সুত্র মতে, শহরের সৌন্দর্য বর্ধন ও যানজট নিরসনের এবং পরিকল্পিত নগরায়নের অংশ হিসেবে কক্সবাজার শহরের ‘হলিডের মোড়-বাজারঘাটা হয়ে লারপাড়া বাসস্ট্যান্ড’ পর্যন্ত প্রধান সড়কটির কাজ চলছে।
২৯৪ কোটি ১৪ লাখ ৮৪ হাজার টাকায় এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)।
গত বছরের ১৬ জুলাই প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।
অভিযোগ উঠেছে, ধীরগতি, কউক ও পৌরসভার সমন্বয়হীনতার কারণে কাজটি প্রশ্নবিদ্ধ। ভোগান্তির শিকার হচ্ছে স্থানীয়রা। ব্যবসায়ী, হকার, সবজি বিক্রেতা ও আবাসিক হোটেল মালিকেরা সড়কের মহাযন্ত্রণায়। কাজের ধরণ দেখে উন্নয়ন কাজ পরিকল্পিত নয় মনে করছে নগরবিদরা।
যেন মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে শহরের প্রধান সড়ক ও উপ-সড়কগুলো। প্রতিদিন কোন না কোন দুর্ঘটনা ঘটছে প্রধান সড়ক ও অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে। সড়কগুলোতে উন্নয়ন কাজের নামে দীর্ঘদিন গর্ত করে রাখা হয়েছে। আর এসব গর্তযুক্ত সড়কগুলোই সাধারণ মানুষের ও যানবাহনের এবং যানবাহনের মালিকদের এমনকি যাত্রীদের গলার কাঁটা এখন। যে কারণে এসব সড়কগুলোতে প্রতিদিন ঘটছে দুর্ঘটনা।
বাজারঘাজার ব্যবসায়ীরা বলছে, কক্সবাজার পৌরসভা ও কউকের সমন্বয়হীনতার খেসারত দিচ্ছে স্থানীয়রা। প্রয়োজনীয় কোনকাজে বের হতে চাইলেও সম্ভব হচ্ছে না। মালামালের গাড়ি ঢুকানো দায়। গাড়ি ভাড়া ও যাতায়াত খরচ বেড়েছে দ্বিগুনের চেয়ে বেশি।
দেখা গেছে, শহরের প্রধান সড়কটির কোন না কোন জায়গায় পানির পাইপ স্থাপন ও সড়কের অপর পাশে ড্রেন নির্মাণ করা হচ্ছে। ড্রেনের জন্য গর্ত করে উপড়ে ফেলা মাটিগুলো রাখা হচ্ছে সড়কের অপর পাশে। আর ওই মাটির উপর দিয়ে চলতে হচ্ছে সাধারণ মানুষ এমনকি সমস্ত যানবাহনকে। উঁচু-নিচু হয়ে থাকা মাটির উপর যানবাহন চলতে গিয়ে বেশ কয়েকটি দূর্ঘটনাও ঘটেছে ইতোমধ্যে।
তারাবনিয়ারছড়ার স্থায়ী বাসিন্দা মোহাম্মদ আলম জানান, গত কয়েকদিন আগে তারাবনিয়ারছড়া এলাকায় দুটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। সড়কের অপর পাশের সরু রাস্তা দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক যাওয়ার সময় বিকট শব্দে পড়ে যায় মালবাহী একটি ট্রাক।
এসময় ট্রাকে থাকা মালামালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ট্রাকের চালক ও হেলপার জানে বেঁচে গেলেও আহত হন তারা। এর পরেরদিন আরও একটি টমটম পড়ে যায় গর্তে। ওই টমটমে থাকা সমস্ত মালপত্র এবং কয়েকজন লোক মুহূর্তেই গর্তে পড়ে যায়। এভাবে প্রতিদিনই ছোটবড় দুর্ঘটনা ঘটছে।
কক্সবাজার পৌরসভা মার্কেট আড়ৎ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ মোস্তফা দুঃখ করে বলেন, আমরা আজ অসহায় হয়ে পড়েছি। প্রধান সড়কের পাশাপাশি ভেতরের সড়ক খুঁড়ে ফেলা হয়েছে। এখন আমারা বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় কাঁচা বাজার আনতে পারছি না যার ফলে কাঁচা বাজার তরিতরকারির দাম বাড়তে পারে। বাজারে আসা অনেক মানুষ খানাখন্দকে পড়ে আহত হয়েছে৷ আমাদের প্রত্যেক ব্যবসায়ীর পণ্য পরিবহণ ব্যয় বেড়ে গেছে। আর তার প্রভাব পড়ছে দৈনন্দিন বাজার ব্যবস্থাপনায়। আমরা চাই যেকোন প্রকারে ভিতরের সড়কটি সহসা মেরামত করা হউক।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদী লাইব্রেরির স্বত্তাধিকারী মাওলানা মোঃ ওমর ফারুক বলেন, বিকল্প সড়ক না করে প্রধান সড়কের কাজ ধরার মানে কি? ক্ষতবিক্ষত সড়কের কারণে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা আসতে পারছেনা। যার ফলে আমাদের ব্যবসা এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সড়ক ব্যবস্থা ভালো না হওয়ার কারনে ক্রেতারা বেশি দাম দিয়ে অনলাইন মার্কেট থেকে বই পুস্তক কিনছে।
বড়বাজার মসজিদ কমিটির অর্থ সম্পাদক মওলানা আব্দুল গফুর বলেছেন সড়কের যন্ত্রণার কথা। তিনি বলেন, প্রধান সড়কটি উন্নয়ন হচ্ছে। আমি মনে করছি তা পরিকল্পিত নয়। যদি পরিকল্পিত হতো তবে তার আগে একটি বিকল্প সড়ক তৈরি করা প্রয়োজন ছিল৷ভিতরের সড়ক ব্যবস্থাও বেশ নাজুক। চলাচল উপযোগী নয়। মসজিদে কাদা পানি দিয়ে যেতে হচ্ছে। অবর্ণনীয় দুর্ভোগ কল্পনাও করেনি কেউ।
