‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পারমিশন পেলে টুমুরো যাবো’
নেপাল একটি ছোট দেশ। পাহাড়বেষ্টিত এই দেশটির আয়ের মূল উৎস পর্যটন। শুধু হিমালয় নয়, আরো বেশ কয়েকটি উচু পর্বতমালা রয়েছে নেপালে। বিশ্বের সবচেয়ে উচু পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের অবস্থানও নেপালেই। এই পাহাড়ের টানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন নেপালে। পর্যটকদের স্বাগত জানাতে চাই একটি ভালো আন্তর্জাতিকমানের বিমানবন্দর। কিন্তু একটি ভালো বিমানবন্দর বানানোর মতো পর্যাপ্ত সমতল ভূমি নেই কাঠমান্ডুর আশেপাশে। তাই বিশ্বের সবচেয়ে ঝূঁকিপূর্ণ বিমানবন্দর দিয়েই চলছে পর্যটননির্ভর নেপাল।
৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ত্রিভূবন বিমানবন্দরে ৭০টি দুর্ঘটনায় ৬৫০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। শুধু যে বিমানবন্দর ঝূকিপূর্ণ তাই নয়, নেপালের চিকিৎসা ব্যবস্থাও খুব একটা উন্নত নয়। বাংলাদেশের তুলনায় বেশ খারাপই। নেপালের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়মিত বাংলাদেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়তে আসেন।
কাঠমান্ডুতে বিধ্বস্ত ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে আরো অনেকের সাথে নেপালের ১৩ শিক্ষার্থীও ছিলেন। এরা সবাই সিলেটের রাগিব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, যারা পরীক্ষা শেষে বাড়ি যাচ্ছিল। নেপালের সবচেয়ে অভিজ্ঞ বার্ন বিশেষজ্ঞও বাংলাদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া। এমনিতে নেপালের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে আমার বা বাংলাদেশের মানুষের কোনো আগ্রহ নেই।
বাংলাদেশের মানুষ উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত যায়, থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরে যায়। তবুও হঠাৎ করে নেপালের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগের কারণ বাংলাস্টার ২১১। ১২ মার্চ সোমবার দুপুর ২টা ১৮ মিনিটে ‘২০’ আর ‘০২’ রানওয়ের বিভ্রান্তিতে ৬৭ যাত্রী আর ৪ ক্রু নিয়ে বিধ্বস্ত হয় ইউএস-বাংলার ফ্লাইটটি।
প্রথম দিনেই ২৫ বাংলাদেশীসহ ৪৯ জন প্রাণ হারান। পরদিন প্রাণ হারান বিমানটির পাইলট আবিদ সুলতান। পরে আরো একজন মারা গেলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫১তে। আবিদ সুলতানের মৃত্যুর পরও আরো ১০ বাংলাদেশী নেপালের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আমার উদ্বেগ এই আহতদের নিয়ে।
আমার পয়েন্ট হলো, দুর্ঘটনার পরপরই আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সেখানে পাঠানো হলো না কেন? কেন এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে আহতদের বাংলাদেশে বা সিঙ্গাপুরে পাঠানো হলো না? আমার বোঝার ভুল থাকতে পারে। কিন্তু আমি চাই, আহতদের দ্রুত ও সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা। দুর্ঘটনার দুদিন পর গুরুতর আহত একজনকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছে।
একজনকে ভারতে পাঠানো হচ্ছে। তিনদিন পর বৃহস্পতিবার আহত একজন ঢাকায় ফিরে এসেছেন। শুক্রবার ফিরেছেন আরো তিনজন। দুর্ঘটনার তিনদিন পর বাংলাদেশের একটি মেডিকেল টিম নেপাল গেছে। আমার আবারও একই প্রশ্ন, এই টিমটি ঘটনার দিনই নেপালে গেল না কেন?
