ষোড়শ সংশোধনী: রায় নিয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত সংসদের

ওয়ান নিউজ ডেক্সঃ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে জাতীয় সংসদে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তের বিষয়ে আইনসভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয় বুধবার । যাতে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৮ জন সংসদ সদস্য অংশ নেন।

বিচার বিভাগ যথেষ্ট ধৈর্য ধরছে: প্রধান বিচারপতি

আমাকে ‘মিসকোট’ করবেন না: প্রধান বিচারপতি

রায় বিরাগ থেকে কি না, বিবেচনা করুন: বিচারপতি খায়রুল হক

ষোড়শ সংশোধনী: সেই রায় নতুন করে লেখার পরামর্শ সাবেক বিচারপতির

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আদালত তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে সংসদে আনা সংবিধান সংশোধন বাতিলের এই রায় দিয়েছে।

কী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তা স্পষ্ট করা না হলেও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এই প্রক্রিয়ার কাজ তারা ইতোমধ্যে শুরু করেছেন। আইনমন্ত্রী এর আগে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করবেন বলে সংসদেই জানিয়ে বলেছিলেন, তাতে তারা ‘কামিয়াব’ হবে বলে আশাবাদী।

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বাতিলের রায় গত ১ অগাস্ট বাতিলের পর থেকে এ নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

অন্যদিকে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার আমলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনার এই রায়কে স্বাগত জানায় বিএনপি।

রায়ের পর সংসদ বসার পর তা নিয়ে আলোচনা হবে বলে ধারণাই ছিল রাজনৈতিক মহলে। জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল সেই আলোচনার প্রস্তাব আনার পর তার প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাহী বিভাগ প্রথমে বিচারাঙ্গনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার পর এখন রাষ্ট্রের অন্য অঙ্গ আইনসভাকেও বিচার বিভাগের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে।

বাদলের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, “সংসদের অভিমত এই যে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় বাতিল এবং রায়ে জাতীয় সংসদ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতির দেওয়া অসাংবিধানিক, আপত্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ বাতিল করার জন্য যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।”

বাদল তার নোটিসে বলেন, রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি ‘অপ্রয়োজনীয়, অবাঞ্ছিত বক্তব্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের অপরিপক্ক আখ্যায়িত করেছেন’। এ বিষয়টি নিয়ে এমনভাবে আলোচনা, গুঞ্জন চলছে; যা সমগ্র জাতির জন্য বাঞ্ছনীয় নয়।

কণ্ঠভোটে প্রস্তাবটি পাস হওয়ার আগে আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সংবিধান সংশোধনের কোনো এখতিয়ার আদালতের নাই। আইনের ব্যত্যয় হলে তারা শুধু আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারেন।”

এই রায়ে ‘অনেক কন্ট্রাডিকশন’ রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কোথা থেকে, কীভাবে, কারা (এই রায়) তৈরি করে দিয়েছে; এটা একটা প্রশ্ন।” সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তিনি আই-নেস ও উই-নেসের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে আই-নেস এসে যায়।”

তিনি বলেন, “তিনি (প্রধান বিচারপতি) বিভিন্ন কথা বলতে গিয়ে নিজেকে এবং সংসদ ও গণতন্ত্রকে শ্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তার উদ্দেশ্যটা কী; আমার প্রশ্ন।” এই রায়ের প্রসঙ্গ ধরে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা সমুন্নত রাখার কথা বলেন শেখ হাসিনা।

আলোচনায় অংশ নিয়ে সংবিধানের এই সংশোধনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বিচারপতিদের সম্মান, স্বাধীনতা ও বিচারপতি অপসারণ সুদৃঢ় করতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।

“আইনের ড্রাফট পাঠাই ২০১৫ সালের প্রধান বিচারপতির কাছে। আমি কোনো উত্তর পাইনি। পরে, আমাকে একটা টিঠি পাঠানো হয়। তাতে লেখা ছিল- ‘ম্যাটার সাবজুডিশ; নো কমেন্টস’। তখনই বোঝা গিয়েছিল, তাদের একটা উদ্দেশ্য ছিল।”

রায়ে যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনা হয়েছে, তাকে ‘তাইরে-নাইরে খেলা’ বলে মন্তব্য করেন আনিসুল হক।

