ঢাকা ট্রিবিউন:
নাম পাল্টে পদ্মা ব্যাংক হয়ে যাওয়া সাবেক ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়ম ও আর্থিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগে সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় পাল্টাপাল্টি চিঠি পাঠানো হয়েছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ শরাফত পরস্পরের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছেন।
সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছেন তারা একে অপরের বিরুদ্ধে।
গত রবিবার পদ্মা ব্যাংকের অন্যতম স্পন্সর-শেয়ারহোল্ডার মহীউদ্দীন খান আলমগীর বাংলাদেশের ব্যাংকের গভর্নরকে এক চিঠি দেন। তিনি ব্যাংকটির ১০০ কোটি টাকার এক বিনিয়োগ তহবিল নিয়ে তদন্তের অনুরোধ জানান। এই অর্থ চৌধুরী নাফিজ শরাফতের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
মহীউদ্দীন খান আলমগীর অভিযোগ করেন, তার অনুপস্থিতিতে তৎকালিন ফারমার্স ব্যাংকের একটি বোর্ড মিটিংয়ে এই তহবিল ছাড়ের অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ১ নভেম্বরে এই অর্থ ছাড় করা হয়। কিন্তু এই বিনিয়োগের লভ্যাংশ বা মূলধন কিছুই ফেরত আসেনি। ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার পরও এই টাকা তুলে নিয়ে চৌধুরী নাফিজ শরাফত আইন লঙ্ঘন করেছেন বলে চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, বেআইনিভাবে এই অর্থ বিনিয়োগ বা পাচারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যা ব্যাংকের অর্থের অপব্যবহার। এ বিষয়ে তদন্ত করে অর্থ শেয়ারহোল্ডারদের কাছে ফেরত দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
এদিকে একই দিনে পদ্মা ব্যাংক থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তোলা হয়েছে। পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. এহসান খসরু স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, সিটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের নামে আট কোটি ৩৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী। তারা উভয়েই গ্রাহকদের কাছ থেকে ঘুস ও আর্থিক সুবিধা নিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে দিতেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে চিঠিতে। এতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্তেও তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঋণ প্রদানের অনিয়মের বিষয়টি উঠে এসেছে। পদ্মা ব্যাংক ৮৪৫ দশমিক ৪৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সগযোগিতা চেয়েছে বলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ চিঠিতে জানিয়েছে। কিন্তু তিনি কোনও ধরনের সহযোগিতা করেননি।
ক্ষমতার অপপ্রয়োগের অভিযোগ অস্বীকার করে মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, ‘ব্যাংকের দুরবস্থার জন্য নাফিজ ও তার সহযোগীরা দায়ী। ব্যাংকটি রক্ষায় একজন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া উচিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।’ তিনি বলেন, তার সময়ে ব্যাংকে কিছু সমস্যা ছিল। তবে নাফিজ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ব্যাংক গুরুতর সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে ফারমার্স ব্যাংকের গ্রাহকদের কাছ থেকে ঘুস ও ঋণের ভাগ নেওয়া এবং জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মাহবুবুল হক চিশতীর বিরুদ্ধে। পরে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড থেকে তারা পদত্যাগ করেন। ২০১৮ সালে নাফিজ ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফারমার্স ব্যাংক। চালু হওয়ার তিন বছরের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আর্থিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ওঠে। সাড়ে তিন হাজার টাকারও বেশি অঙ্কের ঋণ বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ আলোচনায় আসে।
২০১৯ সালে ব্যাংকটি নাম পরবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০২০ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির ৩০৯ দশমিক ৯৯ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি রয়েছে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬০ শতাংশ।
২০১৮ সালে রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ, সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও রুপালী ব্যাংক ৭১৫ কোটি টাকায় ফারমার্স ব্যাংকের ৬০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। ব্যাংকটি রক্ষার উদ্দেশ্যে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তবে মহীউদ্দীন খান আলমগীর মনে করেন, রাষ্ট্রয়ত্ব প্রতিষ্ঠানের কাছে শেয়ার বিক্রির পরিবর্তে ঋণ সহায়তা দিয়ে ব্যাংকটির তারল্য সংকট দূর করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে চৌধুরী নাফিজ শরাফতও তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি যখন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেই তখনই ব্যাংকটি ছিল শূন্য। সরকার গ্রাহক ফেরানোর জন্য পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়।’ বিনিয়োগের নামে ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেন। তবে তিনি জানান, ওই ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ থেকে গত পাঁচ বছর ধরে পদ্মা ব্যাংক প্রতি বছরই ১২ কোটি টাকা করে মুনাফা পাচ্ছে।
(ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন থেকে অনুদিত)
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.