রাজনীতির বিশেষ মাত্রা, শেখ হাসিনার নতুন যাত্রা

নতুন ধরনের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার পথে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে হ্যাটট্টিক জয়ে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। এ এক নতুন বাংলাদেশ, নতুন গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র শেখ হাসিনার বিশেষ মডেল। প্রথাগত গতানুগতিক ব্যবস্থা এরিস্টটল, জন লক ও অগাষ্ট কোঁৎ-এর পথ পেরিয়ে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে নতুন মাত্রা পেয়ে বিকশিত হচ্ছে। এই নতুন গণতান্ত্রিক ধারার একক অন্যতম কৃতিত্ব শেখ হাসিনার।

এবারই প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় রেকর্ড সংখ্যক দল। এতোগুলো দল বাংলাদেশের ইতিহাসে অতীতে কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। গেল দশ বছরে সারাবিশ্বের কাছে দোর্দণ্ড প্রতাপে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে নতুন অভিযাত্রায় নিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই দেশে আগে ছিল শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী আর নাগরিক সমাজের দল। কিন্তু সময়ের পালাবদলে আওয়ামী লীগ এখন শুধু শিক্ষিত রুচিশীল মানুষের দল নয়, এই রাজনৈতিক দল এখন দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ, শোষিত, বঞ্চিত সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের দল। এই নির্বাচনের মাধ্যমে এই বিষয়টি আরও সুষ্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

কয়েক বছর আগে দেশের উত্তরবঙ্গের মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা তেমন একটা ছিল না। সেখানে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল বিএনপি জোটের। কিন্তু ধীরে ধীরে বিএনপির উত্তরবঙ্গের সেই দুর্গে হানা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিজয়টা শুধু জয়ের বিষয় নয়, বিজয়টা একই সঙ্গে ছিনিয়ে নেয়ারও। সেই বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টায় এবার উত্তরবঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জয়জয়কার হয়েছে।

উত্তরবঙ্গে বিএনপি জোটের অবস্থা এখন নাজুক। ‘শেখের বেটি’ বলতে উত্তরবঙ্গের মানুষ আজ অজ্ঞান। তাই এবারের নির্বাচনে উত্তরবঙ্গ থেকে আওয়ামী লীগের বহু আসন পেয়েছে। গেল দশ বছরে শেখ হাসিনা বিরোধী দলের জন্যে বাংলাদেশের রাজনীতিকে অনেক কঠিন করে দিয়েছেন। রাজনীতি মানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে সংবাদ সম্মেলন আর নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া নয়। রাজনীতি মানে রাজপথের দখল নেয়া। সেই রাজপথের দখল নিতে কৌশলে বিরোধীদের দমন করে শান্তি বজায় রাখার কৌশলে শেখ হাসিনা আবার জয়ী হয়েছেন।

আপামর জনসাধারণ রাজপথে বিরোধী দলের সাথে একাত্ম হয়নি গেল দশ বছরে। কারণ, সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের ব্যবস্থা করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। তাহলে জনতা কেন রাজপথে নামবে? নাগরিকের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা ও দেশের প্রবৃদ্ধির উচ্চ মাত্রা বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। আর এই দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট, মেট্টোরেল, মনোরেল, ফ্লাইওভার নির্মাণসহ মেগা প্রজেক্টগুলো উন্নয়নের ক্ষেত্রে তরুণ ভোটারদের মন কেড়েছে।

দেশকে উন্নত করতে হলে প্রয়োজন একক এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত। শেখ হাসিনার একক এবং দৃঢ় সিদ্ধান্তে এদেশে জঙ্গি দমন, মাদক নিয়ন্ত্রণ ও যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির ক্ষেত্রে নুতন মাত্রা যোগ করেছে সারা বিশ্বে। একের পর এক জঙ্গি হামলায় বিএনপি সরকারের সময় যেখানে ভয়ের রাজ্যে পরিণত হেয়েছিল বাংলাদেশ, সেখানে শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে দশ বছরে দেশের কোথাও একটা বোমা ফাটার শব্দ শোনা যায়নি। মাদক
নির্মূলে শেখ হাসিনার আপোষহীন অবস্থান তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।

