ইয়ানূর রহমান : অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) ভাইস চ্যান্সেলর পদে ২০১৭ সালের ২০ মে যোগদান করেন। চাকরির প্রথম মেয়াদে তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ৫৫ টি অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে তিনি ২০২১ সালের ১৯ মে ভিসি পদের মেয়াদ শেষ করেন। একই বছরের ১ জুন অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন দ্বিতীয় মেয়াদে আবারো ভিসির দায়িত্ব পান।
অভিযোগ উঠেছে, নানা দুর্নীতির মধ্যে তিনি যবিপ্রবির ১৪টি লিফট স্থাপন নিয়ে ১০ কোটি টাকার অনিয়ম করে আলোচিত হন। তার অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। আর লিফট কাণ্ডে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা বাসিন্দা আব্দুল করিম। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)-এ রয়েছে ড. আনোয়ার হোসেনের দুর্নীতির ফাইল।
বিভিন্ন দপ্তরে দেয়া ১০ জন শিক্ষক স্বাক্ষরিত লিখিত অভিযোগে ৫৫ টি অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা বলা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিগুলো হলো যবিপ্রবি’র রিজেন্ট বোর্ডে পাশ করা ২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল (২৩/২৯তম) শিক্ষক নিয়োগ ও আপগ্রেডেশন নীতিমালা অমান্য করেন। নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা গবেষণা ভাতা গ্রহণ করেন, যা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) আপত্তি জানায়। সরকারি বিধিমালা লঙ্ঘন করে উপাচার্য ক্যাম্পাসে অবস্থানকালীন দিন প্রতি ১২৫ টাকা ভাড়া দিয়ে উপাচার্যের জন্য নির্ধারিত বাংলো সম্পূর্ণ ব্যবহার করেন এবং বাংলোর সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন, যা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) আপত্তি দেন। ২০১৪ সালের ৩০ জুন উপাচার্যের জন্য নির্ধারিত বাংলো ১ম পর্যায়ে নির্মাণ কাজ ১০০ ভাগ সমাপ্ত হয়েছে বলে নিশ্চিতকরণ হয় এবং ২০২০ সালে ৩০ লাখ টাকা দিয়ে পুনরায় মেরামত করা হলেও উপাচার্যের বাংলো নির্মাণাধীন বলে বাড়ি ভাড়া ফাঁকি দিয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতি করেন। ঢাকায় উপাচার্যের পরিবারের সদস্যদের বসবাসের জন্য বাড়ি ভাড়া বাবদ নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রতি মাসে ৬০ হাজার টাকা গ্রহণ করেন। উপাচার্যের দফতর থেকে অস্তিত্বহীন কর্মচারীর নামে বেতন উত্তোলন করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করতেন তিনি।
উপাচার্য নিজে লিফট প্রিশিপমেন্ট ইন্সপেকশন কমিটির মনোনীত সদস্য হিসেবে লিফট প্রিশিপমেন্ট ইন্সপেকশন না গিয়ে অবৈধভাবে প্রভাব খাটিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে ভ্রমণ ভাতা/বিমান ভাড়া হিসেবে ঠিকাদারের কাছ থেকে টাকা নেন।
উপাচার্যের নিয়োগ বাণিজ্যের সিন্ডিকেটের দাবি করা ১৭ লাখ টাকা দিতে না পারায় ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) পদে মুনজুরুর রহমান নামে এক যুবকের চাকরি হলেও যোগদান করতে দেননি। বিনা টেন্ডারে প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে আরএফকিউ পদ্ধতিতে নিজের অফিস ডেকোরেশন ও আপন বোনকে দিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ভবনে এসি সরবরাহ এবং ঢাকার নিজ বাসভবন সজ্জিত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নীতিমালা অমান্য করে বিধি বহির্ভূতভাবে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি প্রদান ও এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে স্থানান্তর করেন। রাষ্ট্রপতির নিয়োগ করা বিশেষজ্ঞ সদস্য ব্যতিরেকে নিজের পছন্দের সদস্যদের দিয়ে বিভিন্ন নিয়োগ বোর্ড গঠন করে নিয়োগ সম্পন্ন করেন। যবিপ্রবির আইন-২০০১ এর প্রথম সংবিধি, ধারা ৩৭(২), (৮) অমান্য করে বিধি বহির্ভূতভাবে বিভিন্ন বিভাগের প্লানিং কমিটি গঠন করেন। যবিপ্রবির আইন-২০০১ এর বিভাগ সংক্রান্ত ২৫(৩) ধারা অমান্য করে বিধি বহির্ভূতভাবে বিভাগীয় চেয়ারম্যান নিয়োগ প্রদান করেন। টিওই-এর অনুমোদনবিহীন ফিজিওথ্যারাপী অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগ চালু করেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত অমান্য করে পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া ৩৫ বছর বয়সের ফিরোজ কবিরকে শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগে নিয়োগ দেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত অমান্য করে পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া ফিরোজ কবিরের স্ত্রী শর্মিলা জাহানকে ৩৩ বছরের অধিক বয়সে ফিজিওথ্যারাপী এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ প্রদান করেন। কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও নিয়োগ বোর্ড ছাড়াই ফিরোজ কবিরকে একটি পত্রের মাধ্যমে শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগ হতে ফিজিওথ্যারাপী অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ প্রদান করেন।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত অমান্য করে ও বাছাই কমিটির সুপারিশ ভেঙে মেডিকেল অফিসার পদে সিএসই বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গালিব এর স্ত্রী ডা. নুসরত জামানকে ৩৫ বছর ১১ মাস বয়সে নিয়োগ প্রদান করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. আমজাদ হোসেন আরও অভিযোগ করেন, ৩ বছর ১১ মাসে যবিপ্রবির ক্যাম্পাস ৩৫ একর থেকে উন্নীত করতে নতুন ভূমি অধিগ্রহণ প্রকল্প আনতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ এবং প্রশাসনিক অদক্ষতার পরিচয় দেন। সাবেক উপাচার্যের আমলে বরাদ্দ করা ২৮২ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প ৩ বছর ১১ মাসে বেশিরভাগ প্রকল্প সম্পন্ন ও ব্যবহার উপযোগী করতে ব্যর্থ হন।
