রফিকুল ইসলাম :
বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া নিয়ে মিয়ানমারের উদ্যোগ “আইওয়াশ” বলে কড়া সমালোচনা করেছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন। যাবতীয় চুক্তি, আশ্বাস, সমঝোতার পরও গত ছয় মাসে নিরাপত্তা সংকটে পড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে সাড়ে ১১ হাজারের মত রোহিঙ্গা। জাতিসংঘ শরনার্থী সংস্থা গতকাল বৃহস্পতিবার জানিয়েছে চলতি সপ্তাহে এসেছে ৫০ জনের মত রোহিঙ্গা। অন্য দিকে দেশ মাতৃ ভূমির টানে বাংলাদেশে আশ্রয় শিবির গুলো থেকে গোপনে ফিরে যাওয়া ৫৮ জন রোহিঙ্গাকে অভ্যর্থনা ক্যাম্পে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা নানা মূখী সমস্যার মাঝেও রাখাইনের চেয়ে উদ্বাস্তু শিবির গুলোতে নিরাপদ ভেবে ফিরে যেতে চাচ্ছে না।
খবর নিয়ে জানা গেছে গত মাসের শুরুতে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে বেশ কিছু রোহিঙ্গা গোপনে রাখাইনে ফিরে যায়। বাংলাদেশের উপকূল দিয়ে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়া এসব লোকদের ৬২ জনের মধ্যে ৪জন বাংলাদেশী ও ৫৮ জন রোহিঙ্গা বলে সে সময় মিয়ানমার জানিয়েছে। সমুদ্রে ঝড়ো বৃষ্টির কবলে পড়ে মালয়েশিয়া গামীদের বহনকারী ফিসিং বোটটি রাখাইনের বুচিডং উপকূলে ডুবে যায়। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় উদ্ধারপ্রাপ্ত লোক গুলোকে মিয়ানমার পুলিশ আটক করে সীমান্তের নাকপুরা অভ্যর্থনা ক্যাম্পে স্থানান্তর করে। উক্ত অভ্যর্থনা কেন্দ্রটি বাংলাদেশ থেকে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গা শরনার্থীদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য নির্মাণ করা হয়েছে।
উদ্ধার প্রাপ্ত ৪ বাংলাদেশীকে পরবর্তীতে যাচাই পূর্বক কুটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা এবং ৫৮জন রোহিঙ্গাকে দেশটির রাষ্ট্রপতি সাধারন ক্ষমার ঘোষনা দিয়েছিলেন। এসব রোহিঙ্গাদের যাচাই বাছাই শেষে নিজ নিজ ঘরবাড়ি বা নিকট আত্মীয়দের কাছে যেতে দেওয়ার ঘোষনাও দিয়েছিল মিয়ানমার। কিন্তু খবর নিয়ে জানা যায় ৫৮ জন রোহিঙ্গাকে সম্প্রতি নাকপুরা অভ্যর্থনা ক্যাম্প থেকে বুচিডং এর একটি কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। বুধবার জাতিসংঘের ৩৮মত অধিবেশনে সংস্থাটির মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার জায়েদ রা’দ আল হুসেন বলেন বাংলাদেশ থেকে ফেরত যাওয়া ৫৮ জন রোহিঙ্গাকে কোন কারন ছাড়াই আটক রাখা হয়েছে। গত বছরের ২৫ আগষ্টের পর থেকে পালিয়ে আসাদের মধ্যে দ্ইু’শ এর মত রোহিঙ্গা গোপনে রাখাইনে ফিরে গেছে। এদের অনেককে বিনা অজুহাতে আটক রাখা হয়েছে।
মানবাধিকার হাই কমিশন বলেন মিয়ানমার আন্তর্জাতিক চাপ এড়াতে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে গত বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশে সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে গত ছয় জুন জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপি ও শরনার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর সাথে প্রায় একই ধরনের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন। কিন্তু গত প্রায় ছয় মাসে রাখাইনে নিরাপত্তার সংকটে পড়ে ১১ হাজার ৪শ ৩২ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। ইউএনএইচসিআর গতকাল জানিয়েছে চলতি সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে অন্তত ৫০ জন রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মানবাধিকার হাই কমিশনারের দায়িত্ব ছাড়ার আগে শেষ প্রতিক্রিয়ায় বুধবার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধন যজ্ঞের তীব্র সমলোচনা করেছেন।
বিগত চার বছরের দায়িত্ব পালনকালে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনার জায়েদ রা’দ আল হুসেন তার পর্যবেক্ষনে নিপীড়নের মধ্যে রোহিঙ্গাদের উপর সংঘঠিত মানবাধিকার অপরাধকে স্বতন্ত্র ও কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন আখ্যা দিয়েছেন। রাখাইনে রোহিঙ্গা নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ সহ যাবতীয় ধারার মানবতা বিরোধী অপরাধে সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে বলেছেন তাদের অন্তত কিছুটা লজ্জা হওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক কমিউনিটি অব রেডক্রস এর প্রেসিডেন্ট পিটার মাওরার গত মঙ্গলবার মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফর শেষে ঢাকা ছাড়ার পূর্বে বলেছেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ প্রস্তুত থাকলেও মিয়ানমারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এখনো বাস্তবতার বাহিরে। মিয়ানমারের দিক থেকে এখনো অনেক কিছু করার বাকি এবং তাদের এ সংক্রান্ত রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবে রূপ দেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি জানান।
গত বছরের ২৫ আগষ্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সন্ত্রাস বিরোধী শুদ্ধি অভিযানে শুরু হয় রোহিঙ্গা নিধন যজ্ঞ। হত্যা, ধর্ষন সহ বিভিন্ন ধারার মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত হতে থাকে ধারাবাহিক ভাবে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে শুন্যে ছুটতে থাকে সেনারা। কখনো কখনো কেটে ফেলা হয় তাদের গলা। মিয়ানমার সরকারের দাবি আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার কারনেই রোহিঙ্গা সংকটের উদ্ভব। সম্প্রতি মিয়ানমার আরসার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্গনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষান দিয়েছেন। এদিকে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা সহ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যরা রাখাইনে জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত দাবী করা হলেও মিয়ানমার এতে রাজি হয়নি।
জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশ সফর শেষ হওয়ায় একদিনের মাথায় কমিশন থেকে এসব মন্তব্য আসলো। চুড়ান্ত অর্থে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছামূলক ও মর্যাদা পূর্ণ প্রত্যাবাসনে ভূমিকা রাখাতে জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস সোমবার কক্সবাজারের উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। সেখানে পরিদর্শনের ফাঁকে তিনি তার অফিশিয়াল টুইটার একাউন্ট থেকে এ সংক্রান্ত একটি পোষ্ট দেন। টুইটারে তিনি লেখেন বাংলাদেশের কক্সবাজারে এসে আমি মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে হত্যা ও ধর্ষনের যে বর্ণনা শুনলাম, তা অকল্পনীয়। তারা ন্যায় বিচার ও নিরাপদে দেশে ফিরতে চায়।
সুত্রঃ দৈনিক কক্সবাজার রিপোর্ট
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.