“যে যুক্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করেছে; তা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি খুবই দৃঢ়তার সাথে বলছি, দিস জাজমেন্ট উইল নট গো উইদাউট লিগ্যাল চ্যালেঞ্জ। “এই রায় আবেগতাড়িত ও বিদ্বেষপ্রসূত। সুতরাং আমরা আইনি প্রক্রিয়া চাই। আমরা এই লক্ষ্যে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি।”

প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করে আইনমন্ত্রী বলেন, “এই পদে যিনি বসবেন, তাকে আইনি ভাষায় কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা ঠিক নয়। প্রধান বিচারপতির দুটোরই অভাব দেখা গেছে।”

এই আলোচনায় অংশ নিয়ে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, “বিচার বিভাগ সংবিধানের কিছু সংশোধন বা বিয়োজন করতে পারে না।” তিনি বলেন, প্রজাতন্ত্রে সংসদ সার্বভৌম, বিচার বিভাগ সার্বভৌম নয়।

প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে তোফায়েল বলেন, “বেশি কথা বলা ভালো নয়। “তিনি (প্রধান বিচারপতি) বলেছেন তাকে মিস কোট করা হয়েছে। মিস কোট কাকে করা হয়? যিনি বেশি কথা বলেন তাকে।”

সংসদ সদস্যদের অপরিপক্ক বলার প্রতিক্রিয়ায় প্রবীণ এই রাজনীতিক বলেন, “আমরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা হচ্ছি অপরিপক্ক, আর আমাদের দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকরা হলেন পরিপক্ক!”

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে বলেন, “আপনি যা খুশি তা করতে পারেন না। এই রায় আপনাকেই বাতিল করতে হবে। যে অপকর্ম করেছেন, সেজন্য গোটা দেশবাসীর কাছে মাফ চান।”

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এই রায়কে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ দাবি করে বলেন, “রায়ে বর্তমান সরকার ও নেতৃত্ব সম্পর্কে অযাচিত মন্তব্য করা হয়েছে।

জাতীয় পার্টির নেতা ও পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে অকার্যকর দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

প্রবীণ রাজনীতিক ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, “বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য তার স্বপ্রণোদিত হয়ে এই রায় ও পর্যবেক্ষণ বাতিল করা উচিৎ।”

রায় নিয়ে আলোচনায় বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের দুর্নীতির তদন্ত বন্ধে সুপ্রিম কোর্ট থেকে দুদককে চিঠি দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল বলেন, “বিচারপতিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করা যাবে না, কী বিস্ময়কর”

সাজাপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন,  আমি একটু তার (প্রধান বিচারপতি) দুর্নীতি নিয়ে কথা বলি। কত কত বাড়ি করেছেন। বাড়ি কিনেছেন ভাইয়ের নামে। তিন কাঠা পাঁচ কাঠা করেছেন; রাজউকের দেয়াল ভেঙে।

“সাকা চৌধুরীর স্ত্রী একবার নয়.. একবার বিদেশে, একবার তার বাসভবনে দেখা করেছেন। তিনি একজন অভিযুক্তের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রমাণিত।”

কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী প্রধান বিচারপতির সম্পদের বিবরণ তুলে ধরে বলেন, “উনি ২০০৩ সালে উত্তরার ১৫ নম্বর সেক্টরে তিন কাঠা প্লট পান। ২০০৪ সালে; তা পাঁচ কাঠা করে ১০ নম্বর সেক্টরে আনা হয়। ভাইয়ের ছয়তলা বাড়ি নিজের বলে দেখিয়েছেন। বাড়িটি আসলে নয় তলা। “তার অ্যাকাউন্টে টাকা জমাদানকারী দুজনের বাড়ির ঠিকানা দেখানো হয়।

শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “এই রায় প্রতিষ্ঠিত করতে একটি পত্রিকা বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। কেন নিয়েছেন, তা জানি না। এই রায়ে বিএনপি নেতা মাহবুবউদ্দিন খোকন দুই মন মিষ্টি বিতরণ করেছেন।”

এই আলোচনায় বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, স্বতন্ত্র সাংসদ ফখরুল ইমাম, তাহজিব উল আলম সিদ্দিকী ও রুস্তম আলী ফরাজীও বক্তব্য রাখেন।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.