রাজনীতিতে আসা নিয়ে যা বললেন হেফাজত নেতারা
ওয়ান নিউজ ডেক্সঃ রাজনীতি এবং দেশ পরিচালনার বিষয়ে আগ্রহী নয় কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সাথে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংগঠনটির প্রধান মাওলানা শাহ আহমদ শফির নেতৃত্বে কওমি আলেমদের একটি প্রতিনিধি দলের বৈঠকের প্রেক্ষিতে দলটির বর্তমান অবস্থান নিয়ে এমন আভাস পাওয়া গেছে।
ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী কওমী মাদ্রাসার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও কওমী মাদ্রাসা থেকে পাস করা ‘দাওরা হাদিস’ শ্রেণিকে মাস্টার্স ডিগ্রি সমমানের মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দেন। এছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে গ্রিক দেবি থেমিসের ভাস্কর্য অপসারণে হেফাজতের দাবির প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন এবং এই ভাস্কর্য অপসারণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দেন।
রাজধানী ঢাকায় সপ্তাহখানেক অবস্থান শেষে মাওলানা শাহ আহমদ শফি শুক্রবার চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় ফিরে এসেছেন। এই মাদ্রাসা থেকে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে পরিচিত। এখান থেকে তিনি তার যাবতীয কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। হেফাজতে ইসলামীর মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীও এই মাদ্রাসার শিক্ষক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শাহ আহমদ শফির মধ্যে বৈঠক নিয়ে চলমান আলোচনা- সমালোচনা প্রসঙ্গে হেফাজতে ইসলামের আমীরের মুখপাত্র মাওলানা মুনির আহমদ পরিবর্তন ডটকমকে বলেছেন, বিষয়টিকে যে যার যার রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান থেকে দেখছে। তবে এসবে আমরা আগ্রহী নই। রাজনীতি নিয়েও আমাদের কোনো আগ্রহ নেই।
‘কারা ক্ষমতায় থাকল কিংবা গেলো সেটা আমাদের লক্ষ্য নয়। আমাদের আন্দোলনের লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু যাতে কেউ করতে না পারে,’ মন্তব্য করেন তিনি।
মুনির আহমদ আরো বলেন, ‘এটা আমরা আগেও বলেছি যে ক্ষমতা নেয়া কিংবা বিদায় করা নিয়ে আমরা আগ্রহী নই। যে বা যারা ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধান উপেক্ষা করে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে আঘাত দেয়ার চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করব। সেই জন্য আমরা এই সরকারের নারীনীতি, সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা-বিশ্বাস বাদ দেওয়া, পাঠ্যপুস্তকে নাস্তিক্যবাদ কিংবা অন্য ধর্মের প্রচারের বিরুদ্ধে কথা বলেছি।’
‘ঈমানী দায়িত্ব হিসেবে সমাজের নানা অসঙ্গতি, অনিয়ম,দুর্নীতি ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সব সময় সোচ্চার আছি,’ যোগ করেন হেফাজতে ইসলামের আমীরের মুখপাত্র।
‘স্বীকৃতি আদায় মানে সমঝোতা নয়’
সরকারের কাছ থেকে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার স্বীকৃতি মানে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা নয় বলে জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলামীর সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী।
তিনি বলেন, ‘কওমী মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকরাও এই দেশের নাগরিক। অন্য সবার মতো আমরাও রাজস্ব প্রদান করি। দেশ গঠনে অংশ নিচ্ছি। কিন্তু এতদিন আমাদের কোনো স্বীকৃতি ছিল না। এবার তা পাওয়া গেছে। এটা কারো দয়ার দান নয়। এটা আমাদের অধিকার।’
আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘এখানে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার বিষয় নয়। হেফাজতে ইসলাম যেহেতু রাজনৈতিক সংগঠন নয়, সেই কারনে কারো সঙ্গে তেমন কোনো বিরোধ নেই। একই কারনে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সখ্যও নেই। সরকার এখন আমাদের কিছু দাবি মেনে নিয়েছে। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা ধন্যবাদ জানিয়েছি। ভবিষ্যতে যদি তারা ইসলামের রীতি-নীতি বিরোধী কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করে কিংবা দেশে মানুষের চিন্তা চেতনার বিপক্ষে অবন্থান নেয় তাহলে আমরা অবশ্যই তার প্রতিবাদ জানাবো।’
হেফাজতের দাবির সঙ্গে বিভিন্ন সময় বিএনপির একাত্মতা ঘোষণা করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখানে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। বিএনপি মনে করেছে হেফাজতকে সমর্থন করা দরকার, তাই সেটা তারা করেছে। এটা তাদের সিদ্ধান্ত। বর্তমান সরকার কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাকে স্বীকৃতি দেয়াকে যৌক্তিক মনে করেছে, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে গ্রিক মূর্তি থাকা যথাযথ মনে করেনি। সরকার মানুষের মনোভাব বুঝতে পেরেছে।’