উন্নয়ন কাজের জন্য কউক ও পৌরসভাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন কক্সবাজার দোকান মালিক সমিতি ফেডারেশন আহবায়ক আলহাজ্ব ফরিদ আহমদ চৌধুরী।
তবে তার দুঃখ ভিন্ন জায়গায়। তিনি বলেছেন, বর্ষা মৌসুমে যেভাবে সড়ক খুঁড়ে ফেলা হয়েছে এতে সাধারণ মানুষ বেশি কষ্ট পাচ্ছে। কাজের ধরণ দেখে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। যত সম্ভব কাজ দ্রæত করা দরকার।
তিনি বলেন, সড়ক খুঁড়ে রাখা হয়েছে। যেটুকুন খালি আছে তাতে অধিকাংশ ভ্রাম্যমানদের দোকান বসে গেছে। চলাচল করা যাচ্ছে না।
ফরিদ আহমদ চৌধুরী বলেন, ব্যবসায়ীরা এখন বড় দুর্ভোগে আছে। মনে হচ্ছে কক্সবাজারে হিরোশিমার সেই বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। আমরা আশা করছি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করবে। সুন্দর সমন্বিত পরিকল্পনায় সামনে এগুবে।
শহরের হাসপাতাল সড়কের সুজন দাশ বলেন, প্রধান সড়কের মতো অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোরও একই অবস্থা। দীর্ঘদিন ধরে ড্রেনের কাজ না করে ফেলে রাখায় সামনের ড্রেনেই পড়ে যায় একটি মালবাহী ট্রাক। এসময় ট্রাকের দুটি চাকা সম্পূর্ণ ড্রেনের ভিতর ঢুকে পড়ে। ওই ট্রাকের আশে পাশে থাকা অন্যান্য গাড়ির চালক ও যাত্রীদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে নিত্যদিন ঘটছে দুর্ঘটনা। আর একবার যদি এরকম ঘটনা ঘটে পুরোদিন যানজট থাকে।
পানবাজার রোডের জাফর আলম জানান, কিছুদিন আগে বিকট শব্দ হয় পাশের পেট্রোল পাম্প এলাকায়। বের হয়ে দেখি পুরো আস্ত গ্যাস সিলিন্ডারভর্তি একটি ট্রাক পড়ে যায় সড়ক উন্নয়ন কাজের জন্য করা গর্তে। সাধারণ মানুষ ছুটোছুটি করতে গিয়ে আরও কয়েকজন আহত হয়। ভাগ্য ভালো ছিল গ্যাস সিলিন্ডার থেকে অগ্নিকান্ড ঘটেনি। তারপরও সিলিন্ডার ও ট্রাক মালিকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কোন রকম জানে বেঁচে যায় ট্রাক চালক ও হেলপার।
ইঞ্জিনিয়ার মো. শাহেদ সালাউদ্দিন এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমি দুনিয়ার এত উন্নয়ন দেখেছি। কক্সবাজারের মতো এমন উন্নয়ন কর্মকান্ড কোথাও দেখিনি। তিনি বলেন, প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি প্রত্যেকটা রাস্তা বন্ধ। যেন অসহায় নগরের বাসিন্দা আমরা। খোদা না করুক; এই মুহূর্তে কক্সবাজারে যদি বড় কোন দুর্ঘটনা হয় যেমন অগ্নিকান্ড ভূমিকম্প তাহলে উদ্ধারের কোন পথ নাই। যে যেভাবে আছে সেভাবেই মৃত্যুবরণ করতে হবে। একজন প্রেগনেন্সি মহিলা এবং হার্টের রোগী জরুরি প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছে যাবে, হাসপাতালে নিয়ে যাবে এমন কোন রাস্তা নাই।
এলাকাবাসী বলছে, প্রত্যেকটা রাস্তা উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিতভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রধান সড়ক থেকে আরম্ভ করে পৌরসভার প্রত্যেকটা অলিগলিতে ফায়ার বিগ্রেডের গাড়ি এবং এ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ এবং বের হওয়ার কোন ব্যবস্থা নাই।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটি ফোরাম সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন জানান, ঝুঁকি আছে তারপরও বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে চলাচল করতে হচ্ছে সড়কটি দিয়ে। কেউ হয়তো ঝুঁকি এড়িয়ে যেতে পারছে আর কেউ কেউ এই মরণফাঁদের কবলে পড়ে সর্বসান্ত হচ্ছে। সড়কগুলোর অপর পাশের মাটি খুঁড়ে উন্নয়ন কাজ করায় অন্য পাশ দিয়ে যানবাহন চলতে হয়।
এ বিষয়ে জানতে পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানের কার্যালয়ে গিয়ে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনও রিসিভ করেন নি।
প্যানেল মেয়র-২ হেলাল উদ্দিন কবির জানান, চলমান কাজের জন্য মালামালগুলো এখানে পাওয়া না যাওয়ায় এবং লকডাউন চলমান থাকায় কাজের ধীরগতি হয়ে গেছে। তারপরও দ্রæত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে শ্রমিকদের চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.