রেগিং কি? রেগিং কেন দেয়া হয়?

ওয়ান নিউজ ডেক্সঃ রেগিং অর্থ পরিচিত হওয়া, তিরস্কার করা অথবা আবেগে কিছু করা ইত্যাদি। আরও ভালো ভাবে বললে, র‍্যাগিং শব্দের প্রচলিত অর্থ হচ্ছে ‘পরিচয় পর্ব’ অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষার্থীদের সাথে পুরাতন শিক্ষার্থীদের একটা সখ্যতা গড়ে তোলার জন্য যে পরিচিতি প্রথা সেটাকে র‍্যাগিং বলে অভিহিত করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একটা সৌভাগ্যের বিষয়। বিশ্ব টা যে কি? তা এখানে পড়ে ভাল ভাবেই বোঝা যায়। Ragging শব্দটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডেন্ট দের সাথে বিশেষভাবে জড়িত। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটা পাবলিক ভার্সিটিতে এবং মেডিকেলে Ragging এর প্রচলন রয়েছে। এছাড়াও কিছু প্রাইভেট ভার্সিটিতেও রেগ দেখা যায়। রেগিং সম্পর্কে অনেকেরই খারাপ ধারণা থাকে। আবার কেউ কেউ বিষয়টাকে পজিটিভ ভাবেন। আজকাল রেগিং বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাড়িয়েছে।

যারা রেগ দেয়: বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়ররা সাধারণত তাদের জুনিয়রদের রেগ দেয়। ব্যাচের পুরো স্টুডেন্টরা সাধারণত রেগ দেয় না, দেয় শুধুমাত্র কিছু নির্ধারিত সিনিয়র। যারা ভার্সিটিতে ১ম ভর্তি হয় তারাই সবচেয়ে রেগিং এর শিকার হয়। ভার্সিটির সিনিয়ররা নিয়মানুযায়ী তাদের জুনিয়রদের রেগ দেয়। ছেলে জুনিয়ররা বেশী রেগ খায়, মেয়ে জুনিয়রদের সাধারণত কম রেগ দেয়া হয়। সাধারণত নিজ নিজ বিভাগ এর ক্ষেত্রে রেগ এর প্রচলন বেশীই হয়ে থাকে।

রেগিং এর ধরন: রেগিং এর বিভিন্ন ধরন রয়েছে। যেমন-পরিচয় দেওয়া, গান গাওয়া, নাচা, কবিতা আবৃতি ইত্যাদি। রোদ্রে ক্যাম্পাসে দৌড়ানো, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন রয়েছে। এছাড়া সিনিয়র আপুদের প্রপোজসহ বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতন হয়ে থাকে। রেগ সাধারণত একক কিংবা যৌথভাবে ঘটানো হয়ে থাকে। রেগ শেষে সব জুনিয়রকে সিনিয়ররা মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে।

রেগিং এর কারণ: ভার্সিটিতে একটা স্টুডেন্ট প্রথম ভর্তি হয়ে স্বাভাবিকভাবে অনেক কিছুই অজানা থাকে। তারা বাবা মাকে ছেড়ে এক নতুন পরিবেশে চলে আসে। এখানে কিভাবে চলতে হয়? থাকতে হয়? তা একমাত্র সিনিয়র ভাই/আপু রাই নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। সিনিয়র, টিচার এদের সাথে ভদ্রতা বজায় রাখার নিয়মাবলী সিনিয়ররা শিখিয়ে থাকেন।আর সিনিয়ররা কোন জুনিয়র এর বেয়াদবি বরদাশত করেননা।এজন্য তারা Ragging এর কৌশল অবলম্বন করে থাকে। রেগ এর মূল বিষয় হচ্ছে ‘সিনিয়রদের সাথে ভালো বোঝাপড়া করা’। আর ভার্সিটিতে জুনিয়রদের রীতিনীতি শিখানোর জন্য আর হয়ত কোন পদ্ধতি আবিস্কার হয়নি,তাই rag এর প্রচলন চলে এসেছে।

