নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের কাকপাড়া ও জালিয়াপাড়া থেকে বলপূর্বক ৭৭টি বসতি উচ্ছেদের অভিযোগ ওঠেছে ইউপি চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ ওয়াসিমের বিরুদ্ধে। পৈত্রিক বসতবাড়ি হারিয়ে বর্তমানে এসব পরিবারের প্রায় ৪ শতাধিক মানুষ চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মগনামা ইউনিয়নের দক্ষিণ পশ্চিম অংশে কাঁকপাড়া এলাকায় ১৯৫১ সালে মনুষ্য বসতির উদ্যোগ নেন তৎকালীন জমিদার আব্দুল আজিজ চৌধুরী। সেখানে ১৯৫৪ সালে ৩ একর ৪২ শতক জমি নিয়ে বসতভিটে স্থাপন করেন তার পুত্র জিল্লুল করিম চৌধুরী। সেসময় মগনামার বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজন কাঁকপাড়া গিয়ে বসতি স্থাপন শুরু করেন। ১৯৬০ ও ১৯৯১ সালে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা পরবর্তী ঝুঁকি অনুধাবন করে সাইক্লোন শেল্টারের জন্য এক একর জমি দান করেন জিল্লুল করিম চৌধুরী। সে জমিতে তৎকালীন সময়ে একটি সাইক্লোন শেল্টার স্থাপন করা হয়। পরে এলাকার নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে বিদ্যালয়ের স্থাপনের জন্য এক কানি জমি দান করেন তিনি।
১৯৯৬ সালে সে জমিতে একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। যা পরে সরকারীকরণ করা হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়টি উপকূলীয় অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক অবদান রাখছে। দীর্ঘ ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে এ পাড়ায় বসবাস করে আসছিল অর্ধশত পরিবার। পরবর্তী সময়ে কাঁকপাড়ার পাশে গড়ে ওঠে জালিয়াপাড়া নামের আরেকটি পাড়া। এসব পাড়ার বাসিন্দাদের অভিযোগ, মাস খানেক আগে জোরপূর্বক ভাবে এ দুইটি গ্রামের বসতি গুলো উচ্ছেদ করে দেন মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ ওয়াসিম। কাঁকপাড়ার বাসিন্দা ফজল করিমের ছেলে নাজির হোসেন প্রকাশ নন্না মিয়া বলেন, মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে কাঁকপাড়া ও জালিয়াপাড়াকে মগনামার মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার মিশনে নামে শরাফত উল্লাহ ওয়াসিম। এর নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে সর্বপ্রথম নিধনে নামেন কাঁকপাড়া গ্রামের স্থপতি জিল্লুল করিম চৌধুরী পরিবারের সদস্যদের। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল রাতে কক্সবাজারের একটি হোটেল থেকে ডিবি পুলিশের মাধ্যমে আটক করানো হয় জিল্লুল করিম চৌধুরীর পুত্র ও মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইউনুছ চৌধুরীকে। তাকে ৪টি অস্ত্র ও ২ হাজার ইয়াবা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় ডিবি পুলিশ।
ইউনুৃছ চেয়ারম্যান কারাগারে থাকাকালীন তার বাড়ীর পার্শ্ববর্তী ভোগদখলীয় ১০৭ একরের চিংড়ি ঘেরটি সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে জবরদখল করে নেয় চেয়ারম্যান ওয়াসিম। এবিষয়ে ইউনুছ চেয়ারম্যানের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বাদী হয়ে চকরিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন। এতে ওয়াসিম চেয়ারম্যানকে প্রধান আসামী করা হয়। এ মামলায় চেয়ারম্যান ওয়াসিমসহ অপর আসামীদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পিবিআই। তিনি আরো বলেন, এ ঘটনায় প্রায় ৯ মাস কারাভোগের পর মুক্তি পেলে ২০১৮সালের ১২জানুয়ারি মগনামা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে ইউনুছ চেয়ারম্যানকে গণসংবর্ধনা দেয় মগনামার সর্বস্তরের জনগণ। গণসংবর্ধনায় কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতারা আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের নিধন না করার জন্য ওয়াসিম চেয়ারম্যানকে হুশিয়ারি দেন। কিন্তু সে হুশিয়ার উপেক্ষা করে ১৩ জানুয়ারি বাড়ী থেকে তুলে এনে ইউনুছ চেয়ারম্যানকে হত্যাচেষ্টা চালায় ওয়াসিম ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী। ইউনুছ চেয়ারম্যানকে কুপিয়ে জখম করাসহ চোখ তুলে নেবার চেষ্টা চালায় তারা। একইদিন তৎকালীন কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
