প্রভাষ আমিন
নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আমার সবচেয়ে প্রিয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইশতেহার। আমার খুব ভালো লাগে। আমি খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ি আর কিছুক্ষণের জন্য হলেও স্বপ্নাতুর হয়ে যাই। আহা, যে দেশটির কথা বলা হচ্ছে; সেটি আমাদের দেশ তো? সব নির্বাচনের আগেই রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। প্রত্যেক নির্বাচনেই তো কেউ না কেউ জিতেছেন। একবার ভাবুন তো, আগের ১০টি নির্বাচনে জিতে আসা দলগুলো যদি তাদের ইশতেহার বাস্তবায়ন করতো, তাহলে দেশটা স্বপ্নপুরী হয়ে যেতো না? কিন্তু তা হয়নি। কারণ ইশতেহার একটি কাগজের দলিল মাত্র। দেয়ার আগ্রহ আছে, কিন্তু বাস্তবায়নের ইচ্ছা নেই।
আমার খুব প্রিয় হলেও বাংলাদেশের বাস্তবতায় ইশতেহারের কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই। সাধারণ মানুষ ইশতেহার নিয়ে ভাবে না। এ নিয়ে কোনো কৌতুহলও নেই তাদের। এই যেমন গত ১৮ ডিসেম্বর কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের ইশতেহার ঘোষণা করেছে। আমি নিশ্চিত ঐ সময়েও দেশের কোথাও না কোথাও বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগ বা দুই দল সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এই ইশতেহার নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ইশতেহার নিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পাঁচ তারকা হোটেলে আলোচনা হবে, প্রেসক্লাবে বিতর্ক হবে, টক শো’তে সাজানো ঝগড়া হবে, বড় বড় কলাম লেখা হবে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। দেশ যেমন চলছে, তেমনই চলবে।
ইশতেহারে অঙ্গীকার করাই হয় পূরণ না করার জন্য। গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরুর পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তিনবার করে ক্ষমতায় ছিল। তারা যদি আগের ইশতেহারগুলো বাস্তবায়ন করতো, তাহলেই আর কিছু করতে হতো না।
১৮ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে। তার আগের দিন করেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এই লেখায় বিএনপি আর ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার নিয়ে কথা বলবো। আওয়ামী লীগেরটা নিয়ে পরে আলোচনা হবে।
বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার প্রায় অভিন্ন। দুটি অনুষ্ঠানেই উপস্থিত ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপিরটা তিনি নিজে ঘোষণা করেছেন, আর ঐক্যফ্রন্টের অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছেন। দুটি ইশতেহার পড়ে আমার কৌতুহল হলো, প্রায় অভিন্ন দুটি ইশতেহার পরপর দুদিনে কেন ঘোষণা করা হলো? চাইলেই তো দুটি মিলিয়ে একটি গোছানো ইশতেহার দেয়া যেতো। বলা হয়, আগে দর্শনধারী, তারপর গুনবিচারী। ইশতেহারের ক্ষেত্রে এই তত্ব প্রয়োগ করলে বলতেই হবে, আওয়ামী লীগের কাছে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট গো হারা হেরেছে।
