রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পূর্ণ হবে না

রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমি ১৯৯১ সাল থেকেই লিখে আসছি। যখন তারা দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশে আসে। ঢাকা থেকে আজকের কাগজ-এর হয়ে আমি প্রথম সেখানে যাই, ছিলাম প্রায় দুই সপ্তাহ। তখন স্থানীয় সাংবাদিকরা আর আমিই ছিলাম মাঠে। মাস খানেক পর আরও দুজন গিয়েছিলেন ঢাকা থেকে। গত বছরের রোহিঙ্গা প্রবেশের মিডিয়া চিত্রের সঙ্গে তুলনা করলে অনেকের কাছে অবশ্য এটি অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে।

যাক, ২০১৭ সালের ২৫ শে আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা নিয়ে বহু লেখা লিখেছি। মনে হচ্ছে আরো বহুলেখা লিখতে হবে। বিশ্ব বিবেকের প্রতিনিধিত্ব করতেন এডওয়ার্ড সাইদ, উমবের্তো একো তারা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের নিয়ে লিখেছেন। বিশ্বের মানুষ হয়ত জেনেছেন ফিলিস্তিনিদের দুঃখ দুর্দশার কথা কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও উপকার হয়নি এখনও।

বড় শক্তিগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থে এসব আঞ্চলিক সমস্যাগুলোতে এমনিভাবে জড়িয়ে যায় যে শেষ পর্যন্ত সমস্যার কোনও কুলকিনারা থাকে না। পরাশক্তি আমেরিকার কারণে ফিলিস্তিন সমস্যাটার কোনও সমাধান হলো না। এখন অনুরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে।

গত সপ্তাহে ওয়াশিংটন পোস্ট এই নিয়ে “সাদাকে সাদা কালোকে কালো” বলে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধন লিখে বলেছে “দেশটি দেখিয়ে দিল কত দ্রুত তার সঙ্গে গণহত্যা করা যায় আর সে দুবৃত্তায়নের জন্য কোনও পরিনাম ভোগ করতে হয় না।” মিয়ানমারও চীন, রাশিয়া আর ভারতের কারণে রোহিঙ্গা নিয়ে এতো নির্মম হতে পেরেছে। মিয়ানমারের কাছে প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে প্রচুর। সবার দৃষ্টি তার সম্পদের প্রতি।

জাতিসংঘ রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে খুবই সক্রিয় ছিলো, আমেরিকাও যথেষ্ট সক্রিয় ছিলো, ইউরোপীয় ইউনিয়নও কম করেনি। কিন্তু চীন, রাশিয়া আর ভারতের সমর্থন পেয়ে মিয়ানমার পোপের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষকে পর্যন্ত “রোহিঙ্গা” শব্দটি উচ্চারণ করতে দেয়নি। ১৯৯৬ সালে আমেরিকার কংগ্রেস একটি বিল পাশ করেছিলো- পৃথিবীর যে কোনও দেশে আমেরিকার পেটেন্ট লংঘন করলে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে আক্রমন হিসাবে গণ্য করা হবে। কত একতরফা সিদ্ধান্ত নিজের পক্ষে।

এখন দেখছি চীন আমেরিকার চেয়েও নিকৃষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যেখানে চীনের স্বার্থ সেখানে চীন দোষকে দোষ বলেছে না। ভালমন্দ সব গুলিয়ে ফেলছে। বাংলাদেশ ছোট দেশ। চীন পূর্ব থেকে বলে রেখেছে রোহিঙ্গা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে যেন বেশী বাড়াবাড়ি না করে। যে আকিয়াব থেকে রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমার বিতাড়িত করেছে সে আকিয়াব উপকূলে জেকে বসেছে চীন। সেখানে বিরাট নৌ-বন্দর গড়ে তুলছে।

আকিয়াব উপকূলে প্রচুর তেল গ্যাসের মওজুদ আছে। চীন সেখানে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে। সেখান থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে চীন তেল গ্যাস নিয়ে যাবে চীনে। মংডু, বুশিদং ও রাশিদং যেখানে রোহিঙ্গারা গত চারশত বছরব্যাপী বসবাস করছে সেখানে নাকি চীন রপ্তানী প্রক্রিয়া জাতকরণ অঞ্চল গড়ে তুলবে।

চীন আর ভারত উভয়ে বাংলাদেশের বন্ধু। বন্ধু ছোট ও গরীব হলে কলকে সাজাতে বলে। প্রয়োজনে ধার দেবে। শ্রীলংকাকে ৮ বিলিয়ন ডলার ধার দিয়েছে চীন। ধার পরিশোধ করতে না পারলে শ্রীলংকার মতো হাম্বানতোতা বন্দর লিখে নেবে। এ হলো গরীব ও ছোট দেশগুলোর ললাট। স্বপ্ন দেখায়, নিজের প্রয়োজন পুরালে আবার স্বপ্নের অপমৃত্যুও ঘটায়।