দুর্ঘটনার পর ঘণ্টাচারেক ত্রিভুবন বিমানবন্দর বন্ধ ছিল। চালু হওয়ার পর সেদিন সেদিন সন্ধ্যায় রিজেন্ট এয়ারের একটি ফ্লাইট কাঠমান্ডু উড়ে গেছে। সেই ফ্লাইটে ইউএস-বাংলার দুইজন এবং সিভিল এভিয়েশনের দুজন কর্মকর্তা কাঠমান্ডু গেছেন।
কিন্তু সেই ফ্লাইটে কেন বিমানমন্ত্রী গেলেন না, কেন সিভিল এভিয়েশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গেলেন না, কেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা গেলেন না?- এই প্রশ্নের একটা উত্তর আমি জানি। সেটাতে একটু পরে আসছি।
তবে এইসবই আমার মত না বোঝা বোকা মানুষের প্রশ্ন। এর নিশ্চয়ই অনেকগুলো আমলাতান্ত্রিক উত্তরও আছে। ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পরও কেন মেডিকেল টিম পাঠানো হলো না, এ নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার পর অনেকে অনেক সমস্যার কথা বলেছেন। কেউ কেউ বলছেন, ‘টিম রেডি ছিল। কিন্তু নেপাল অনুমতি দিচ্ছিল না। তারা দাবি করছিল, আহতদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য তারাই যথেষ্ট দক্ষ। এটা তাদের জাতিগত অহং-এরও বিষয়।’ আগেই বলেছি, আমি একটু বোকাসোকা, কম বোঝা মানুষ। কূটনীতি, দুই দেশের সম্পর্ক ইত্যাদি ইত্যাদি বুঝি না।
আমি খালি বুঝি মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য যা করার দরকার তাই করতে হবে। আহতদের মধ্যে যেহেতু বাংলাদেশের নাগরিক আছে, তাই নেপালের অহং বিবেচনায় নেয়ার কোনো সুযোগই ছিল না।
নেপালে যেহেতু অন অ্যারাইভাল ভিসা তাই মন্ত্রী, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞরা সেদিন সন্ধ্যায়ই উড়ে যেতে পারতেন। নেপালের সাথে দরকষাকষিটা নেপালের মাটিতে বসেই হতে পারতো। তিন দিন পর নেপাল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের মেডিকেল টিমকে অনুমতি দিল, তাহলে প্রথম দিন দিলো না কেন?
এই প্রশ্নের উত্তরও আমি জানি। সেটাও পরে বলছি। প্রথম দিনেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং মেডিকেল টিমের না যাওয়ার জন্য অনেকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথাও বলেছেন। প্রশ্নটা যখন মানুষের জীবনের, তখন যে আমলাতন্ত্র বাধা হতে পারে, সে আমলাতন্ত্র না থাকলে কী হয়? ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স’ বলে যে একটা টার্ম আছে, আমরা যেন ভুলেই গিয়েছিলাম।
দুর্ঘটনার অন্তত ৫ ঘণ্টা পরও বেসামরিক বিমানমন্ত্রী শাহজাহান কামাল সাংবাদিকদের নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছিলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বারবার ক্ষেপে যাচ্ছিলেন। বিধ্বস্ত বিমানটির প্যাসেঞ্জার লিস্ট যখন সাংবাদিকদের হাতে হাতে, সকল টিভির স্ক্রলে যখন যাত্রীদের নাম যাচ্ছিল; তখনও মন্ত্রী বলছিলেন, বিমানে বাংলাদেশি ৪৩ জন যাত্রী এবং ৪ জন ক্রু ছিলেন।
অথচ বিধ্বস্ত বিমানটিতে সব মিলিয়ে বাংলাদেশি ছিলেন ৩৬ জন। প্যাসেঞ্জার লিস্ট পাওয়া বিমানমন্ত্রীর জন্য এক মিনিটের ব্যাপার হওয়ার কথা। তাৎক্ষণিকভাবে এইটুকু বিভ্রান্তি না হয় মেনে নেয়া যায়। কিন্তু মন্ত্রী যখন বলেন, ‘চেষ্টা করতেছি, টুমুরো আমি নিজেই যাওয়ার চিন্তা করবো। আমি ব্যক্তিগতভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করতেছি। ওনার পারমিশন নিয়ে যাবো।’ বিমানমন্ত্রীর কথা শোনার পর আমার সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাই।
দুর্ঘটনার সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিঙ্গাপুর সফরে ছিলেন। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তিনি সিঙ্গাপুর থেকেই নেপালের প্রধানমন্ত্রী খাদগা প্রসাদ শর্মা অলির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। নেপালের প্রধানমন্ত্রী হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেন। খাদগা প্রসাদ শর্মা অলি জানান, দুর্ঘটনা ঘটার পর তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ত্রিভুবন বিমানবন্দর খোলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাহায্যকারী দল নেপালে পাঠাবেন। তিনি আরো বলেন, প্রয়োজনীয় যত রকমের সাহায্য দরকার বাংলাদেশ তা করবে।’ কিন্তু সেই দল পাঠাতে তিন দিন লেগেছে।