হোটেল সোনারগায়ে আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রকাশ অনুষ্ঠান ছিল পরিকল্পিত, গোছানো। দেশী-বিদেশী আমন্ত্রিত অতিথিদের সামনে শেখ হাসিনা ইশতেহার ঘোষণা করেন। সাথে ছিল পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন। উপস্থিত সবার হাতে তুলে দেয়া হয় সুন্দর মলাটে বাধানো ৮০ পৃষ্ঠার ইশতেহারের মূল কপি এবং শেখ হাসিনা উপস্থাপিত ১৬ পৃষ্ঠার সারমর্ম। পাশাপাশি বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার অনুষ্ঠান ছিল অগোছালো, পরিকল্পনাহীন ও দায়সারা গোছের।
অনেকে বলতে পারেন, সরকারি দলের পয়সা বেশি। তাই তারা ভালোভাবে করতে পেরেছে। বিষয়টা আসলে পয়সার নয়, পরিকল্পনার। মূল খরচ তো ভেন্যুর। ঐক্যফ্রন্ট পূর্বাণীতে, বিএনপি লেকশোরে করেছে। তার মানে খরচ কিন্তু কম হয়নি। দুটো মেলালে হয়তো বেশিই হয়েছে। কিন্তু বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার প্রকাশের আয়োজনে কোনো পরিকল্পনার ছাপ ছিল না। ইশতেহার প্রকাশ অনুষ্ঠান নিয়ে কেউ ভেবেছে বলে মনে হয়নি। আর দশটা অনুষ্ঠানের মত সাংবাদিকদের ডেকে এনে কয়েক পৃষ্ঠা কাগজ ধরিয়ে দেয়া মানেই ইশতেহার প্রকাশ নয়।
ঐক্যফ্রন্ট এ৪ সাইজের ৬ পৃষ্ঠা আর বিএনপি ৯ পৃষ্ঠার ফটোকপি ধরিয়ে দিয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট পরে সাংবাদিকদের ই-মেইলে পূর্ণাঙ্গ ইশতেহার পাঠিয়েছে। আর বিএনপি দিয়েছে ওয়োবসাইটে। ইশতেহার একটা সংরক্ষণযোগ্য দলিল। যারা নিয়মিত রাজনীতি ফলো করেন, তারা এটি রেখে দেন, পরে ধরবেন বলে। কিন্তু বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট যা দিয়েছেন, তা দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণযোগ্য নয়। সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহরা এতদিন কী করলেন, বোঝা গেল না। স্মার্টলি যারা একটা ইশতেহার দিতে পারে না, তারা দেশ কতটা স্মার্টলি চালাবেন? খালি আওয়ামী লীগ ১০ বছরে অনেক খারাপ কাজ করেছে, দেশে দুঃশাসন আর নৈরাজ্য কায়েম করেছে বলেই লোকজন দলে দলে বিএনপিকে ভোট দিয়ে দেবে, এটা আশা করা অন্যায় নয়? দেশ চালানোর জন্য তো নিজেদের যোগ্য করে তুলতে হবে।
এত গেল দেখনদারি। এবার আসি গুণ বিচারে। বিএনপি আর ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার যেহেতু প্রায় অভিন্ন। তাই আলোচনাটাও অভিন্নই হবে। যেটুকু ভিন্নতা আছে, সেটা নিয়ে পরে আলোচনা করবো। বিরোধী দলের জন্য ইশতেহার দেয়া খুব সহজ। ক্ষমতার বাইরে থেকে ক্ষমতায় গেলে এই করবো, সেই করবো বলে দেয়াটা খুব সহজ। বিএনপির ক্ষেত্রে তবু বলা যাবে, আগে করেননি কেন। কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের তো কোনো অতীত নেই। তারা যা ইচ্ছা তাই বলতে পারে, করতে পারে। বলেছেও তাই, করেছেও তাই।
বিএনপির চেয়েও অগোছালো ছিল ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার প্রকাশনা অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠানে ইশতেহার পড়া হয়েছে সবচেয়ে কম। রাজনৈতিক মেঠো বক্তৃতা হয়েছে বেশি। অন্তত ৬ জন বক্তব্য রেখেছেন। বিএনপি আর ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার পড়ে, দেখেশুনে আমার মনে হয়েছে, তারা বুঝে গেছে, তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে না বা ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছাও তাদের নেই। নইলে ‘পুলিশ ও সেনাবাহিনী ব্যতিত সরকারি চাকরিতে প্রবেশের কোনো বয়সসীমা থাকবে না’ এমন একটি উদ্ভট অঙ্গীকার কেমন করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মত একটি সুশীল জোটের ইশতেহারে থাকতে পারে?