মুনশী মেহেরুল্লাহ ছাত্র হল (১০ তলা ভিতে ১০ তলা ভবন ১০০০ আসন বিশিষ্ট হল) নির্মাণ কাজ সম্পন্ন ও ব্যবহার উপযোগী করতে, বীর প্রতীক তারামন বিবি হল (২য় ছাত্রী হল ১০ তলা ভিতে ১০ তলা ভবন ১০০০ আসন বিশিষ্ট হল) নির্মাণ কাজ সম্পন্ন ও ব্যবহার উপযোগী করতে, ২য় একাডেমিক ভবন (১০ তলা ভিতে ১০ তলা ভবন) নির্মাণ কাজ সম্পন্ন ও ব্যবহার উপযোগী করতে তিনি ব্যর্থ হন।
এছাড়া টিএসসি ভবন নির্মাণ কাজ ৩ বছর ১১ মাসে সম্পন্ন ও ব্যবহার উপযোগী করতে ব্যর্থ হয়েছেন সদ্য বিদায়ী উপাচার্য। কেন্দ্রীয় চিকিৎসা কেন্দ্র ভবন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলেও সেখানে ক্রয় করা চিকিৎসা সরঞ্জাম যেমন- এক্সরে মেশিন, ইসিজি, মিনি ওটি ইত্যাদি চালু করা হয়নি।
গ্লাস ও প্রাণী হাউস (১ তলা ভবন) নির্মাণ করার জন্য ডিপিপিতে আলাদা ভবন নির্মাণ করার কথা থাকলেও নিয়ম বহির্ভূতভাবে ৯ তলা বিশিষ্ট একাডমিক ভবনের ৯ম তলাতে শুধুমাত্র প্রাণী হাউস নির্মাণ করেন যা এখনও পর্যন্ত অসম্পূর্ণ। অন্যদিকে গ্লাস হাউস নির্মাণ কাজ যাওয়ার আগে তিনি শুরু করতেও পারেনি। তিনি অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণ ও মেজর সারফেজ ড্রেন নির্মাণ কাজে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন যা ডিপিপিতে উল্লেখ থাকলেও এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি। বিভিন্ন ভবনে অগ্নি শনাক্তকরণ ও সুরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের ক্ষেত্রে চরম অবহেলা ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন আনোয়ার হোসেন।
বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও কেমিক্যাল, আসবাবপত্র, টেলিফোন ও পিএবিএক্স, জেনারেটর ও লিফট (২য় একাডেমিক ভবন, ২য় ছাত্র হল, ২য় ছাত্রী হল ও টিএসসি ভবনের জন্য) ক্রয়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থ এবং প্রশাসনিক অদক্ষতার পরিচয় দেন উপাচার্য। যবিপ্রবির নতুন একাডেমিক ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প আনতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ এবং প্রশাসনিক অদক্ষতার পরিচয় দেন তিনি। বিভিন্ন বিভাগের জন্য নতুন ল্যাবরেটরি উন্নয়ন প্রকল্প আনতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। চাকরির বাজারের চাহিদার কথা বিবেচনা করে তিনি নতুন একাডেমিক ইন্ডাস্ট্রি কোলাবরেশন করতে পারেননি। উপাচার্যের জন্য নির্ধারিত গাড়ি থাকলেও আনোয়ার হোসেন প্রায় ৯৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নিজের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি ক্রয় করেন। এছাড়া বাড়ির ব্যক্তিগত ড্রাইভার আরিফকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ড্রাইভার পদে ও আরিফের বোন ফাতেমাকে অফিস সহায়ক পদে নিয়োগ দেন। লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও নিরাপত্তা প্রহরী বসির উদ্দীনকে সহকারী স্টোর কিপার পদে দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ায় মতো আরও অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনে শিক্ষক সমিতি।
যবিপ্রবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. আমজাদ হোসেন জানিয়েছেন, ভাইস চ্যান্সেলর ড. আনোয়ার হোসেন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকটা পেছনে নিয়ে গেছেন। তিনি পছন্দের কিছু লোকজন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির রামরাজত কায়েম করেছেন। বর্তমানে তার পদত্যাগের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্য বিরোধী শিক্ষকরা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। তিনি নিজের ইচ্ছায় পদত্যাগ না করলে আন্দোলন করা হবে।
এই বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য বৃহস্পতিবার খোঁজ নিয়েও ড. আনোয়ার হোসেনকে কর্মস্থলে পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোনে কল করা হলেও বন্ধ পাওয়া যায়। পরে হোয়াটসঅ্যাপে কল করলেও ড. আনোয়ার হোসেন রিসিভ করেননি। তবে বিগত দিনে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছিলেন ভাইস চ্যান্সেলর ড. আনোয়ার হোসেন। ২০২১ সালের ২০ মে অভিযোগে তার বিরুদ্ধে প্রেসক্লাব যশোরে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেছিলেন যবিপ্রবির তখনকার শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. আমজাদ হোসেন। তখনও সাংবাদিকদের কাছে সকল অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছিলেন ড. আনোয়ার হোসেন।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.