দেশের ৪৮ হাজার কওমী মাদ্রাসায় ৮৫ লাখ শিক্ষার্থী আছে উল্লেখ করে আজিজুল হক বলেন, ‘বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করার সুযোগ কারো নেই।’
এটা সরকারের সঙ্গে সমঝোতা কিনা এ প্রসঙ্গে হেফাজত আমীরের মুখপাত্র মাওলানা মুনির আহমদ বলেন, ‘এখন আমাদের দাবিগুলোকে যৌক্তিক মনে করে সরকার তা মেনে নিয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে ঈমান আকিদার সাথে সাংঘর্ষিক কিছু হলে সরকারের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয়া হবে। এই ব্যপারে কারো সাথে আপসের সুযোগ নেই।’
শেখ হাসিনার সঙ্গে হেফাজত নেতাদের এটাই প্রথম বৈঠক নয়
এর আগেও হেফাজত নেতাদের সাথে আওয়মী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন সময় বৈঠক হয়েছে। বিশেষ করে ২০১০ সালে ২৯ মার্চ গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেফাজতে ইসলামীর আমীর শাহ আহমদ শফির সাথে বৈঠক করেছেন। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার আহমদ শফির সাথে বৈঠক করলেন আওয়ামী লীগ প্রধান।
এ ব্যাপারে হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদি বলেন, ‘তখনকার শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট এবং সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস শব্দগুলো বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে আলেমদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করেছিলেন। গণভবনে হওয়া ওই বৈঠকে আলেমদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন হেফাজতের আমির শফি সাহেব।’
২০১২ সাল থেকে অবশ্য নারী নীতি, শিক্ষা নীতি এবং ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের অবমাননার প্রতিবাদে ১৩ দফা ঘোষণা করে হেফাজতে ইসলামী। এক পর্যায়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরুর পরপরই মাঠে নামে হেফাজতে ইসলামী।
এক পর্যায়ে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করে সংগঠনটি। কিন্তু ১৩ দফার বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট ঘোষণা আসেনি অভিযোগ করে একই বছরের ৫ মে ফের ঢাকা ঘেরাও করে সংগঠনটি। তাদের লক্ষাধিক নেতা- কর্মী অবস্থান নেন রাজধানীর কেন্দ্রস্থল মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। সেই রাতেই আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে হেফাজত ইসলামকে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়।
হেফাজতে ইসলাম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, ওই অভিযানে তাদের শতাধিক নেতা-কর্মীর মৃত্যুর হয়েছে। যদিও এসব অভিযোগ বারবার অস্বীকার করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
২০১৩ সালের ৫ মে রাতে রাজধানীর মতিঝিলে হেফাজতের অবস্থানস্থলে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান প্রসঙ্গে আপনাদের এখনকার মনোভাব কী? এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান আজিজুল হক ইসলামাবাদী।
আহমদ শফি ছাড়াও ২০০৬ সালে বিরোধী দলে থাকাকালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সাথে ধানমণ্ডির সুধাসদনে হেফাজতের আরেক শীর্ষ নেতা মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীর বৈঠক হয়। জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে একাধিকবার গ্রেফতার হওয়া মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী এক সময় হেফাজতের নায়েবে আমীর হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন। এছাড়াও তার ছেলে মুফতি হারুন ইজহার হেফাজতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক।
এই প্রসঙ্গে ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘তখনকার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুল জলিল আমার রাজধানীর পল্টনের বাসায় গিয়েছিলেন আলোচনা করার জন্য। আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাসান মাহমুদ তিন বার এসেছিলেন আমার চট্টগ্রামের লালখান বাজারের বাসায়।’
‘১১ দফা শর্ত সাপেক্ষে আমি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দিয়েছিলাম,’ যোগ করেন তিনি।
সুধাসদনের বৈঠকে এই নিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা চূড়ান্ত হয়েছিল বলেও উল্লেখ করেন মুফতি ইজহারুল ইসলাম।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.