লোকসানে জেলেরা

মোঃ নেজাম উদ্দিন,
গত কয়েকদিন বৈরী আবহাওয়া, সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ওজলদস্যূদের কারণে জেলেরা সাগরে যেতে পারছেন না। কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের ঘাটগুলোতে অন্তত ৪ হাজার মাছ ধরার ট্রলার নোঙর করে আছে। অবশ্য গতকাল থেকে জেলেরা আবারো সমুদ্রে যাওয়া শুরু করেছে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গতকাল শুক্রবারও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত ছিল। এতে উপকূলীয় এলাকায় দুই থেকে চার ফুটের অধিক উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা ছিল বিধায় জেলেদেওে নিরাপদ স্থানে থাকার জন্য বলা হয়।।
ট্রলারমালিক ও জেলেরা জানান, নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে গিয়ে প্রথম এক সপ্তাহ ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরা পড়েছিল। কিন্তু এরপর সাগরে প্রচণ্ড গরম ও বৈরী আবহাওয়া দেখা দেয়। এতে বেশির ভাগ ট্রলার ঘাটে ফিরে আসে। এই অবস্থায় অনেকেই ট্রলারের জ্বালানি খরচও তুলতে পারেনি। এর মধ্যে গত শুক্রবার থেকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় ট্রলারমালিকেরা লোকসানের ভয়ে সাগরে ট্রলার নামাতে সাহস পাচ্ছেন না। কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়ায় বাঁকখালী নদী মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। এ নদীর মোহনায় দেশের অন্যতম নৌঘাট ও মৎস্য অবতরণকেন্দ্র। এ ঘাটেই এখন দেড় থেকে দুই হাজার ছোট-বড় মাছ ধরার ট্রলার নোঙর করে আছে। সারি সারি এসব ট্রলারে অলস সময় পার করছেন জেলেরা।
চকরিয়ার মোহাম্মদ আলী (৫০) ঘাটের পন্টুনে বসে মাঝি সৈয়দ আলমের সঙ্গে সলাপরামর্শ করছিলেন। তাঁর চারটি ট্রলার রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা শেষে চারটি ট্রলারই সাগরে মাছ ধরতে যায়। এক সপ্তাহের মধ্যে সব ট্রলার ঘাটে ফিরে আসে।
সব মিলিয়ে জেলেদের দুর্দশা যেন পিছুই ছাড়ছে না। দুই সপ্তাহ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া কাটিয়ে সাগরে মাছ শিকারে যাওয়ার পর ফের সাগর উত্তাল। তাই ২-৩ দিন সাগরে মাছ শিকারের পর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ফের কক্সবাজার উপকূলে ফিরছেন জেলেরা। ইলিশ শূন্য ট্রলারগুলো নোঙর করছেন ঘাটে। মাছ শূন্য ট্রলারগুলো ফেরায় লোকসানে ট্রলার মালিকরাও। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া তাই সাগর থেকে একে একে ট্রলারগুলো ফিরেছে উপকূলে। আর নোঙর করছে বাঁকখালী নদীর মোহনায়। প্রতিটি ট্রলারে রয়েছে ১২ থেকে ২৫ জন জেলে। ট্রলারগুলো ঘাটে ভিড়লেও অনেক ট্রলারে নেই ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ। আবার অনেক ট্রলারের জেলেরা সাগরে ৩দিন জাল ফেলে পেয়েছেন মাত্র ২০ থেকে ৫০টি ইলিশ। তাই ট্রলারে বসে দুশ্চিন্তায় দিন পারছেন করছেন জেলেরা। তারা বলছেন, সাগর উত্তাল হওয়ায় ফের মাছ শিকার না করে ফিরতে হয়েছে উপকূলে।
