প্রত্যাবাসন রুখতে চায় উগ্রপন্থি রোহিঙ্গারা

মোঃ নেজাম উদ্দিন, কক্সবাজার।
গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে আটটার দিকে কক্সবাজারের উখিয়ায় লাম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একদল দুর্বৃত্তরা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে পালিয়ে যায়। ঘটনায় বেশ কয়েকজন আটক হয়েছে এবং কক্সবাজারে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা মামলার চার্জশীট দিয়েছে পুলিশ। মুহিবুল্লাহ আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান ছিলেন। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বড় ভুমিকা ছিল। ঘটনার পর ১৫ আসামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার মধ্যে ৬ জন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। সাড়ে আট মাস তদন্তের পর সোমবার দুপুরে ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশীট আদালতের ডকেট শাখায় জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও উখিয়া থানার ওসি তদন্ত গাজী সালাউদ্দিন। সেখান থেকে এটি কক্সবাজারের জেষ্ট বিচারিক হাকিম আক্তার জাবেদের আদালতে তোলা হবে। তারপর চার্জগঠনের শুনানী হতে পারে।
এদিকে মুহিবুল্লাহ হত্যার পর কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফের ১১লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন রূখতে চায় মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামের একটি সংগঠন। তারা মনে করছে বাংলাদেশ এখন তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল বিশে^র সাথে যোগাযোগ স্থাপনের । এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসে তারা আর্ন্তজাতিকভাবে চালিয়ে যাচ্ছে মাদক ব্যবসা। চীন মায়ানমার হয়ে আসছে মাদক ইয়াবা ,আইসসহ নিষিদ্ধ পণ্য।আর এইসব সুবিধা নিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে আস্তানা হিসাবে ব্যবহার করছে আরসাসহ বেশ কয়েকটি মিয়ানমার সংগঠন। মাদকের মাধ্যমে তারা তাদের হাতে আনছে ভারী অস্ত্র।এতে মিয়ানমারের হাত রয়েছে বলেও ধারনা করছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বেশ কয়েকজন। সম্প্রতি মাদক ব্যবসায়ীরা মায়ানমার থেকে মাদক বাংলাদেশে প্রবেশকালে বিজিবির সাথে মাদককারবারিদের গুলাগুলি হওয়ার তথ্য দিয়েছে বিজিবি। মূলত তারা চাইছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প যাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হবে তারা মিয়ানমার থেকে আসা মাদকসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার একটা মোট অংকের টাকা তাদের হাতে আসে ।এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন শত শত কোটি টাকার মাদক দেশের বিভিন্ন স্থানের যাচ্ছে বলে জানা গেছে। যা বর্তমানে প্রতিদিন কক্সবাজারের বিভিন্ন আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে আটক হওয়া মাদক এর পরিমাণ থেকে অনুমান করা যায়। এদিকে কক্সবাজারের আলোচিত উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে অস্ত্র নিয়ে সকলের মাঝে আতঙ্ক কাজ করলেও কোন ধরনের বড় অভিযান না থাকায় বেশ বেকায়দায় ও ভয়ে দিন যাপন করছে স্থানীয় ও অসহায় রোহিঙ্গারা। আরসা সহ একাধিক সন্ত্রাসী গ্রæপ সেখানে সক্রিয়। তাদের সবার হাতেই রয়েছে আধুনিক অস্ত্র। সেই অস্ত্র তারা ব্যবহার করছে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী আর প্রভাব বিস্তারের কাজে।রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এই অবৈধ অস্ত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নতুন করে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।
এদিকে মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি কে (আরসা) ঘিরে সন্দেহ বাড়ছে রোহিঙ্গাদের। তারা মনে করছে, আরসাকে পেছন থেকে মদদ দিচ্ছে মিয়ানমারের প্রশাসন। দেশটির ‘গোপন এজেন্ট’ হিসেবে প্রত্যাবাসন বিরোধী কাজ করছে সংগঠনটি। এমনটি ধারনা রোহিঙ্গাদের। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যে রক্তপাতের ঘটনা ঘটে, এর পেছনেও আরসার হাত রয়েছে বলে মনে করেন সাধারণ রোহিঙ্গারা।
কয়েকটি আশ্রয় শিবিরে বিভিন্ন পর্যায়ের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আরসা এখন তাদের কাছে ভয় ও আতঙ্কের নাম। তাদের অভিযোগ, ক্যাম্পে হামলা, একের পর এক খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়সহ নানা অপরাধে জড়িত এই সংগঠন। এরা আল ইয়াকিন বা আলেখিন নামেও পরিচিত। উখিয়া ও টেকনাফে ৩৪টি ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা তাদের কাছে জিম্মি।
