যে প্রশ্নে আটকে গেলেন বাবুল আক্তার
ওয়ান নিউজ ডেক্সঃ পাঁচ বছর আগে চট্টগ্রামে স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস পর পুলিশ সুপারের চাকরি হারিয়েছিলেন বাবুল আক্তার। এরপর মামলার তদন্তে অগ্রগতি না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ছিলেন মিতুর বাবা–মা। এদিকে বেসরকারি চাকরি ও পরে ব্যবসা করে গুছিয়ে উঠছিলেন বাবুল আক্তার। এতদিন পর সেই বাবুল গ্রেপ্তার হলেন স্ত্রী হত্যার মামলায়।
আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত পেয়ে বাবুল আক্তারকে সোমবার চট্টগ্রামে নেয় মামলা তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। টানা দুই দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর বুধবার তাঁকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় তাঁরা।
পিবিআইয়ের উপমহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, মিতু হত্যাকাণ্ডে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার প্রমাণ তাঁরা পেয়েছেন। এর ভিত্তিতেই পুরোনো মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে তাঁকে আসামি করে নতুন মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত হয়।
২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রামের রাস্তায় খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। সকালে ছেলেকে স্কুলবাসে উঠিয়ে দিতে যাওয়ার পথে নগরীর জিইসি মোড়ের কাছে তাকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। দেশে জঙ্গি তৎপরতার মধ্যে একজন পুলিশ সুপারের স্ত্রীকে এভাবে দিনের বেলায় প্রকাশ্য রাস্তায় হত্যা সে সময় দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। সদ্য পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পাওয়া বাবুল আক্তার তখন ছিলেন ঢাকায়।
চট্টগ্রামে ফিরে তিনি নিজে বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন। মামলায় তিনি বলেছিলেন, তাঁর জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জেরে স্ত্রী খুন হয়ে থাকতে পারেন।
ওই মামলায় বুধবার আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পিবিআই। একইসঙ্গে বাবুল আক্তারসহ আটজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন। সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে এদিন বাবুলকে আদালতে হাজির করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনে সাড়া দিয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁর পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
মিতু হত্যাকাণ্ডের সপ্তাহ তিনেকের মধ্যেই সন্দেহভাজন খুনি হিসেবে বাবুল আক্তারের নাম আসে। একদিন গভীর রাতে ঢাকার গোয়েন্দা কার্যালয়ে তাঁকে নিয়ে প্রায় ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর বাবুলের পুলিশের চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথাও জানানো হয়। এর কিছু দিন পর থেকে মিতুর বাবা মেয়ে হত্যার জন্য বাবুলকে দায়ী করে আসছিলেন। তবে তারপর দীর্ঘদিন মামলার তদন্তে তেমন কোনো অগ্রগতির খবর আসছিল না।
হত্যাকাণ্ডের সাড়ে তিন বছর পর গত বছরের জানুয়ারিতে মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। এর ১৪ মাস পর আজ বাবুলকে গ্রেপ্তার করা হল। এতদিন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ হিসেবে পিবিআই বলছে, হত্যা মামলায় বাবুলকে সম্পৃক্ত করার মতো সাক্ষ্যপ্রমাণ তাঁদের হাতে ছিল না।
পিবিআই বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হল কী করে? এ বিষয়ে জানতে তদন্ত করেছেন এমন একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, বাবুলের আর্থিক লেনদেনের তথ্য যাচাই–বাছাই করতে গিয়েই হত্যাকাণ্ডে তাঁর জড়িত থাকার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। তাঁরা মূলত ২০১৬ সালে মিতু হত্যার আগে-পরে বাবুল আক্তারের আর্থিক লেনদেনের খোঁজখবর করেন। তাঁরা দেখতে পান, হত্যাকাণ্ডের তিন দিনের মাথায় বাবুল আক্তার তিন লাখ টাকা খরচ করেছেন। এই পর্বেই তাঁরা গাজী আল মামুন ও সাইফুল হককে খুঁজে পান।