সফর সংক্ষিপ্ত করে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে দ্রুতই ব্যবস্থা নেন। ততক্ষণ সবকিছু আটকে ছিল। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে পরদিনই সিনিয়র মন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে বসেন, তিন দিন পর রাষ্ট্রীয় শোক পালনের সিদ্ধান্ত হয়, মেডিকেল টিম পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
সন্ধ্যায় দলের নেতাদের সাথে বৈঠক করে আহত-নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে বলেন। পরদিনই ওবায়দুল কাদের ছুটে যান আহতদের বাসায়। যেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের আগে নিহতদের বাসায় গেলে ওবায়দুল কাদেরের চাকরি চলে যেতো! এমনিতে বাংলাদেশে ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স’ খুব ভালো। কিন্তু সেটা ব্যক্তিনির্ভর।
কোনো ঘটনা শেখ হাসিনার কান পর্যন্ত পৌছালেই সবার দায়িত্ব শেষ। যে কোনো খবর পেলেই প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নেন, খোঁজ নেন। এই তো কদিন আগে সিলেটে হামলার শিকার ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে সেদিনই এয়ার অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে ঢাকায় আনা হয় এবং সিএমসএইচে ভর্তি করা হয়।
শেখ হাসিনার এমন তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়ার, দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার অসংখ্য নেয়ার অসংখ্য উদাহরণ আছে। বড় দুর্ঘটনায় তিনি রাতভর ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ নেন। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ট্র্যাজিক বিমান দুর্ঘটনার সময় শেখ হাসিনা দেশের বাইরে ছিলেন।
এ কারণেই বিমানমন্ত্রীর নেপালে যেতে তাঁর অনুমতি লাগে, মেডিকেল টিম যেতে তিন দিন লাগে, আওয়ামী লীগ নেতাদের নিহতদের বাসায় যেতে ৭৮ ঘণ্টা লাগে। আমি নিশ্চিত প্রধানমন্ত্রী দেশে থাকলে ত্রিভুবন বিমানবন্দর খোলার সাথে সাথে প্রথম সুযোগেই মন্ত্রী, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সাহায্যকারী দল, ডাক্তার- সবাই ছুটে যেতেন।
এমনকি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে আহতদের সেদিনই বাংলাদেশে আনিয়ে নিলেও আমি অবাক হতাম না। আওয়ামী লীগ নেতারাও ছুটে যেতেন হতাহতদের স্বজনদের পাশে। দেশের সবচেয়ে বড় বিমান দুর্ঘটনার পর যখন বিমানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর পারমিশন পেলে তিনি টুমুরো’ ঘটনাস্থলে যাওয়ার চিন্তা করবেন, তখন বুঝি সিস্টেমে বড় রকমের সমস্যা আছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দক্ষতা অকল্পনীয়। তিনি সবকিছুই খুটিনাটি খোঁজ রাখেন। বিমান দুর্ঘটনায় যে আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিআরআই’এর একজন কর্মীও সপরিবারে মারা গেছেন, সেটাও প্রধানমন্ত্রী জানেন। এখন বাংলাদেশে শেখ হাসিনাই শেষ ভরসা।
এ কারণেই সবাই সব ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এর আগে অনেকবার প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপে অনেক জটিল সমস্যা মিটে গেছে নিমেষেই। আমরা ভাগ্যবান শেখ হাসিনার মত ক্বরিৎকর্মা ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার দক্ষতাসম্পন্ন একজন মানবিক মানুষ আমাদের প্রধথানমন্ত্রী। কিন্তু একই সঙ্গে এই ঘটনা সুশাসনের বড় ঘাটতিটাও আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
এখন প্রধানমন্ত্রী কখনো দেশের বাইরে গেলে আমি অন্তত শঙ্কিত থাকবো- কখন কী ঘটে যায় কে জানে। তাহলে কি প্রধানমন্ত্রী এখন আর দেশের বাইরে যাবেন না। বসে বসে বাংলাদেশ পাহারা দেবেন। তাহলে আর এতো মন্ত্রী, উপদেষ্টা, এমপি, নেতা, আমলা দিয়ে কী হবে?
প্রভাষ আমিন : সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তা প্রধান : এটিএন নিউজ।
probhash2000@gmail.com
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.