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের জেটিতে নোঙর করা মহেশখালী ট্রলার এফবি মায়ের দোয়ার জেলে সৈয়দ উল্লাহ বলেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে চলতি মাসে ১৫ দিন ঘাটে বসা ছিলাম। এরপর আবহাওয়া পরিস্থিতি ভাল হলে ৩ লাখ টাকার মালামালসহ ফের ১৪ জন জেলে নিয়ে ১৭ আগস্ট সাগরে মাছ শিকারে যায়। কিন্তু সাগর বেশি উত্তাল, জাল ফেলেও ইলিশ পাওয়া যাচ্ছিলো না। ২দিন জাল ফেলে পেয়েছি মাত্র ২০টি ইলিশ মাছ। আর ৩য় দিন সাগর উত্তাল থাকার কারণে কোনোভাবেই জাল ফেলা যাচ্ছিলো না। তাই শুক্রবার সকালে ঘাটে ফিরে এসেছি মাত্র ২০টি ইলিশ নিয়ে।
এফবি আল্লাহ দান ট্রলারে জেলে তৈয়ব বলেন, ১৮দিন ঘরে বেকার বসে ছিলাম। তারপর আবারও সাগরে মাছ শিকারে যায়। এখন সাগর আবারও উত্তাল হওয়ায় ঘাটে ফিরে এসেছি। মাত্র ৩ ইলিশ মাছ পেয়েছি। দুঃখ বিষয় আর কিছু বলার নেই।
আরেক জেলে ইয়াছিন বলেন, দুর্দশা যেন আমাদের পিছুই ছাড়ছে না। ৬৫ দিন বন্ধের পর সপ্তাহখানেক সাগরে মাছ পেয়েছিলাম। এরপর গরমে কারণে সাগরে আর মাছ পাওয়া যায়নি। এরপর গত ২ আগস্ট থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে সাগরে যেতে পারেনি। এখন সাগরে যেতে না যেতে আবারও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। তাই জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে উপকূলে ফিরে আসা। এমন অবস্থায় খুব কষ্টে দিনগুলো পার করছি।
শুক্রবার (১৯ আগস্ট) সকালে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে দেখা যায়, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ট্রলারগুলো যখন উপকূলে ফিরছিল, তখন ট্রলার মালিকদের চোখ ছিল ট্রলারে। কিন্তু ট্রলার ঘাটে ভিড়লেও নেই দেখা নেই ইলিশের। এতে চরম হতাশ হয়ে পড়েন ট্রলার মালিকরা। কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী এলাকার বাসিন্দা সোহেল রানা। তার মালিকানাধীন ট্রলার রয়েছে ২০টি। তিনি বলেন, দুদিন আগে ২০টি ট্রলার সাগরে মাছ শিকারে যায়। প্রতিটি ট্রলারে তেল, খাদ্য, জেলেদের বেতনসহ খরচ পড়েছে ৩ লাখ টাকা। এখন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে এরই মধ্যে কক্সবাজার উপকূলে ফেরত এসেছে ৫টি ট্রলার। যার কোনটিতেই মাছ নেই। বাকি ১৫টি ট্রলার সাগর উত্তাল থাকার কারণে পটুয়াখালীতে নোঙর করেছে। অনেক লোকসানে আছি।
শহরের নুনিয়ারছড়ার আরেক ট্রলার মালিক আবু বক্কর বলেন, লোকসান দিতে দিতে আর পারছি না। এভাবে চলতে থাকলে ট্রলার বিক্রি করে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে। একে তো জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, তার ওপর বার বার দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। এতে দুর্দশা যেন পিছুই ছাড়ছে না বলে জানালেন জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির নেতারা।
জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুর মোহাম্মদ বলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে সাগর বেশি উত্তাল। যার কারণে ট্রলারগুলো সাগরে মাছ শিকার না করে উপকূলে ফিরতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে দু’দিনে ৩ হাজার ট্রলার উপকূলে নোঙর করেছে। এ অবস্থায় এখন ট্রলার মালিক, মৎস্য ব্যবসায়ী, মৎস্য শ্রমিক ও জেলেরা চরম দুর্দশা যাচ্ছে। কক্সবাজারে নিবন্ধিত সাড়ে ৫ হাজারের বেশি নৌযান রয়েছে। লক্ষাধিকের বেশি জেলে থাকলেও এখন পর্যন্ত নিবন্ধনের আওতায় ৬৩ হাজারের মতো জেলে।

 

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.