লেলিন চৌধুরী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
করোনা থেকে সেরে ওঠার পরও নিস্তার নেই। ভুগতে হচ্ছে নানা জটিলতায়। দেখা দিচ্ছে নতুন সব রোগ। সম্প্রতি তালিকায় যোগ হলো ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ওরফে কালো ছত্রাক। ভারতের দিল্লিসহ বেশ কিছু শহরের হাসপাতালে ইতোমধ্যে এই রোগে আক্রান্ত অনেকে ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। মারাও গেছেন অনেকে।
ইন্ডিয়া ডট কম-এর খবরে জানা গেলো, এইসব রোগীদের কমবেশি অনেকে তাদের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী মারা গেছে। ভারতের গুজরাট রাজ্যের সুরাট শহরে গত ২১ এপ্রিল থেকে ৬ মে, এই ১৫ দিনে অন্তত ৪০ জনকে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের আটজন দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন পুরোপুরি। বিশেষ করে যারা আইসিইউ থেকে বে্ঁচে ফিরেছিলেন তাদেরকেই এই ছত্রাক আক্রান্ত করছে বেশি।
দিল্লির মানসম্পন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান স্যার গঙ্গারাম হাসপাতাল। সেখানে ৫ ও ৬ মে ৬ জন রোগী কালো ছত্রাকে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। পুনে শহরেও হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া রোগীদের ১০ জন কালো ছত্রাক নিয়ে আবার ফিরে আসেন হাসপাতালে। তাদের দশ জনেরই মুখে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল। এদের মধ্যে মারা গেছেন পাঁচজন।
ভারতের জাতীয় গবেষণা সংস্থা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) এ নিয়ে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কী ও কেন হয়?
নাম থেকেই বোঝা যায় এটি ফাঙ্গাস বা ছত্রাকসৃষ্ট রোগ। ফল, ফসল, উদ্ভিদ, প্রাণী এবং মানুষ; সবার মধ্যেই রোগটি দেখা দিতে পারে। ফল, ফসল ও উদ্ভিদের কাণ্ডে বা পাতায় কালো কিংবা গাঢ় ধূসর ভুসির আস্তরণের মতো ছত্রাকগুলো লেগে থাকে। এক ধরনের বিশেষ ছত্রাক পরিবার থেকে মানুষের শরীরে রোগটি বাসা বাঁধে। এই ছত্রাক পরিবারের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪০। পরিবারের নাম ‘মিউকোর (Mucor)’। ছত্রাকসৃষ্ট রোগকে বলা হয় ‘মাইকোসিস (Mycosis)’। তাই মিউকোর ছত্রাকসৃষ্ট এ রোগের নাম ‘মিউকোর-মাইকোসিস’।
এতে আক্রান্ত স্থানে কালো দাগ তৈরি হয়। আক্রান্তদের নাক থেকে শ্লেষ্মা মিশ্রিত কালো শক্ত পদার্থ বের হয়। এ কারণেই একে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাক রোগ বলা হয়।
একজন সুস্থ মানুষ সাধারণত ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয় না। রোগ বা কোনও বিশেষ চিকিৎসার কারণে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে মিউকোর গ্রুপের ছত্রাক কামড় বসানোর সুযোগ পায়।
কীভাবে ছড়ায়?
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বায়ুবাহিত রোগ। ছত্রাকের বীজগুটি বা স্পোর বাতাসে ভেসে বেড়ায়। শ্বাসগ্রহণের সময় নাসারন্ধ্র দিয়ে সাইনাস ও ফুসফুসে প্রবেশ করে। এ কারণে এ দুটি স্থান বেশি আক্রান্ত হয়।
এ ছাড়া পরিপাকতন্ত্রেও এ ছত্রাক প্রবেশ করে রোগ বাঁধাতে পারে। ত্বকে কাটা, ক্ষত বা পোড়া ঘা থাকলে সেগুলোও মিউকর ছত্রাকের প্রবেশপথ হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া দেহের দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতার সুযোগেও ছত্রাকটি শরীরে প্রবেশ করে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
লক্ষণ কী?