এর পরদিন থেকে নিরাপত্তার জন্য ইউনুছ চেয়ারম্যানের কাঁকপাড়ার বাড়ীতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ পাহারা থাকা মাঝেও রাতে ইউনুছ চেয়ারম্যানের বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এসব ঘটনায় পেকুয়া থানায় দুটি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। মামলা দুটি দীর্ঘদিন তদন্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন পিবিআই। এতে ওয়াসিমকে ূূল অভিযুক্ত রাখা হয়। ভুক্তভোগী ও মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাবেক চেয়ারম্যান ইউনুছ চৌধুরী বলেন, নানা নির্যাতন চালিয়ে আমাকে আমার পৈত্রিক বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দিয়েছে বিএনপি নেতা ওয়াসিম চেয়ারম্যান। তার নির্দেশে আমার চারতলা ফাউন্ডেশনের একতলা বিল্ডিং বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়। পৈত্রিক বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে আমরা এখন অন্যত্র বসবাস করছি। মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান শরাফত উল্লহ ওয়াসিম শুধুমাত্র আমার বসতভিটে নয় কাঁকপাড়া গ্রামের সাইক্লোন শেল্টার ও স্কুলের জমি জবরদখল করেছে। সেখানে এখন বিরাণভূমি বানিয়েছে ওই বিএনপি নেতা ওয়াসিম।
তিনি আরো বলেন, আওয়ামীলীগের প্রতিনিধি হিসেবে আমি ২০০২ সালে শতকরা ৬১ভাগ ভোট পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। একটানা নয় বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করি। সেসময় আমি বৃহত্তর মগনামা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ছিলাম, ১৯৯৮ সালে আমি ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হই, পরে পেকুয়া সাংগঠনিক থানা যুবলীগের প্রথম কমিটির ১নং যুগ্ম আহবায়ক হই, ২০০৩ সালে পেকুয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের প্রথম পূর্ণাঙ্গ কমিটির ২নং যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হই, সর্বশেষ ২০১৪ সালের উপজেলা আওয়ামীলীগের কমিটিতে সদস্য নির্বাচিত হই। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল যে সারাজীবন আওয়ামীলীগের জন্য এত ত্যাগ তিতিক্ষার পরেও আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে বিএনপি থেকে নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধির হাতে আমি চরম নির্যাতিত। ওয়াসিম চেয়ারম্যান ডিবি পুলিশের মাধ্যমে আমাকে অস্ত্র ইয়াবা দিয়ে ফাঁসায়, পরে সন্ত্রাসী বাহিনী সাথে নিয়ে আমার চিংড়ি ঘের জবরদখল সে, কারামুক্তি পেলে আমাকে হত্যাচেষ্টা চালায় সে। পরিশেষে আমার ভিটেবাড়ী জবরদখল করে। গুড়িয়ে দেয় আমার পাকা বাড়ি।
কাকপাড়া এলাকার বাসিন্দা , মৃত মাহমুদুল করিমের ছেলে কামাল হোসেন ও বাদশা মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ মানিক বলেন, বংশ পরম্পরায় আমরা কাকপাড়ায় বসবাস করে আসছি। স¤প্রতি চেয়ারম্যান ওয়াসিমের অনুগত সন্ত্রাসীরা আমাদের ৭৭টি পরিবারকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে দিয়েছে। প্রাণের ভয়ে রাতারাতি তল্পিতল্পা গুটিয়ে আমাদের বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। উচ্ছেদ হওয়াদের মধ্যে যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল তারা অন্যত্র বাসস্থান খুঁজে নিলেও অসহায় নিরহ ব্যক্তিরা পরিবার নিয়ে বেড়িবাঁধের পাশে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে তারা লবণ মাঠের পলিথিন দিয়ে ঘর বানিয়ে চরম মানবেতরভাবে দিনযাপন করছে। আর ওইসব জায়গায় চেয়ারম্যান ওয়াসিম সমুদ্রের বালু তুলে মজুদ করছে। বালু তোলার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকেরা দখল করে নিয়েছে সাইক্লোন শেল্টার ও স্কুল ভবন। এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ ওয়াসিম বলেন, কাঁকপাড়া ও জালিয়াপাড়ার বাসিন্দাদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিয়ে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। কারও উপর জোরজবরদস্তি করা হয়নি।
পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাঈকা সাহাদাত বলেন, ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ কাউকে বসতি থেকে উচ্ছেদের এখতিয়ার রাখে না। মগনামা ইউনিয়নের কাঁকপাড়া ও জালিয়াপাড়ার বাসিন্দাদের উচ্ছেদের বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখবো।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.