নতুন বছরে লাগাম টানুন বাজারের পাগলা ঘোড়ার
প্রভাষ আমিন
বড়দিন উপলক্ষ্যে ইউরোপ-আমেরিকায় বিভিন্ন পণ্যের দামে ডিসকাউন্ট দেয়া হয়। এই ডিসকাউন্ট কখনো কখনো ‘অভাবনীয়’ হয়। মূল দামের দশ ভাগের এক ভাগেও কিনতে পাওয়া যায় পছন্দের পণ্য। ডিসকাউন্টে পণ্য কিনতে মানুষ রাত জেগে নির্দিষ্ট দোকানের সামনে অপেক্ষা করে। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটে উল্টো ঘটনা। ঈদে বা অন্য কোনো উৎসবে আমাদের দেশে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। তবে বাংলাদেশে যে ডিসকাউন্ট দেয়া হয় না, তা নয়। তবে সেই ডিসকাউন্টেও নাকি দারুণ কৌশল থাকে। ডিসকাউন্ট দেয়ার কয়েকদিন আগে ২০ ভাগ দাম বাড়ানো হয়। তারপর ১৫ ভাগ ডিসকাউন্টের ব্যাপক বিজ্ঞাপন করে ভোক্তাদের নজর কাড়া হয়। শুভঙ্করের ফাঁকিটা আশা করি আপনারা ধরতে পেরেছেন।
বাংলাদেশে আরেকটা ব্যাপার আছে। একবার কোনো জিনিসের দাম বাড়লে তা আর কমে না। একটু-আধটু কমলেও আগের জায়গায় কখনোই আর আসে না। এই যেমন জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক কমে গেলেও অতীতের লস পুষিয়ে নেয়ার কথা বলে বাংলাদেশে তা কমানো হয়নি। অনেক সমালোচনার পর প্রতীকী দাম কমানো হয়েছে বটে, তাতে সাধারণ মানুষের কোনো লাভ হয়নি। তবে গাড়ি, দামি ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক্স বা বিলাসপণ্যের দাম বাড়লো না কমলো, তা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। আদার বেপারির জাহাজের খবর দিয়ে কাজ কি। যেমন ধরুন ঘিয়ের দাম ৫ গুন বাড়লেও আমি ফিরে তাকাবো না। ঘিয়ের দাম নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমার যত মাথা ব্যথা চালের দাম নিয়ে। পেঁয়াজের দাম নিয়েও ততটা নয়, যতটা চালের দাম নিয়ে। চাইলে পেঁয়াজ কম খেয়ে বা একেবারে না খেয়েও দিন গুজরান করা যায়। কিন্তু চাল ছাড়া বাঙালির একবেলাও চলে না। নুন-কাঁচা মরিচ দিয়ে এক থালা পান্তা হলেও তৃপ্তিতে দিনটা শুরু করা যায়। কিন্তু এখন যে আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় দশা।
চালের বাজারের অস্থিরতাটা অনুমিতই ছিল। গতবছরের মার্চে হাওরাঞ্চলে হঠাৎ বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেই ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই মে-জুন মাসে উত্তরাঞ্চলের বন্যায় ফসলের আরেকদফা ক্ষতি হয়। দুর্যোগটা প্রাকৃতিক। কিন্তু সেটা সামাল দেয়ার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল না। বছরের শেষ দিকে যখন চালের বাজার পাগলা ঘোড়ায় সওয়ার তখন সরকারের টনক নড়ে। কিন্তু চালের আমদানি শুল্ক কমানো বা সরকারিভাবে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ায় সেই পাগলা ঘোড়ার লাগাম সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অথচ মার্চ মাসে হাওরে বন্যার পর বা মে-জুন মাসে উত্তরাঞ্চলের বন্যার পর পর কার্যকর ব্যবস্থা নিলে চালের বাজার সরকারের নিয়ন্ত্রণেই থাকতে পারতো। চালের বাজারের ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটেছে একদম বাংলাদেশের ডিসকাউন্ট গল্পের মত। দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১৫ টাকা। আর মন্ত্রীদের ধমকে ব্যবসায়ীরা কমাতে রাজি হয়েছে কেজিপ্রতি ২/৩ টাকা। পরে স্বাভাবিক নিয়মে এবং আমদানি বাড়ায় দাম আরো কিছুটা কমেছে। কিন্তু আগের জায়গায় আর যায়নি, হয়তো আর কখনো যাবেও না।