জুলফিকার আলী ভুট্টো তার এক বইতে লিখেছেন গরীব দেশগুলোর কিসের স্বাধীনতা, কিসের সার্বভৌমত্ব। বড় শক্তিধর দেশগুলোর কাছে সবই প্রহসন। তারা যা বলে সবই সত্য। তারা যা বলে ঘুরে ফিরে সবই এক কথা।

২৩ শে নভেম্বর মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছিলো। পরবর্তী সময়ে উভয়দেশ পররাষ্ট্র সচিবদের নেতৃত্বে দুইটা ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে। ১৯ শে ডিসেম্বর ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের পর একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল যে হয়ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কাজ শুরু হবে। ২৩ শে জানুয়ারি প্রত্যাবাসনের একটা তারিখও নির্ধারিত হয়েছিলো। কিন্তু প্রত্যাশিত প্রত্যাবাসনের কাজটি শুরু হল না।

গত ২০/২৫ বছরব্যাপী রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার যে আচরণ করছে তাতে কেহই ভরসা করেনি যে মিয়ানমার কথা মতো কাজ করবে। মিয়ানমার কখনও কূটনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষা করে চলে না। জাতিগতভাবে এরা অদ্ভুত স্বভাবের মানুষ। শরৎ চন্দ্র তার এক লেখায় বলেছেন বিশ্বব্যাপী আত্মীয়তা করে, জাত ধর্ম কিছুই দেখে না। তবে আত্মীয়তার পর আর খোঁজ খবর রাখে না। রাষ্ট্রটা আর অং সাং সুচীসহ নেতৃবৃন্দের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতাও নেই।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা হয়নি। জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছাড়া এ প্রক্রিয়া সফল হবে না। জাতিসংঘের ভূমিকা ছাড়া প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করাও যাবে না। প্রত্যবাসন শুরু হলে যেন রোহিঙ্গারা রাখাইনে গিয়ে বাড়ী ঘরে উঠতে না পারে সে জন্য গত ২৪ শে জানুয়ারি তমব্রুতে যে সব ঘরবাড়ী অবশিষ্ট ছিলো তাও সেনাবাহিনী আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। রোহিঙ্গা আসা এখনও বন্ধ হয়নি।

বাংলাদেশ সরকার কোন্ ভরসায় বসে আছে জানি না। টেকনাফ আর উখিয়া থানায় এখন ৮/৯ লক্ষ রোহিঙ্গা রয়েছে আর কয়দিন গেলে টেকনাফ আর উখিয়া থানার স্থানীয় বাসিন্দারা হয়ত আর রোহিঙ্গাদের সহ্য করবে না। ছোট একটা জাযগায় লক্ষ লক্ষ লোক বসত করে কিভাবে? স্থানীয় লোকদের এখন নাভিশ্বাস উঠেছে। হয়তো কয়দিন পরে সম্প্রীতি বিনষ্ট হওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে।

এ পর্যন্ত আমরা যতটুকু জেনেছি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যেনতেন ভাবে যেতে রাজি হবে না। তারা যদি যেতে রাজি না হয় তবে বাংলাদেশ কি জোর করে পাঠাতে পারবে? তখনও কি আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া হবে না। বছর বছর রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ভোগার চেয়ে শক্ত একটা চুক্তির মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করা দরকার। যে সব খুঁটির জোরে মিয়ানমার নাচানাচি করছে তাদের সহযোগিতা চাওয়া উচিৎ। আনান কমিশন রোহিঙ্গা নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলেছে এখন নাগরিকত্বের বিষয়টি ধামা-চাপা পড়ে গেল কেন?

এ বিষয়টা ফয়সালা করা ছাড়া রোহিঙ্গাদের পাঠালে প্রত্যাবাসনের কাজটি শেষ হওয়ার আগে কি রোহিঙ্গারা পুনরায় বাংলাদেশে ফিরে আসবে না? সুতরাং অনুরূপভাবে কাজটা করে লাভ হবে কি? চীন, রাশিয়া আর ভারতের কাজে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়টা নিয়ে তাদের কার্যকর সহযোগিতা চাওয়া প্রয়োজন। বিষয়টা যেন স্থায়ীভাবে সমাধান হয়। চীন যখন দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে আকিয়াবে বসে গেছে তখন বাংলাদেশের উচিৎ চীন থেকে কোনও নিরপেক্ষ ভূমিকা প্রত্যাশা না করা।

সুতরাং রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন হচ্ছে না ধরে নিয়ে বাংলাদেশের উচিৎ হবে বিকল্প চিন্তা ভাবনা করা। এ বিষয়ে আমাদের নিকট প্রতিবেশী মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশকে সাহায্য করতে পারে। তুরস্কও কার্যকর সাহায্যে প্রদানের জন্য এগিয়ে আসবে বলে মনে হয়।

আনিস আলমগীর: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
anisalamgir@gmail.com

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.