বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমার কেন ঘনিষ্ঠ হতে চায় না?
ওয়ান নিউজ ডেক্স: গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের দিক থেকে নানাভাবে আগ্রহ দেখানো হলেও মিয়ানমার সবসময় নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক জোরালো করার জন্য মিয়ানমার কোনো প্রয়োজন মনে করছে না।
২০০২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে ‘লুক ইস্ট’ বা ‘পূর্বমুখী’ নীতি ঘোষণা করেছিল। সে নীতির মূলে ছিল মিয়ানমারের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করা। কিন্তু সে উদ্যোগ কোনো ফল দেয়নি।
তখন বাংলাদেশের পরারাষ্ট্র সচিব ছিলেন শমশের মবিন চৌধুরী। তিনি বলছেন, মিয়ানমারের কাছ থেকে সবসময় সব বিষয়ে ভালো সাড়া পাওয়া যেত না। সে সময় মিয়ানমারের উপর পশ্চিমা দেশগুলো অর্থনৈতিক অবরোধ ছিল।
শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, “মিয়ানমারে দেখাতো যে আমাদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। মূল কয়েকটি বিষয়ে আমারা তাদের কাছ থেকে সে রকম সাড়া পাইনি। বিষয়গুলো তারা অমীমাংসিত তারা রেখে দিত। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সমস্যাটি।”
বাংলাদেশ আশা করেছিল, মিয়ানমারে সামরিক শাসনের অবসান হলে হয়তো পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু বাস্তবে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে বরং অবনতি হয়েছে।
২০০৯ সালে থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল অনুপ কুমার চাকমা।
তিনি বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠেছিল রোহিঙ্গা ইস্যুটি। যদিও বাংলাদেশ চেষ্টা করেছে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে।
মিয়ানমারে দীর্ঘ সময় সামরিক শাসন এবং পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে দেশটি চীনের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
পরে ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলে মিয়ানমার। ফলে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে মিয়ানমার বাংলাদেশকে কখনোই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্য মিয়ানমারকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হলেও মিয়ানমার বাংলাদেশেকে সেভাবে দেখে না। তাছাড়া ভৌগোলিকভাবে মিয়ানমার বাংলাদেশের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, মিয়ানমারের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব ততটা নেই। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো – থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়ার সাথে বাণিজ্য বাড়াতে হলে বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমার হচ্ছে সে অঞ্চলের প্রবেশদ্বার।
সাবেক কূটনীতিকরা বলছেন, বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেবার জন্য মিয়ানমারকে তাগাদা দেয়া হলেও বিষয়টি নিয়ে তাদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে চায় নি বাংলাদেশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক আলী আশরাফ মনে করেন, বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলেও মিয়ানমারের কাছে বাংলাদেশ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাছাড়া চীন এবং ভারতের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক জোরালো হবার কারণে বাংলাদেশর তাদের কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আশরাফ।
রোহিঙ্গা সংকটে আবারও মিয়ানমারের পক্ষে দাঁড়াল চীন
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরী বৈঠকের আগে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে এ নিয়ে মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে।
বুধবার নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের এই জরুরী বৈঠকটি ডাকা হয়েছে। এই বৈঠকের প্রাক্কালে চীন আবারো মিয়ানমারের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যে অভিযানকে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশন জাতিগত নির্মূল অভিযান বলে বর্ণনা করেছে, চীন আবারো সেই অভিযানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার মাত্র গতকালই রাখাইনে যা ঘটছে তাকে ‘টেক্সটবুক এথনিক ক্লিনজিং’ অর্থাৎ জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের যা সংজ্ঞা, হুবহু তাই বলে বর্ণনা করেন। তারপরই জাতিসংঘের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পরিষদের বৈঠক হচ্ছে।
জানা গেছে, ব্রিটেন এবং সুইডেনের অনুরোধে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এই জরুরী বৈঠক ডাকা হয়েছে। কিন্তু সেখানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগে মিয়ানমারের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তের সম্ভাবনা এখনো পর্যন্ত ক্ষীণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
নিরাপত্তা পরিষদে পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশের যে কোন দেশ একটি যদি কোন প্রস্তাব বা সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভোট দেয়, তাহলে সেটি আটকে যায়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠকে তাই ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এর অন্যতম কারণ, চীন এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমার সরকারের গৃহীত সব ব্যবস্থাকে শতভাগ সমর্থন জানিয়ে চলেছে।
মঙ্গলবার চীন আবারও বলেছে, তারা ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা’ রক্ষায় মিয়ানমার সরকারের পাশে আছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং শুয়াং বলেছেন, “মিয়ানমার সরকার তাদের জাতীয় উন্নয়নের জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার যে চেষ্টা করছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত তার পাশে থাকা।”
মনে করা হচ্ছে চীন আজ মিয়ানমারের পক্ষে এই বিবৃতি দিয়েছে যাতে করে নিরাপত্তা পরিষদের কালকের বৈঠকে মিয়ানমারের নিন্দা করে কোন প্রস্তাব আনা না যায়।
রাশিয়ার অবস্থানও মিয়ানমারের পক্ষে বলে মনে করা হচ্ছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোন প্রস্তাব যদি ভোটাভুটিতে দেয়া হয়, তাহলে রাশিয়া তাতে কতটা সমর্থন দেবে, সেটা নিয়ে সংশয় আছে।
জাতিসংঘের কূটনীতিকদের উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, রোহিঙ্গা সংকটে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কোন মাথা গলাক, সেটা চীন চায় না।
নিরাপত্তা পরিষদের আরেক স্থায়ী সদস্য অবশ্য রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে তাদের দীর্ঘ নীরবতা ভেঙ্গেছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, সহিংসতার মুখে যেভাবে রোহিঙ্গারা তাদের বাড়ীঘর ছাড়া হয়েছে তাতে বোঝা যায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে বেসামরিক মানুষকে নিরাপত্তা দিচ্ছে না।
উল্লেখ্য নিরাপত্তা পরিষদে গত সপ্তাহে আরেকটি বৈঠকেও চীন মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।সুত্র: বিবিসি
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.