরসা থাকে ছুটির দিন, আর কিছু সিরিয়াস পাঠকের ওপর। কেউ কেউ দরকারি বইটি কিনে নিতে আসেন শেষের দিকে। অনেক বই যেহেতু শেষ সপ্তাহে প্রবেশ করে মেলায়, তাই সিরিয়াস পাঠকরা শেষবেলায় নিজের ঝুলিতে তুলে নেন আরো কিছু বই। কোনো কোনো পাঠকের দৃষ্টি থাকে সারা বছরের পড়ার উপযোগী বই সংগ্রহের দিকে। এক জায়গায় সব প্রকাশককে পাওয়া যায় বলে ঘুরে ঘুরে প্রয়োজনীয় বই কিনে নেন তারা। শেষপ্রহরে বিদায়ের সুর বাজে আরেকটি অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রতীক্ষায়। প্রহর গুণতে থাকেন পাঠক-লেখক-প্রকাশক-শিল্পী-আয়োজক-প্রকাশনাশ্রমিক-দর্শনার্থী-ব্যবসায়ী সবাই।
বইয়ের দোকান আর বইমেলার সম্পর্ক উদ্যান আর বাগানের সম্পর্কের মতো। ব্যাপারটা যতœআত্তির। বেশি খাতির আর কম খাতিরের। এক মাসে বইমেলা যে আদর-কাভারেজ পায়, সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বুকশপগুলো সে তুলনায় কারো নজর কাড়তে পারে না। না পাঠকের, না মিডিয়ার। বইয়ের বাজার নীলক্ষেত কিংবা সবচেয়ে বড় কারখানা ও আড়ৎ-চত্বর বাংলাবাজার অথবা দেশের ঐতিহ্যবাহী কোনো বইয়ের দোকানে কয়দিন টেলিভিশনের ক্যামেরা গিয়েছে, তা অনুসন্ধান করলে নিশ্চয় জানা যাবে। খোদ এই অমর একুশে বইমেলাকে ঘিরে প্রকাশনাশ্রমিকদের মধ্যে যে আনন্দ-আয়োজন বাংলাবাজারে, যেখান থেকে বই তৈরি হয়ে প্রতিদিন মেলায় ঢোকে, পর্দার পেছনের সেই কারিগরদের কী খবর রেখেছি আমরা? কোনো টেলিভিশনে বা রেডিওতে বা দৈনিক পত্রিকায় বই বানানোর কারিগরদের কোনো ইন্টারভিউ হয়তো চোখেও পড়বে না আমাদের। লেখক-সম্পাদক, প্রকাশকদের অবশ্য আমরা দেখতে পাই সরব ভূমিকায় এখানে-ওখানে। কিন্তু এই শিল্পে যে আরো কত রকমের মানুষের সরাসরি অংশগ্রহণ আছে, সে খবর অনেকেরই অজানা। আমরা প্রজন্মকে জানানোর জন্য একটা স্টলও রাখিনিÑ যেখান থেকে আগ্রহীরা জানতে পারেন বই ছাপার ধাপ ও কৌশলগুলো। আর বই বিপণনের সাথে যারা জড়িত?Ñ দোকানদার, তাদের কাছ থেকে তো আমরা জানতে পারি পাঠকের প্রতিক্রিয়া এবং চাহিদা। শুধু বই ছেপে মেলায় বা দোকানে পাঠালেই তা বিক্রি হবেÑ এমনটা ভেবে বসে আছি আমরা। সে কারণেই দেখা যায়, অনেক নতুন বই মেলার বাইরে এক কপিও বিক্রি হয় না। কিংবা কিছু পুশ সেল হয় বটে। কিন্তু যদি আমরা বাজারের চাহিদাটা জানতে পারি এবং সে অনুযায়ী বই লিখি ও ছাপি, তাহলে বিক্রি বাড়বে। পাঠকও পাবে প্রত্যাশিত বই। লেখকদের সাথে প্রকাশক এবং ডিস্টিবিউটররা সেভাবে কনট্রাক্টও করতে পারে। অবশ্য সবসময় লেখকরা পাঠকের প্রয়োজন মতো লিখবেন, তাও নয়। লেখক তার নিজস্বতা আর সৃজনশীলতা অবশ্যই প্রকাশ করবে। কিন্তু কোনো না কোনো সময় তাকে পাঠকের রুচির কাছে যেতে হয়। আর এর জন্য প্রয়োজন পাঠভ্রমণ ও জনসম্পৃক্তি। আমাদের দেশের লেখকেরা সেদিক থেকে বেশ পিছিয়ে। আর মেলার আয়োজকরাও যে এই বিষয়ে খুব ওয়াকিবহাল, তেমনটা মনে হয় না। ফলে প্রতিবছর একুশের বইমেলাকে কেন্দ্র করে যত মলাট বাঁধা পড়ে, তার বেশির ভাগই কাগজের ‘আবর্জনা’য় পরিণত হয় বছর না ঘুরতেই। পুনরায় বইমেলা আসার আগেই অনেক বই যাত্রা করে কালের অতলের গহীন পথে।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের এই বইমেলার একটা আকর্ষণীয় দিক হলোÑ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক এর উদ্বোধন ঘোষণা এবং এ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন। দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তি, লেখক-শিল্পী-প্রকাশক এবং মেলাকে কেন্দ্র করে প্রবাস থেকে আগত বাঙালি সাহিত্যিকরা থাকেন আমন্ত্রিত অতিথি। সব মিলিয়ে আয়োজন-উৎসবের তেমন কোনো ঘাটতি থাকে না। কিন্তু বড় কষ্টের কথা হলোÑ মেলা আয়োজনের ব্যাপারে যত বেশি আন্তরিক বাংলা একাডেমি ও অন্যান্য সহযোগী সংস্থা, গ্রন্থের মান-বিচার, ভাষা ও বিষয় সম্পাদনা, লেখকের অধিকার এবং প্রকাশিত বইয়ের রয়্যালিটির বিষয়ে আয়োজক-ব্যবস্থাপনা সংস্থা তত বেশি আন্তরিক নয়। মিডিয়াও এ দিকে তেমন একটা নজর দেয় বলে মনে হয় না। ফলে বাংলাদেশে লেখক-প্রকাশকের সম্পর্কটা এখনো অনেকটাই তেতো। এই পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে বই, প্রকাশনা এবং সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যের জন্যও কোনো ভালো খবর নয়।
এত কিছুর পরও সাজানো উঠোনে নতুন বইয়ের পসরার জন্য আমাদের প্রতীক্ষা আর আনন্দের এক তিলও কমতি নেই যেন। কবে আসবে ভাষার মাসের সেই প্রথম প্রহর! কবে পাবো নতুন বইয়ের কাঁচা গন্ধ! বটতলায় মোড়ক খোলার খসখস আওয়াজ, হাততালি ও বক্তৃতা, রাস্তার পাশে রকমারি পণ্যের বিকিকিনি, প্রিয় কোনো বন্ধুর জন্য প্রবল প্রতীক্ষা, ফুচকা-চটপটি খাওয়ার তুমুল বায়না, নতুন বইয়ের ব্যাগ হাতে নিয়ে কিংবা বগলদাবা করে টিএসসি বা দোয়েল চত্বরের পথে যেতে যেতে সেলফি তোলা, খুনসুটি, পোস্ট-শেয়ার-কমেন্টস দেয়ার সময় বুঝি হয়ে এলো। চারিদিকে যেন বেজে উঠেছে বইমেলার আগমনী গান।
তোমাকে অভিবাদন, হে অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.