এ দেশে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো ডাকসাইটে আর হামবড়া রাজাকারের ফাঁসি হবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। মানুষ ভেবেছিলেন, সাকা চৌধুরীর ফাঁসি হলে মনে হয় চট্টগ্রাম আলাদা ও স্বাধীন রাজ্য হয়ে যাবে! কিন্তু সাকা চৌধুরীর মতো রাজাকারের ফাঁসি দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। কোনো বিদ্রোহ তো দূরের কথা, টু শব্দ পর্যন্ত শোনা যায়নি চট্টগ্রামসহ গোটা দেশে। এটি শেখ হাসিনা প্রশাসনের আকাশচুম্বী সফলতা।

শুধু সাকা চৌধুরীই নয়, বিএনপি জোটের সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, মিরপুরের কসাইখ্যাত কাদের মোল্লা ফাঁসি আর বিশ্বের জনপ্রিয় ইসলামী বক্তা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে জেলে আজীবন শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে বিশ্ব মিডিয়ায় শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি উজ্জল হয়েছে। এরই প্রভাব পড়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের হিসাবে। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় সাফল্য পেয়েছে আওয়ামী লীগ।

৩০ জানুয়ারি (রোববার) ২৯৯ টি আসনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোটের দিনই ভোর রাতে নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ২ আসনে ভোটের ফলাফল স্থগিত রাখে কমিশন। ঘোষিত ২৯৮ টি আসনের মধ্যে ২৫৯টি আসনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। হুসেইন মু. এরশাদের জাতীয় পার্টি পেয়েছে ২০ টি আসন। বিএনপি পেয়েছে মাত্র ৫ আসন। অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে স্বতন্ত্র ৩টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি, জাসদ ২টি, বিকল্পধারা ২ টি, গণফোরাম ২ টি, তরিকত ফেডারেশন ও জেপি পেয়েছে ১ টি করে আসন।

নির্বাচনের আগে ‘গাইবান্ধা ৩’ আসনের এক প্রার্থী নিহত হওয়ার পর ওই আসনে ভোট গ্রহণ স্থগিত রাখা হয়। বাংলাদেশের নির্বাচনে বিজয়ী দলকে অভিনন্দন না জানিয়ে উল্টো বয়কট, ফলাফল প্রত্যাখ্যান ও পুনঃ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী যে রীতি যুগ যুগ ধরে প্রচলিত, সেই গৎবাধা ধ্যান ধারণাতে বিশ্বাসী হয়ে এবারও বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যজোট ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপি-জামায়াত ঐক্যজোটের এই ভয়াবহ ভরাডুবি দেশ-বিদেশে মানুষের কাছে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। বিশ্বাবাসী অনেকটাই নিশ্চিত ছিল যে, শেখ হাসিনা আবারও সরকার গঠন করবে।

এর কারণ বিশ্ব মিডিয়ায় নির্বাচনের আগে যে জনমত যাচাই করা হয়েছে তাতে সুষ্পষ্ট আওয়ামী লীগের অভাবনীয় বিজয়ের ফলাফলই প্রতিভাত হয়েছে প্রায় সকল জরিপে। তাছাড়া শেখ হাসিনা সরকার গেল দশ বছরে বাংলাদেশকে ডিজিটাল রূপ দেয়াতে যে সাফল্য দেখিয়েছে, তাতে নতুন প্রজন্মের ভোটাররা এবার নৌকা প্রতীক বেছে নেবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত ছিল। তাছাড়া বাংলাদেশকে ডিজিটাল করার ফায়দা সরকার যে নির্বাচনের মাধ্যমে আদায় করবে তাও কাঙ্ক্ষিত ছিল।

নির্বাচনের আগে একের পর এক লন্ডনে অবস্থানরত তারেক জিয়া, দেশের ভেতরে মওদুদ আহমেদ, মেজর আজিজ, বরকতউল্লা বুবু এবং ঐক্যজোটের এমপি পদপ্রার্থীদের নাশকতার সৃষ্টির কথপোকথনের রেকর্ড সোশ্যাল মিডিয়া ও মূল ধারার গণমাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। সেই ডিজিটাল সুবিধা পুরোপুরি গেছে আওয়ামী লীগের পক্ষে। এর আগে বিএনপির নমিনেশন বাণিজ্য নিয়ে দলটির গুলশান কার্যালয়ের গেটে তালা লাগিয়ে দেয় তাদের এমপি নমিনেশন পেতে আগ্রহীরা।

