ডেস্ক নিউজ:
কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে পুরো ভারত যখন টালমাটাল, তখনই নতুন করে চিন্তা বাড়িয়েছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের দৌরাত্ম্য। সঙ্গে দোসর হোয়াইট ও ইয়েলো ফাঙ্গাস। ছত্রাক সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে একের পর এক মৃত্যু ঘটছে। তারই মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে হরিয়ানা। মঙ্গলবার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রাজ্যটিতে এখনও পর্যন্ত ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে মৃত্যু হয়েছে ৭৫ জনের। এছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে আরও ৭৩৪ জন। এই নিয়ে হরিয়ানায় মোট ৯২৭ জনের ব্ল্যাক ফাঙ্গাস শনাক্ত হয়েছে।
রাজ্য সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত ৭৩৪ জন রোগীর চিকিৎসা চলছে। ১১৮ জন সেরে উঠেছেন। যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন ৭৫ জন রোগী।
গত তিন সপ্তাহে হরিয়ানায় অনেকটাই বেড়েছে মিউকরমাইকোসিস সংক্রমণ। মৃতের সংখ্যাও ২০ থেকে বেড়ে ৭৫-এ পৌঁছেছে। হরিয়ানা সরকারের তরফে চিকিৎসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কোনও কেস মিললেই সংশ্লিষ্ট জেলার মুখ্য মেডিক্যাল অফিসারকে জানাতে। সামগ্রিক বিষয়ে তদারকির জন্য একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
গত সপ্তাহেই হরিয়ানার স্বাস্থ্যমন্ত্রী অনিল ভিজ সরকারি হাসপাতালে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসায় বেডের সংখ্যা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এবার প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, এই ফাঙ্গাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইনজেকশনের জোগান দেওয়া হচ্ছে সরকারিভাবে। রাজ্য সরকারের তরফে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ১২ হাজার অ্যামফোটেরিসিন-বি ইনজেকশনের অনুরোধ জানানো হয়েছে কেন্দ্রের কাছে। এভাবে বাড়তে থাকলে এই ছত্রাকঘটিক সংক্রমণের মোকাবিলা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে হরিয়ানার জন্য।
সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ার যত কারণ
কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে অন্তত পাঁচ শতাংশ গুরুতর সংক্রমণের শিকার হন, যাদের আইসিইউতে রেখে নিবিড় পরিচর্যায় চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এই চিকিৎসা অনেক সময় দীর্ঘ দিন ধরে চালানো প্রয়োজন হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাদের জন্য ভেন্টিলেটার যন্ত্রের মাধ্যমে শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হয়, তাদেরই ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে সবচেয়ে বেশি।
প্যানডেমিকের মধ্যে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে যেহেতু প্রচুর রোগী ভর্তি করা হচ্ছে, তাই সেখানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ করতে হচ্ছে সাধারণ সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। একদিকে এজন্য তাদের ক্লান্তি, অন্যদিকে একগাদা সুরক্ষা পোশাক পরে কাজ করার অসুবিধা ও বাড়তি চাপ, যেসব নল দিয়ে রোগীদের গুরুত্বপূর্ণ ওষুধগুলো দেয়া হয় সেগুলোর অতিরিক্ত ব্যবহার, হাতে ধোয়ার অভ্যাসে ঢিলে দেয়ার প্রবণতা এবং পরিচ্ছন্নতা ও জীবাণুমুক্ত করার প্রক্রিয়াও যথাযথভাবে না হওয়ার কারণে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
মানব ও প্রাণীদেহে ছত্রাকের প্রভাব নিয়ে কাজ করে ইন্টারন্যাশানাল সোসাইটি অব হিউম্যান অ্যান্ড অ্যানিমাল মাইকোলজি। সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট ডা. অরুণালোক চক্রবর্তী বলেন, ‘এতোদিন ধরে এই মহামারি চলার কারণে স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ক্লান্তি এবং এক ধরনের গা-ঢিলে দেওয়া ভাব চলে এসেছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সেটাই প্রধান কারণ।’
এছাড়া স্টেরয়েড এবং অন্যান্য ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার রোগীদের শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছে। কোভিড রোগীদের শরীরে অন্যান্য উপসর্গ থাকায় তাদের জন্য এই ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। লস এঞ্জলেস-এর স্বাস্থ্য পরিষেবায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রধান ড. যাচারি রুবিন বলেন, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব কম থাকলে এই ছত্রাকগুলো আক্রমণের সুযোগ পায়। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এটাকে সুযোগসন্ধানী সংক্রমণ বলা হয়। সাধারণত এইচআইভি/এইডস রোগীদের জন্য এটি বড় ধরনের আশঙ্কার কারণ হয়। কোভিড-১৯-এর সঙ্গে এই ফাঙ্গাসজনিত রোগ বিরল, কিন্তু ভারতে এটা ঘটছে বেশ ব্যাপকভাবেই।
শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া
এই ফাঙ্গাসের আক্রমণ শনাক্ত করা সহজ নয়। পরীক্ষার জন্য ফুসফুসের একেবারে ভেতর থেকে নমুনা সংগ্রহের প্রয়োজন হয়। ওষুধও খুবই দামি। ডা. কালান্ত্রি বলেন, ‘এই ছত্রাক সংক্রমণের চিকিৎসা ডাক্তারদের জন্য খুবই দুশ্চিন্তার এবং হতাশার। একসঙ্গে তিন তিনটা বিপর্যয় কোভিড রোগীদের জন্য। প্রথমত কোভিড-১৯ রোগীর ফুসফুস ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। তারপর তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে ভাইরাস সংক্রমণের বিভিন্ন উপসর্গগুলো। এরপর যোগ হচ্ছে ফাঙ্গাসের সংক্রমণ। এটা অনেকটা হেরে যাওয়া যুদ্ধে জেতার লড়াই।’
উপসর্গ
কিছু কিছু ফাঙ্গাস থেকে সংক্রমণের উপসর্গগুলোর সঙ্গে কোভিড-১৯ রোগীর লক্ষণগুলোর মিল রয়েছে। যেমন জ্বর, কাশি এবং নিঃশ্বাস নিতে না পারা। ক্যানডিডা ফাঙ্গাসের বাড়তি উপসর্গের মধ্যে রয়েছে সাদা রঙয়ের র্যাশ বা ক্ষত- যার জন্য একে অনেক সময় বলা হয় সাদা ফাঙ্গাস। নাক, মুখ, ফুসফুস, পাকস্থলি বা নখের গোড়ায় এই ছত্রাকের সংক্রমণ দেখা যেতে পারে, যে র্যাশ অনেক সময় সাদা ছানার মত দেখায়। এই ফাঙ্গাসের সংক্রমণ শরীরে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে অর্থাৎ তা রক্তে চলে গেলে প্রায়ই রক্তচাপ কমে যাওয়া, জ্বর, পেটে ব্যথা এবং মূত্রনালীর প্রদাহের মত উপসর্গ দেখা যায়। সূত্র: দ্য ওয়াল, বিবিসি।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.