রেগ এর ভাল দিক: রেগিং এর মাধ্যমে সিনিয়রদের সাথে সম্পর্ক ভালো হয়। ক্লাসের যে সীট/হ্যান্ডনোট গুলো দেয়া হয় তা একমাত্র সিনিয়ররাই দিয়ে থাকে। আর পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের গাইডলাইন ত সিনিয়ররা দিয়েই থাকে। এজন্য তাদের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখা জরুরি। একজন জুনিয়রকে এমন ভাবে তৈরী করা হয়, যাতে মানুষে বলে ‘স্টুডেন্টটা ভার্সিটিতে পড়ে’।এখানে একজন জুনিয়রের জড়তা কিংবা অহামিকা এই দুটোকেই বিবেচনা করে প্রাধান্য দেয়া হয়।বলা হয়ে থাকে ‘জুনিয়রের মাঝে জড়তা কিংবা ভাব নেয়া এগুলো তার মাঝে থাকবে না’। মানুষের সাথে কথা বলা, চালচলন, উঠাবসার সিস্টেমটা রেগ এর মাধ্যমেই শিখানো হয়। তাছাড়াও ব্যাচের সবার সাথে একতা বজায় রাখার নির্দেশনা সিনিয়ররা দিয়ে থাকে। নিজ ডিপার্টমেন্টে একতাসহ পুরো ভার্সিটিতে একটা সুসম্পর্ক বজায় রাখার তাগিদ rag দিয়ে থাকে। যেটা খুবই প্রয়োজনীয়। সিনিয়রদের সম্পর্ক ভালো থাকলে যেকোন বিপদ-আপদে জরুরী প্রয়োজনে তাদের পাশে পাওয়া যায়।এছাড়া চাকরি জীবনে প্রবেশের জন্যে সিনিয়রদের সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে। আর রেগ এর ক্ষেত্রে বিশেষ করে ‘হুজুর’ টাইপের ছাত্রদের জন্য সিনিয়ররা অনেকটাই শিথিলতা প্রদর্শন করে থাকে। .

রেগিং এর খারাপ দিক: কিছু সিনিয়র অনেক খারাপ রেগ দিয়ে থাকে। রেগ সাধারণত নোংরামিতে ভরা বেশি। অশ্লীল কথাবার্তা বলা, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী প্রদর্শন করা কিংবা শুনতে হয়। সবার রেগ সহ্য করার ক্ষমতা এক নয়। রেগ এ শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। রেগ অসহনীয় পর্যায়ে গেলে অনেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। রেগিং এর নামে শেখানো হয় সেক্স বিষয়াবলি। একজন জুনিয়রের সর্বনিম্ন পার্সোনালিটি থাকে কিনা সেটা অনুমেয়? জুনিয়রকে সারারাত কিংবা রাতের বেশী অংশই শারীরিক/ মানসিক নির্যাতন করে নির্ঘুম কাটাতে হয়। সবার সামনে লাঞ্চনার শিকার হতে হয় জুনিয়রদের। তাদের প্রাথমিক জীবনে নেমে আসে দুর্বিসহ অন্ধকার। রেগিং তখন তাদের মনে হয় একটা আতঙ্ক। জুনিয়র মেয়েদের রেগ এর নামে কি করা হয়, তা এখানে বলা সমীচীন হবে না বোধদয়।

 

 

রেগিং যেখানে বর্বর: কোন কোন রেগিং কারো জীবনে ইতিহাস হয়ে থাকে। বাংলাদেশে কিছু ভার্সিটিতে রেগিং এর কোন গন্ধও পাওয়া যায় না। আবার কিছু ভার্সিটিতে রেগিং এর নামে চলে প্রহসন। যেমন: ঢাবি, জবি, জাবি, চবি ইত্যাদি। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রেগিং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রুপ ধারণ করে। সাম্প্রতিক কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেগিং এর ফলে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। পত্রিকা খুললে মাঝে মাঝে রেগিং এর নির্মমতা দেখতে পাওয়া যায়। রেগিং এর মাধ্যমে নৈতিকতার চরম অবক্ষয় দেখা যায়।অনেক কিছু সিনিয়ররা রেগ এ জুনিয়রদের যৌনশিক্ষা সহ এমনকি হস্তমৈথুন করতে বাধ্য করা হয়। যেখানে ভার্সিটিতে পড়া গৌরবের বিষয়, সেখানে কিছু শয়তানরুপী সিনিয়র এর ভাবমূর্তি নষ্ট করে খারাপ রেগ এর মাধ্যমে। এসব রেগিং নীচু মানসীকতারই পরিচয় বহন করে।

রেগিং এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ: প্রতিটা পাবলিক ভার্সিটিতে রেগিং এর বিরুদ্ধে কঠোর নীতিমালা প্রনয়ন করা থাকে। যদি রেগিং প্রমানিত হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে রেগিং কারণে ছাত্র/ছাত্রী বহিঃষ্কারের ঘটনা ঘটেছে।