তাঁরা জানতে পারেন, বাবুল আক্তারের ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হকের কাছ থেকে লাভের তিন লাখ টাকা চেয়ে নিয়েছিলেন বাবুল। ওই টাকা তিনি নড়াইলের গাজী আল মামুনের কাছে পাঠান। মামুন সেই টাকা এই মামলার অন্যতম আসামি কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা ও ওয়াসিমসহ অন্যদের মধ্যে ভাগ করে দেন। পাঁচ বছর আগের ওই লেনদেনের তথ্য পিবিআই বিকাশ থেকে সংগ্রহ করে।
তদন্ত কর্মকর্তারা সোমবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত টুকটাক নানা বিষয়ে বাবুল আক্তারকে প্রশ্ন করেন। আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। একেকবার একেক কথা বলেন। তবে বাবুলের আশা ছিল, জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দেবে। বিকেলের পর তিনি বুঝতে পারেন, তিনি আটকা পড়েছেন। তদন্ত কর্মকর্তারা ধীরে ধীরে বাবুলের কাছ থেকে মুঠোফোনগুলো নিয়ে নিতে শুরু করেন। এ সময় তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। জিজ্ঞাসাবাদে থাকা একজন বলেন, ‘বাবুল আক্তার নিজেও পুলিশ অফিসার ছিলেন। তাঁর ডিভাইসগুলো নিয়ে নেওয়ার পরই তিনি ধরা পড়ে গেছেন বলে বুঝতে পারেন।’ এরপর তিনি কাকুতি-মিনতিও করেন, কেউ ধরা পড়ে গেলে যেমন করে থাকেন তেমনই। সন্তানদের কথাও বলেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাইফুল হকের ছাপাখানার ব্যবসায় বাবুল আক্তার বিনিয়োগ করেছিলেন। বুধবার গাজী আল মামুন ও সাইফুল হক দুজনকেই ছেড়ে দিয়েছে পিবিআই। এই মুহূর্তে এই মামলায় বাবুলসহ আট আসামির দুইজন কারাগারে আছেন। বুধবার রাতেই মামলার আরেক আসামি সাইদুল ইসলাম শিকদার ওরফে সাকুকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। সাকুর ভাই কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুসা এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সন্দেহভাজন। পুলিশের ভাষায় তিনিসহ আরেক আসামি পলাতক আছেন। বাকি দুই আসামি আগের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে আছেন।
পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রো ছাড়াও এই মামলার তদন্তে একযোগে কাজ করে ঢাকার চারটি, গোপালগঞ্জ ও খুলনার দুটি ইউনিট। তারা একইসঙ্গে তিনজনকে নজরদারির আওতায় আনে। সব তথ্য যাচাইবাছাইয়ের পর গত বুধবার পিবিআই বাবুল আক্তারকে ডেকে পাঠায়। বাবুল এক দিন সময় চান। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার বলতে পারবেন কবে তিনি দেখা করতে পারবেন। সোমবার তাঁকে চট্টগ্রামের পিবিআই কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একই সময়ে বাবুল আক্তারের পরিচিত দুই ব্যক্তিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। তবে তাঁদের মুখোমুখি করা হয়নি। এর প্রয়োজনও ছিল না বলে মন্তব্য করেন তাঁরা।
পিবিআই মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের পর বাবুল আক্তার যখন বিভিন্ন প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে পারছিলেন না, তখনই তাঁরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদকে অবহিত করেন। পিবিআই জানায়, পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই। বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাবুল আক্তারের পাশাপাশি তাঁর দুই পরিচিত গাজী আল মামুন ও সাইফুল হকও আদালতে সাক্ষী হিসেবে কথা বলতে রাজি হন।
চট্টগ্রামে যখন বাবুল ও তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদারদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল, ওই সময়ে অর্থাৎ সোমবার মাহমুদা খানম মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনকেও পিবিআইয়ের ঢাকা কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া হয়। মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘পিবিআই বলল তারা মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে। আমি নতুন মামলার বাদী হতে চাই কি না। আমার মেয়ে, আমি তো বাদী হবই। আমি বাবুলকে আসামি করে মামলা করতে রাজি হয়ে যাই।’ মঙ্গলবার পিবিআই গাড়িতে করে চট্টগ্রামে পৌঁছে দেন মোশাররফকে। বুধবার তিনি বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন।
এজাহারে যা আছে
