মিয়ানমারে কোনো রোহিঙ্গা নেই সব ‘বাঙালি অনুপ্রবেশকারী’

ওয়ান নিউজ ডেক্সঃ মিয়ানমারের রাজধানী নেইপিদাওতে সশস্ত্র বাহিনীর একটি প্যারেডে সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং লেইং বলেন, ‘আমরা বিশ্বকে আগে বলেছি যে আমাদের দেশে কোনো রোহিঙ্গা নেই। রাখাইন রাজ্যে যেসব বাঙালি আছে তারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়।’ রোহিঙ্গাদেরকে একটি খারাপ শব্দে গালি দিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, ‘তারা ওই ধরনের লোক যারা উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন।’

মিন অং আরও বলেন, ‘আমাদের কী করা উচিত সে ব্যাপারে আইন অনুযায়ী আমাদের দায়িত্ব আছে। আমাদের সার্বভৌমত্বকে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও বর্ণবৈষম্যজনিত সংকট থেকে সুরক্ষিত রাখারও দায়িত্ব আছে আমাদের।’

এরই সঙ্গে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে জাতিসংঘে পাস হওয়া তদন্ত প্রস্তাবকে সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি বলে মনে করছেন মিন অং। ক’দিন আগে সু চির নেতৃত্বাধীন পররাষ্ট্র দফতর থেকেও তদন্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।

সেনাবাহিনী থেকে কথাগুলো সেই সময়ে আসে যখন সু চির নেতৃত্বাধীন এনএলডি (ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি) ক্ষমতায় এক বছর পূর্ণ করছে। আগামী ৩০ মার্চ মিয়ানমারের ক্ষমতায় এক বছর পূর্তি করতে যাচ্চে এনএলডি। নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ে ক্ষমতায় বসেছিল এনএলডি। এর মাধ্যমে দীর্ঘ ৫০ বছরের কঠোর সামরিক শাসনের ইতি টানা হয়েছিল। তবে সেনাবাহিনী এখনো মিয়ানমারের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। মূলত সামরিক-বেসামরিক সরকার মিলেমিশেই কাজ করে যাচ্ছে মিয়ানমারে।

সর্বশেষ সেনাপ্রধানের বিরোধিতায় এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে মিয়ানমারের সিভিল-মিলিটারি ডি ফ্যাক্টো সরকার অন্তত রোহিঙ্গা ইস্যুতে একই লাইনে শক্তভাবে অবস্থান করছে। দুই পক্ষেরই জাতিসংঘ-তদন্ত বিরোধী অবস্থান স্পষ্ট।

গত ২৪ মার্চ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানোর একটি প্রস্তাব জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে অনুমোদিত হয়। সিদ্ধান্ত হয়, রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তের জন্য দেশটিতে সত্য অনুসন্ধানকারী দল পাঠাবে জাতিসংঘ। ওই প্রস্তাবে বলা হয়, দোষীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ওই তদন্ত শুরু হবে। সেপ্টেম্বরে তদন্তকারীরা মৌখিকভাবে তদন্তের তথ্য জানাবে আর আগামী বছরের একই সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেবে। চীন, ভারত, কিউবাসহ কয়েকটি দেশ ওই প্রস্তাব থেকে বিচ্যুত থেকেছে।

গত বছর অক্টোবর মাসের ৯ তারিখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের একটি এলাকায় সন্ত্রাসীদের সমন্বিত হামলায় ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার দায় চাপানো হয় রোহিঙ্গাদের ওপর। আর তখন থেকেই শুরু হয় সেনাবাহিনীর দমন প্রক্রিয়া। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দাবি, এরপর থেকেই রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাস নির্মূলে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

অবশ্য জাতিসংঘ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জাতিগতভাবে নির্মূল করার অভিযোগ এনেছে। তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডেরও অভিযোগ তোলা হয় দুই দফায়। এবারের সংঘর্ষে রাখাইন রাজ্যের মৃতের সংখ্যা ৮৬ জন বলে জানিয়েছে তারা। জাতিসংঘের হিসাব মতে, এখন পর্যন্ত ঘরহারা হয়েছেন ৩০ হাজার মানুষ। পালাতে গিয়েও গুলি খেয়ে মরতে হচ্ছে তাদের। ২০১২ সালে মিয়ানমার সরকারের মদদপুষ্ট উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের তাণ্ডবে প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা নিহত হন। ঘর ছাড়তে বাধ্য হন ১ লাখেরও বেশি মানুষ।

গত জানুয়ারিতে কো নি নামে এক শীর্ষ মুসলিম আইনজীবিকে গুপ্তহত্যার পেছনে সাবেক সেনা কর্মকর্তারা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। অং সান সু চির আইন উপদেষ্টা ও মুসলিম নেতাকে হত্যার পেছনে যেটা প্রধান কারণ হতে পারে সেটা হলো তিনি এমন এক সংবিধানের খসড়া করছিলেন যেখানে সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকে খর্ব করার পরামর্শ ছিল।

দালাইলামা ও পোপ ফ্রান্সিসসহ বিশ্বনেতারা দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর আক্রমণের নিন্দা জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনী ও সরকার মনে হয় সেদিকে কান না দেওয়ার ব্যাপারেই ঐক্যমত্যে আছে।

সূত্র : দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ড

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.