জুনিয়রদের অসহায়ত্ব: জুনিয়ররা তাদের বাবা মাকে ছেড়ে নতুন ক্যাম্পাসে টিকে থাকার চেষ্টায় রত। এজন্য হাজার কষ্ট হলেও সবকিছু মেনে নিতে হয়। শত কষ্ট হলেও বুকে পাথর দিয়ে সহ্য করে রেগিং এর বর্বরতা। একজন জুনিয়র যদি ভার্সিটির প্রক্টর বরাবর অভিযোগ করে থাকে তাহলে তারা অবশ্যই রেগিং দাতার ছাত্রত্ব বাতিল কিংবা বহিঃস্কারের মত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।কিন্তু বিষয়টি সিনিয়রমহলের কাছে জানাজানি হলে সেই জুনিয়রের জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। তাকে বিভিন্ন ভাবে হুমকে দেয়া হয়, এমনকি মৃত্যুরও হুমকি দেয়া হয়। আর RAG এর ব্যাপারে সিনিয়রদের বড় ধরনের একতা থাকে। বলা হয়ে থাকে ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের কাছে অভিযোগ যাওয়ার পূর্বেই কথাটি সিনিয়রদের কানে চলে যায়’।

সত্যি বলতে কি,, জুনিয়রদের RAG এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কোন ভাষা নেই।হয়তো কারো সেভাবে সুযোগ নেই।অকল্পনীয় হলেও বাস্তবতাকে মেনে নিতে হয়।

রেগিং এর প্রেক্ষাপট: রেগিং হচ্ছে পশ্চিমা কালচারের লেশ মাত্র। সময়ের গভীরে বাংলাদেশে পাবলিক ভার্সিটি গুলোতে একটি নিত্য ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে।সিনিয়রদের কাছে Raging, শিকারী বাঘের মতো চেয়ে থাকা। কখন যে জুনিয়ররা সামনে আসবে??আর তাদের ইচ্ছা মত শিখানো হবে।।। এই ধারনাই কেটে যায় তাদের একটা সময়। কিছু সিনিয়রদের কাছে রেগিং একটা নেশা। রেগ না দিলে তাদের পেটের ভাত হজম হয় না বোধদয়।গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝামেলা হয়েছে, ত নিয়ে আয় জুনিয়র, একটু সাইজ করি’। বর্তমানে রেগিং বিষয়টা চেইনের মতো বছরের পর বছর চলে আসছে কালচারের মত এবং এটা চলতে থাকবে।বলা হয়ে থাকে ‘রেগ তারাই দেয়, যারা রেগ খেয়ে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রে সিনিয়ররা ব্যর্থ হয়,জুনিয়রদের ঠিক করতে। কারণ সব জুনিয়র ত আর এক না।

শেষ কথা: বাবা মায়ের স্বপ্ন যেখানেই বিবেচ্য বিষয়, সেখানে রেগ শুধুমাত্র ধোয়াশা মাত্র। Ragging এর শিকার জুনিয়রদের আর্তনাদ হয়তো বাবা মায়ের কানে পৌঁছাবে না।তবুও তাদের স্বপ্নপূরণে এগিয়ে যায় নিরন্তর ভাবে। জুনিয়রের চাওয়া পাওয়াগুলো জমা থাকে মনের ভিতর। হয়তো সব জুনিয়রদের একটা ভয় ‘এই একটা বছর পার হলেই বাঁচি’।

হ্যা একটা সময় আসে তখন আর সিনিয়র-জুনিয়র ভয় থাকে না। হাতে হাত রেখে সেই ভয়ঙ্কর-রুপি সিনিয়ররা আপন ভাইয়ের মত হয়ে যায়। তখন সবকিছু ভুলে যায়, মনে থাকে না কোন প্রহসন, কোন কষ্ট। একটা সময় জুনিয়ররা সিনিয়র হয়। অনেকেই RAG খেয়েও তার জুনিয়েরদের rag না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। অনেকেই রেগ দিবেই বলে সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু যার মনে rag নামের শব্দটি ইতিহাস হয়ে রয়েছে, সে কি পারবে ভুলে যেতে? হয়ত ‘না’, নয়তো মনকে এ বলে সান্ত্বনা দিবে ‘জুনিয়র আসুক আমিও দেখে নিবো তাদের!’

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.