পিবিআই এর উপমহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, তাঁদের তদন্তের শুরুটা হয়েছিল একটা প্রশ্নের জবাব খোঁজার মধ্য দিয়ে। সেটা হলো ঘটনাস্থলে মুসা থাকার পরও কেন তাঁকে শনাক্ত করতে পারলেন না বাবুল আক্তার। তিনি আরও বলেন, বাবুল আক্তার একজন চৌকস কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি মুসাকে দায়ী না করে জঙ্গিদের ওপর দায় চাপান এবং জানান মিতু হত্যাকাণ্ডের দিন কয়েক আগে জঙ্গিরা তাঁর ওপর হামলা করেছিল। হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর যে আচরণ তা-ও ছিল অতি প্রিয়জন হারানোর পর মানুষ যেভাবে শোক করেন তেমনই।
এজাহারে মোশাররফ হোসেন একই প্রশ্ন তুলেছেন। পাশাপাশি লেখেন, জাতিসংঘে কর্মরত একজন নারীর সঙ্গে পরকীয়ার কারণে তাঁর মেয়ের সঙ্গে জামাইয়ের দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছেছিল। মোশাররফ লেখেন, ‘হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দানকারী ২ নং বিবাদী মো. কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুসা তাঁর (বাবুল আক্তারের) দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ও পারিবারিকভাবে পরিচিত সোর্স হওয়া সত্ত্বেও সুকৌশলে তাঁকে শনাক্ত না করে জঙ্গিদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে মর্মে দাবি করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা করে।’
মোশাররফ আরও লেখেন, বাবুল আক্তার পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়লে পরিবারে চরম অশান্তি দেখা দেয়। এ নিয়ে প্রতিবাদ করায় মিতুকে বাবুল আক্তার বিভিন্ন সময় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। মিতুর বাবা এজাহারে ওই নারীর সঙ্গে বাবুল আক্তারের বিনিময় কিছু খুদে বার্তার উল্লেখ করেন।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
মিতু হত্যাকাণ্ডের সময় পুলিশ মহাপরিদর্শক ছিলেন শহীদুল হক। মিতু হত্যার মোড় বদলের সঙ্গে সঙ্গে শহীদুল হকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কেন এত বছরেও হত্যা রহস্যের উদ্ঘাটন হলো না, কেন মুসা এখনো নিখোঁজ, এসব বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন পুলিশের একাধিক সংস্থার কর্মকর্তারা।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, বাবুল আক্তারকে ছাড় দেওয়ায় তাঁরা নিজেরাই পরিবারের কাছে ছোট হয়েছেন। পরিবার ও সমাজের কাছে এমন একটা বার্তা গেছে যে পুলিশ কর্মকর্তারা স্ত্রীকে খুন করলেও বিচার হবে না। তাঁদের দিক থেকেও ন্যায়বিচারের তাগাদা ছিল।
এসব বিষয়ে শহীদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘একটা তো কমিটি হয়েছিল। তদন্ত কর্মকর্তারা আমাকে জানান এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা। তিনি পলাতক। তাঁকে ধরার চেষ্টা চলছে। আমি বলেছি তোমরা চেষ্টা করো।’ এর বেশি কিছু বলেননি তিনি।
শঙ্কা এখন বাবুল-মিতুর সন্তানদের নিয়ে
বাবুল আক্তার তাঁর নতুন স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে মোহাম্মদপুরের একটি বাসায় থাকেন। গত তিন-চার বছর সন্তানদের সঙ্গে নানা-নানিকে যোগাযোগ করতে দেননি। বাবুল আক্তার গ্রেপ্তার হওয়ায় শিশুসন্তানদের নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন মোশাররফ হোসেন ও সাহেদা মোশাররফ।
পিবিআই জানিয়েছে, মোশাররফ হোসেন তাঁদের অনুরোধ করেছেন প্রয়োজনে বাবুল আক্তারের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে যেন এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত জানানো হয়। সাহেদা মোশাররফ বলেন, বাবুল গ্রেপ্তারের পর থেকে অনবরত তিনি বাবুলের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। সবার ফোন বন্ধ। নাতি-নাতনিদের নিয়ে তিনি ভীষণ শঙ্কায় রয়েছেন।
২০১৬ সালের ৫ জুন ছেলেকে স্কুলবাসে উঠিয়ে দিতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন মিতু। তখনই তাঁকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মামলার তদন্তে যুক্ত কর্মকর্তারা সে সময় বলেছিলেন, ঘটনাস্থলের ফুটেজে দেখা যায় খুনিরা মোটরসাইকেল দিয়ে ধাক্কা দিয়ে মিতুকে ফেলে দিয়েছে। খুনিরা তাঁকে কোপ দিচ্ছে আর তাঁর প্রথম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে মায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দলের একজন ছেলেটির হাত টেনে ধরে আছে। খবর প্রথম আলো।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.