বালুখালী ক্যাম্পের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সন্ত্রাসী গ্রæপগুলোর মধ্যে আধিপত্য বিস্তার এবং ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একের পর এক হত্যার ঘটনা ঘটছে। মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গ্রæপ আরসা বা আল ইয়াকিনের নামে একটি পক্ষ ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া। অন্যদিকে আরএসও এবং ইসলামী মাহাস নামে আরও দুটি সংগঠনও ক্যাম্পে তৎপরতা চালাচ্ছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের ডি বøকের আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের কার্যালয়ে শীর্ষ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা এবং গত ২২ অক্টোবর রাতে বালুখালী ক্যাম্প-১৮-এর এইচ-৫২ বøকে দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল ইসলামিয়াহ মাদ্রাসায় হামলা চালিয়ে ছয় রোহিঙ্গা হত্যার ঘটনা একই সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রæপের পরিকল্পিত মিশন ছিল এমনটাই ধারনা রোহিঙ্গাদের।
সূত্র জানায়, ‘উলামা কাউন্সিল’ নামে একটি সংগঠন রোহিঙ্গা শিবিরে দেড়শতাধিক মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়। এ সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘আরসা’র কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা। সংগঠনের সভাপতি হচ্ছেন রোহিঙ্গা নেতা হাফিজুল্লাহ। তিনি ক্যাম্পের বাইরে থাকেন। অন্যদিকে ‘ইসলামী মাহাস’ নামে সংগঠনটিও একই তৎপরতা চালাচ্ছে ক্যাম্পে। এ সংগঠনের নেতা মৌলভী সেলিম উল্লাহ। তিনি এক সময় ‘আরসা’র কমান্ডার ছিলেন। আরসা ছেড়ে পরে তিনি ‘ইসলামী মাহাস’ গড়ে তোলেন। দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল ইসলামিয়াহ মাদ্রাসাটি ছিল এই গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। এ নিয়ে দু’পক্ষের বিরোধ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। আরসা’র নাম দিয়ে অনেকবার হুমকি দেয়া হয়েছে ওই মাদ্রাসার শিক্ষক-পরিচালকদের এমন তথ্য পাওয়া যায়।
সূত্র জানায়, ‘ইসলামী মাহাস’ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে থাকলেও উলামা কাউন্সিল বিপক্ষে। এছাড়া মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের পর ‘ইসলামী মাহাস’ পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে বলে আরসা’র সমর্থনপুষ্ট সন্ত্রাসীরা মাদ্রাসাটির ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। এর জেরে ওই হামলা হয়।
রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডে যে পাঁচ অস্ত্রধারী ছিলেন, তারা সবাই ভারী আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও ব্যবহার করেন। সবশেষ যে ছয়জনকে খুন করা হয়, সেখানে বিদেশি অস্ত্রের পাশাপাশি দেশি আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করা হয় বলে জানা গেছে। আর এ পর্যন্ত যত অস্ত্র ধরা পড়েছে তার বেশিরভাগই বিদেশে তৈরী।রোহিঙ্গাদের ভাষ্য, তারা নিজ দেশে ফিরে যাবেন- এই কথাও প্রকাশ্যে বলতে পারেন না। কেউ নিজ দেশে ফিরে যাবেন বললে তাকে হত্যা করা হয়। প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বলায় মাস্টার মুহিবুল্লাহ, মাস্টার আরিফ উল্লাহ, আবদুর রহিম, নুর আলম, হামিদুল্লাহ, মৌলভী হাসেম, মো. নুরসহ অর্ধশত রোহিঙ্গা নেতাকে তারা হত্যা করেছে। জনপ্রিয় এসব নেতার স্বজনরাও এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
জানা গেছে, ‘মিয়ানমার থেকে মাদক চালানের সঙ্গে অস্ত্র আসছে এতে কোনও সন্দেহ নেই। মাদকের মূল হোতারা মাদক পাচারকালে ব্যবহারের জন্য তাদের বহনকারীদের হাতে তুলে দিচ্ছে অস্ত্রশস্ত্র। আবার অনেকে মাদক বহনকারী হিসেবে ব্যবহার করছে রোহিঙ্গাদের। সেই সুবাদে ক্যাম্পে তারা যেকোনও কর্মকান্ডে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করছে। এতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
কক্সবাজার অতিরিক্ত পলিশ সুপার মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অপরাধ দমনে পুলিশ প্রশাসন সবসময় তৎপর রয়েছে । নিয়মিত পুলিশ টহল জোরদার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে মুহিবুৃল্লাহ হত্যাকান্ড বিচারাধীন রয়েছে।বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে হত্যা মামলায়। ২৯ জনের বিরোদ্ধে চার্জশীট দিয়েছে আদালত। আশা করছি ক্যাম্পের অবস্থা এখণ স্বাভাবিক রয়েছে।

 

 

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.