বদলে যাচ্ছে সাংবাদিকতা
কেবল টেক্সট, অডিও বা ভিডিও ছাড়িয়ে সাংবাদিকতা এখন পৌঁছে গেছে মাল্টিমিডিয়ার দ্বারপ্রান্তে। সব ধরনের মাল্টিমিডিয়া এবং লাইভ সম্প্রচার নিয়ে যখন বার্তাকক্ষ কাজ করবে তখন একজন সাংবাদিককেও এই সবগুলো মাধ্যমে কাজের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে এটাই বাস্তবতা। অনলাইন গণমাধ্যমে কর্মরত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষকরা বলছেন, ‘পাঠক-দর্শকের চাহিদার কারণেই সাংবাদিকতার ধরন বদলে যাচ্ছে। মানুষ এখন একই সঙ্গে পড়তে, দেখতে ও শুনতে চায়। ফলে গণমাধ্যমের বিকল্প কিছু ভাবার সুযোগ নেই। মাল্টিমিডিয়ার এই ব্যবহার আমাদের জন্য ভালো। তবে দক্ষতার সঙ্গে না করতে পারলে তা বুমেরাং হয়ে যাবে।’
নতুন ও পুরনো ধারার মিডিয়াগত এক দশকে নিজেকে নানাভাবে পরিবর্তন করতে হয়েছে জানিয়ে আন্তর্জাতিক নিউজ সংস্থা এসোসিয়েট প্রেস (এপি) এর বাংলাদেশের ব্যুরো’র প্রধান জুলহাস আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সময়ের প্রয়োজন ও চাহিদার কারণেই এই বদলে যাওয়া। টেলিভিশন, অনলাইন আসার পাশাপাশি স্যোশাল মিডিয়াতেও প্রতিযোগিতা তৈরি হওয়ায় মূলধারার মিডিয়াকে সতর্ক থাকতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার মানুষ হিসেবে আমি এরমধ্যেই কাজ করছি রানাপ্লাজা ও তাজরীনের মতো ঘটনায়। ওখান থেকেই আমরা স্টোরি ফাইল করছি, কেননা আমার বাড়তি সময় নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। কারণ আমার প্রকাশের আগে স্যোশাল মিডিয়াতে চলে গেলে আর কোনও বিকল্প বাকি থাকে না।’
তবে এর ঝুঁকিও আছে উল্লেখ করে জুলহাস বলেন, ‘সেটা তাড়াহুড়োর ভুল। তবে মূলধারার মিডিয়া একটা শক্তিশালী সম্পাদকীয় নীতিমালা নিয়ে চলে বলে দ্রুত করলেও ভুলের সম্ভাবনা কম থাকে। নিউ মিডিয়ায় প্রবেশের মুহূর্তে প্রশিক্ষণ জরুরি। মিডিয়ার সক্ষমতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। এটি কেবল রিপোর্টারদের জন্য না নিউজরুমের প্রত্যেকের জন্য। কেননা প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত আপগ্রেড হচ্ছে। সেখানে আমি যদি হালনাগাদ না থাকি তাহলে পুরো হাউজ পিছিয়ে যাবে। প্রশিক্ষণ না দিলে বিষয়টি বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে।’
ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকার এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার রিফাত নেওয়াজ নিউ মিডিয়া জগতে প্রবেশের বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেন, ‘এখন যন্ত্রপাতি ডেভলপ করেছে। আগে আইফোন ছাড়া ভিডিও কোয়ালিটির ওপর ভরসা করা যেত না এবং সবাইকে আইফোন দেওয়ার বাস্ততবতাও ছিল না। এখন ১৫ হাজারের মোবাইল ফোন সেটেই সেটা সম্ভব বলে কাজগুলো সহজ হয়ে যাচ্ছে। আগে রিপোর্টাররা হাতে নোট নিত, তারপর অডিও রেকর্ড করত। এখন এর সঙ্গে ভিডিও যুক্ত হয়েছে। কেননা মানুষ এখন দেখতে চায়। এখন পাঠক-দর্শক শ্রোতার রূচি বদলে গেছে।’
নিউ মিডিয়ায় ঝুঁকে যাওয়ার কারণে পত্রিকা চাপে পড়ছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বে টেকনোলজির বদলের কারণেই পত্রিকাগুলো অনলাইনে যেতে চাচ্ছে। নিউ মিডিয়া আসার আগে মানুষ পত্রিকার জন্য বসে থাকতো। এখন মানুষ যেখানে আছে নিউজম্যানকে সংবাদ সেখানে পৌঁছে দিতে হচ্ছে।’
যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে একটা গ্রুপকে ছিটকে পড়তে হবে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সবকিছুতে যখন পরিবর্তন আসে তখন আত্মস্থ করার বিষয়টা শিখতে হয়। হাতে লেখা থেকে কম্পিউটারে যখন গেছে তখন সেটা শিখে নিতে হয়েছে। যারা পারবেন না তারা পিছিয়ে পড়বেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সামনের সময় মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজমের। মোবাইল ব্যবহার করেই সংবাদের সব কাজ হবে। বর্তমানের সাংবাদিকতা গতানুগতিক ধারার মধ্যে প্রশিক্ষিত হয়ে আসে। কিন্তু স্যোশাল মিডিয়ার কারণে প্রত্যেকে সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছে এবং সিটিজেন জার্নালিজমের কারণে তারা নিজেদের সাংবাদিক দাবিও করছে। তবে মূলধারা সেটাকে চ্যালেঞ্জ করছে এই জায়গা থেকে যে স্যোশাল মিডিয়ার সংবাদ সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ হচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, “সাংবাদিকতা নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তির আত্মস্থ করানোর দায়িত্ব মিডিয়া হাউসগুলো যেমন নেবে তেমনি এই ধারণাগুলোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের সিলেবাসে এগুলো অন্তর্ভুক্ত করবে। কেননা পুরনোরা নতুন যেকোনও কিছু গ্রহণে ‘কালচারালি শকড’ হয়। ফলে নতুনদের মধ্য দিয়ে এটি বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে মাল্টিমিডিয়া বিষয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন চ্যানেল আই এর অনলাইন এডিটর জাহিদ নেওয়াজ খান। নিউ মিডিয়া জার্নালিজমে বাংলাদেশের কর্মীরা কতটা প্রস্তুত জানতে চাইলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রস্তুতিটা ঘোষণা না দিয়ে তো ছিলই। যখন দেখা গেল কোনও টিভির একটা ভিডিও কনটেন্ট মানুষ এই পরিমাণ দেখেছে যেটা ওই টিভির আনুমানিক হিসাবের দর্শকের চেয়ে অনেক বেশি। তখন থেকেই নিশ্চয়ই আমাদের জানা বা বোঝা যে টিভি সেটের জন্য আমরা কনটেন্ট দিচ্ছি তার চেয়েও অনেক বেশি দর্শক মোবাইল ডিভাইসে। সেটা যে সবাই বুঝতে পেরেছে বা পারছে এমন নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নিউজ কনটেন্টের ক্ষেত্রে মোবাইল এখন নাম্বার ওয়ান ডিভাইস।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিনোদনের ক্ষেত্রেও ইউটিউব মূল টিভির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানটি টিভিতে যত মানুষ দেখছে, পরে ইউটিউবে দেখছে তার চেয়ে বেশি মানুষ। নিউজের ক্ষেত্রে লাইভ কাভারেজে টিভি হয়তো আরও অনেক দিন ডমিনেট করবে, কিন্তু এর বাইরে অবশ্যই মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট। সেটা হোক কোনও সাইটের নিজস্ব ব্যবস্থায় কিংবা ইউটিউব বা ফেসবুকের ক্ষেত্রে। তবে রেভিনিউ বিষয়টা এখনও সেই অবস্থায় আসেনি, আবার কিছুটা হলেও এসেছে। এটা কয়েক বছরের মধ্যে একটা পরিণতি পাবে। সেজন্য মিডিয়ায় যেমন হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপ করতে হবে, তেমনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও।’
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.