সেই সাথে তারেক রহমানকে লন্ডনে কোটি কোটি টাকা পাঠানোর স্বীকারোক্তিমূলক রেকর্ডিং, অনিয়ম এবং দুর্নীতিতে রাজনৈতিকভাবে ডুবন্ত বিএনপির পরাজয়ের পথে বাড়তি মাত্রা হিসেবে কাজ করেছে
ভোটারদের কাছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাছাই আর নির্বাচন মনিটরিং পদ্ধতি ছিল তুমুল সক্রিয়। পক্ষান্তরে রাজনীতির রীতি পদ্ধতি এবং অজ্ঞানতার কারণে বিক্ষিপ্ত, পোষ্টার শূণ্য, গণসংযোগের অভাব, নেতাকর্মী শূন্য আর নির্বাচনের মাঠে গ্রেফতার মামলা হামলার ভয়ে বিএনপি কর্মীদের মাঠের অনুপস্থিতি ঐক্যজোটের পরাজয় সুনিশ্চিত করেছে। অন্য নির্বাচনগুলোর তুলনায় এবার দেশে সংঘাত, হানাহানি একেবারেই কম হয়েছে।

দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারদের লম্বা লাইনও দেখা গেছে। নির্বাচনের ভোট গ্রহণ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন ভারত, নেপাল, সার্ক ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)-এর নির্বাচনী পর্যবেক্ষকেরা। তাদের মতে, শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে ভোট অনুষ্ঠিত। নির্বাচন কমিশন বলছে, ভোটারদের ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সারা দেশে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিকে অনেক বেশি কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং করে দিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। তার গড়া নতুন ফরমটের এই গণতন্ত্র পৃথিবীতের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করছে। এই নতুন গণতান্ত্রিক মাত্রায় আছে রীতি পদ্ধতি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাথে কৌশল, পেশী শক্তি এবং কূটকৌশলের খেলা।

এই ভোটযুদ্ধের নীতি যেমন কুটিল তেমন জটিল। রাজনীতির এই জটিল রাস্তায় ঐক্যজোট এবং বিএনপির মতো বালখিল্য রাজনীতির ধারক বাহকরা মনে হয় শেখ হাসিনার রাজনীতির এই ট্রায়ালে আগামী ২০ বিশ বছর নিঃসন্দেহে খাবি খাবে! রাজনীতির এই ট্রায়ালে ফিরে আসতে হলে বিএনপি এবং ঐক্যজোটের খোল নলচে পাল্টাতে হবে। ড. কামালের মতো অশীতিপর বৃদ্ধের আন্ডারে জোট গঠনের মতো বস্তাপঁচা সিদ্ধান্ত তাদের ভরাডুবির অন্যতম একটি কারণ।

আধুনিক শিক্ষিত ডিজিটাল উন্নত সমাজের সমকক্ষ চিন্তা ভাবনার ধারক বাহক মেধাবী শেখ হাসিনা বিশ্বে অমরতার পথে নতুন ধারার গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশ চর্চায় কিংবদন্তি হয়ে যদি তিনি বেঁচে থাকেন আর তা না হলে তার পরম্পরা আরও কয়েক যুগ নেতৃত্ব দেবেন এমন সম্ভাবনার বার্তা দেয়া খুব কঠিন কাজ না। আর বিএনপির মতো অর্থব, বর্বর বিরোধী দল যে দেশে থাকে সেই দেশে শেখ হাসিনার মতো দক্ষ প্রশাসকের জন্যে কাজটি অনেকটাই সহজ হয়ে যায় তা এবারের নির্বাচনে আরও সুষ্পষ্টরূপে প্রতিভাত হলো।

নিরঙ্কুশ বিজয় যেনো ব্রুট মেজোরিটি না হয়ে জননেত্রী এবং জাতীর জনকের কন্যা সেই বিষয়ে অবশ্যই আগামী ৫ বছর সুগভীর নজর রাখবেন এই বিশ্বাস জনগণের আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে
অভাবনীয় বিজয়ের অফুরন্ত শুভেচ্ছা।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.