চালের দাম বাংলাদেশে একটা স্পর্শকাতর ইস্যু। বাঙালিকে বলাই হয় ভেতো বাঙালি। আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি। মায়েরাও চান তাদের সন্তানরা থাকুক দুধে-ভাতে। তাই চালের দাম বাড়লে টান পড়ে মায়ের হাড়িতে। আবার মৌসুমে যখন চালের দাম অস্বাভাবিক কমে যায়, তখন লাথি পড়ে কৃষকের পেটে। তাই সরকারের দায়িত্ব চালের বাজারের ভারসাম্যটা বজায় রাখা, দামের লাগামটা নিজেদের হাতে রাখা। এই লাগামটা ছুটে গেলে আসলে সবই ছুটে যায়।
গত সপ্তাহে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-সানেম’ এর ত্রৈমাসিক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, শুধু চালের দাম বাড়ার কারণে গত কয়েক মাসে ৫ লাখ ২০ হাজহার মানুষ গরিব হয়ে গেছে মানে দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে। এমনিতে দারিদ্রসীমার একটু ওপরে থাকা মানুষেরা খাওয়ার পেছনে যত খরচ করে তার ৮০ ভাগই চাল কিনতে যায়। তাই চালের দাম একটু নড়চড় করলেই নড়বড়ে হয়ে যায় এই সব মানুষের জীবনের হিসাব-নিকাশ।
চালের দামের বিষয়টা এমন, বাংলাদেদেশের প্রত্যেকটা মানুষের জীবনের সঙ্গে যার ওতপ্রোত সম্পর্ক। এমনিতে অন্য অনেক বিষয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে সত্য-মিথ্যা পাল্টাপাল্টি দাবি-দাওয়া চলে। কিন্তু চাল নিয়ে এসব কিছুর দরকার নেই। সবাই জানে চালের দাম বাড়তি না কমতি। এরজন্য সরকারের ঘোষণা, গণমাধ্যমের খবরের অপেক্ষায় থাকতে হয় না তাদের। হুট করে দাম বেড়ে গেলে সেটা ম্যানেজ করার সামর্থ্য সবার থাকে না।
যারা নাজিরশাইল খায়, তারা হয়তো মিনিকেটে নেমে আসে। যারা মিনিকেট খায় তারা হয়তো মোটা চালে নামে। কিন্তু মোটা চাল কিনতেই যাদের নিত্য সংগ্রাম, তাদের পেটে লাথি পড়ে। এই লাথি পড়া মানুষের কিন্তু কোনো ভয়েস নেই। তাদের কথা গণমাধ্যমে আসে না, তাদের ফেসবুক নেই। তাই তাদের হাহাকার হয়তো নীতিনির্ধারকদের কান পর্যন্ত যায় না। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের কিন্তু একটি করে ভোট আছে। অন্তত নির্বাচন এলে তারা তাদের এই শেষ অস্ত্রটি প্রয়োগ করতে পারে।
২০১৮ হলো নির্বাচনের বছর। নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ তাদের সরকারের নানা সাফল্যের ফিরিস্তি দিচ্ছে, দেবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, পদ্মা সেতু, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন- তালিকা অনেক লম্বা। কিন্তু সাঁতার না জানলে যেমন প্রমত্তা নদীতে জীবনের ষোল আনাই মিছে হয়ে যায়, তেমনি চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকারের উন্নয়নের জোয়ারও পথ হারাতে পারে। শেয়ারবাজার, ব্যাংকে লুটপাট, জিডিপি এসবে সাধারণ মানুষের কিচ্ছু যায় আসে না। সাধারণ মানুষ দু বেলা দু মুঠো ভাত খেতে চায় শুধু।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.