আক্রান্ত স্থানের বিবেচনায় এই রোগের লক্ষণকে পাঁচভাগে ভাগ করা হয়েছে।
নাক ও মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত লক্ষণ- মুখের একপাশ ফুলে যাওয়া, মাথাব্যথা, একদিকের নাক বন্ধ, নাকের ভেতর কালো ক্ষত ও জ্বর।
ফুসফুসের লক্ষণ- জ্বর, কাশি, বুকব্যথা ও শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি।
ত্বকের লক্ষণ- চামড়ায় ফুসকুড়ি বা ক্ষত। আক্রান্ত স্থান কালো হয়ে যাওয়া ও জায়গাটিতে ব্যথা হবে এবং গরম থাকবে। ক্ষতের চারপাশ ফুলে যাবে।
আন্ত্রিক লক্ষণ- পরিপাকতন্ত্রে সংক্রমণ হলে পেটব্যথা, বমিভাব ও বমি হয়। পরিপাকপ্রণলীতে রক্তক্ষরণ হতে পারে। যার কারণে কালো পায়খানা ও কফি রঙের বমি হতে পারে।
শরীরে বিস্তৃতির লক্ষণ- আগে থেকে রোগাক্রান্ত বা যাদের রোগ প্রতিরোধ শক্তি কম তাদের দেহে এই ছত্রাক প্রবেশ করে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের লক্ষণ বোঝার উপায় থাকে না। এই ছত্রাক দ্বারা মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়ে রোগী কোমায় পর্যন্ত চলে যেতে পারে ও শেষতক মৃত্যু ঘটতে পারে।
কোভিড-পরবর্তী সময় কেন হয়?
করোনাভাইরাসের আক্রমণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। করোনার চিকিৎসায় অনেক ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। স্টেরয়েড দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
আবার করোনায় তীব্রভাবে আক্রান্তদের শরীরে আরও কিছু রোগ থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদযন্ত্রের বড় অস্ত্রোপচার, কিডনি ও লিভারের অকার্যকারিতা, কিছু বিশেষ রক্তরোগ ইত্যাদি। এই অসুখগুলো দেহের সুরক্ষাশক্তি এমনিতেই কমিয়ে দেয়। তার সঙ্গে করোনা যুক্ত হলে সেটি হয়ে যায় মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। করোনাক্রান্ত যেসব রোগীকে আইসিইউতে যেতে হয়, তাদের মধ্যে কালো ছত্রাকের সংক্রমণের আশঙ্কা অনেক বেশি।
চিকিৎসা আছে কী?
আশার কথা হলো, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগের চিকিৎসা আছে। অ্যান্টি-ফাঙ্গাল বা ছত্রাকনিরোধী ওষুধ দিয়েই চিকিৎসা করা হয়। সাধারণভাবে কালো ছত্রাকের চিকিৎসার জন্য মলম, খাওয়ার ওষুধ ও ইনজেকশন আছে। করোনা পরবর্তী কালো ছত্রাক আক্রান্তদের প্রায় শতভাগকেই ছত্রাকনিরোধী ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে হয়।
প্রধানত যে ওষুধটি ব্যবহার করা হয় সেটির নাম অ্যাম্ফোটেরিসিন-বি। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি কোম্পানি ওষুধটি প্রস্তুত করে। করোনা পরবর্তী কালো ছত্রাকে আক্রান্তদের একটি বড় অংশের মুখের একদিকে বেশখানিকটা ফুলে যায়। তখন রোগীর মুখমণ্ডলে অস্ত্রোপচারের দরকার হয়। কখনও গাল ও চোয়ালের হাড় কেটে ফেলতে হয়।
পরিসংখ্যান বলছে, কালো ছত্রাকে আক্রান্ত রোগীর শতকরা ৫০ ভাগই মারা যায়। তবে রোগটি যদি প্রথমদিকে শনাক্ত করা যায় তবে মৃত্যুর হার কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
বলা হয়, কোভিড-১৯ থেকে ফিরে আসা রোগীর নাকবন্ধ, মাথাব্যথা, মুখ-গাল ফুলে যাওয়া এবং নাক দিয়ে শুকনো কালো শ্লেষ্মা বের হলে তৎক্ষণাৎ তাকে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। অতিদ্রুত নাক দিয়ে আসা কালো পদার্থটি বায়োপসি করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
সাবধান থাকবেন যেভাবে
করোনাক্রান্ত রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে যত্নবান হতে হবে। এক্ষেত্রে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের ব্যবহারে অতিসতর্ক হতে হবে। আইসিইউতে থাকা করোনা রোগীর কোনও দৃশ্যমান কারণ ছাড়া অবস্থা খারাপ হতে থাকলে তখন অবশ্যই কালো ছত্রাক রোগের কথা বিবেচনায় নিতে হবে। সে অনুযায়ী পরীক্ষাও করাতে হবে।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ পরবর্তী কোনও রোগীর ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর এখনও জানা যায়নি। তবে ভারতের অবস্থা দেখে বুঝতে হবে আমাদের অসাবধান থাকার অবকাশ নেই। প্রতিটি করোনা-নিবেদিত হাসপাতাল ও আইসিইউর ‘সংক্রমণ নিরোধী প্রটোকল’-এও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক- জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.