বিএনপির মত একটি দল, যারা দফায় দফায় অন্তত ১৫ বছর দেশ চালিয়েছে, তারাও এই ইউটোপিয়ান অঙ্গীকারে সুর মিলিয়েছে। তারা কি ভাবছেন, এমন অঙ্গীকার করলেই যুবসমাজ দল বেধে তাদের ভোট দিয়ে দেবে। যদি ভেবে থাকেন, তাহলে সেটা ভুল। আচ্ছা আপনারা কেউ কি মনে করেন, এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নযোগ্য বা বাস্তবায়ন করা উচিত? আমি অন্তত মনে করি না।
ঐক্যফ্রন্ট যখন বলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম পুরোপুরি বন্ধ করা হবে, আমি বিশ্বাস করি। ড. কামাল হোসেনের হাতে ক্ষমতায় থাকলে অন্তত দেশে ক্রসফায়ার বা গুম হবে না। কিন্তু তার জোটসঙ্গী বিএনপির ওপর আমার অত আস্থা নেই। বাংলাদেশের বর্তমান ধারার ক্রসফায়ার চালু করেছে বিএনপি। অপারেশন ক্লিনহার্টের দায় বিএনপির। র্যাবের প্রতিষ্ঠাতা বিএনপিই আজ র্যাবের কাঠামো বদলে দিতে চায়।
বিএনপির ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেবে, প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ন্যায়পাল নিয়োগ দেবে, দলীয় আনুগত্য বিবেচনা না করে পুলিশ-প্রশাসনের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হবে- এমন অনেক ভালো ভালো কথা আছে। পড়তে খুব ভালো লাগে। কিন্তু সাথে একটা ছোট্ট প্রশ্নও জাগে, ভবিষ্যতে করবেন, অতীতে করেন নাই কেন? বিএনপি যখন বলে ‘জাতীয় সংসদকে সকল জাতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হবে’ তখন আসলে আমার হাসি পায়।
বাংলাদেশে সংসদকে অকার্যকর করার যতটা দায় আওয়ামী লীগের, বিএনপির দায় তারচেয়েও একচুলও কম নয়। যখন যে বিরোধী দলে ছিল, সেই টানা বর্জন করে সংসদকে অকার্যকর করেছে। আর বিএনপি তো ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে নিজেদেরকে সেই ‘সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু’ থেকে নিজেদের ছিটকে ফেলেছে।
বিএনপি যদি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন না করতো, তাহলে সংসদ আজ এমন হাস্যকর হতো না, আওয়ামী লীগও এমন একতরফাভাবে দেশ চালাতে পারতো না।
বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট তাদের ইশতেহারে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের অঙ্গীকার করেছে। ড. কামাল সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ দিয়ে এমপিদের হাত-পা বেধে রাখলেও এখন তিনি নিজেই সেটা বাতিল করতে চান। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, পরপর দুবারের বেশি কারো প্রধানমন্ত্রী না হওয়া ইত্যাদি প্রতিশ্রুতি শুনতে দারুণ লাগে। হলে ভালো। আ স ম আব্দুর রব সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠায় তার ব্যক্তিগত এজেন্ডা অনায়াসে ঢুকিয়ে দিয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে। কিন্তু বিএনপির ইশতেহারেও রবের কোরাস শুনে অবাক হয়েছি, সময়ে সরব আ স ম রবের প্রভাব তো কম নয়। তবে রবের ক্ষমতা বা প্রভাব যতই হোক না কেন, আমি গ্যরান্টি দিয়ে বলতে পারি; বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট যেই ক্ষমতায় আসুক; সংসদে উচ্চকক্ষ হবে না। ইশতেহারে এমন কথার কথা অনেক আছে।
সবচেয়ে বড় কথার কথা বিএনপির ইশতেহারে জিডিপি নিয়ে। বিএনপি যখন আশা করে, আগামী পাঁচ বছরে প্রবৃদ্ধির হার ১১ ভাগ হবে, তখন বুঝি; তারা আসলে ক্ষমতায় যেতে চায় না। চাইলে এমন অবাস্তব কথা বলতো না। স্বপ্নের পোলাওয়ে ঘি একটু বেশি দিলে অসুবিধা নেই, তবে বেশি বেশি দিলে বদহজম হতে পারে।
বিএনপি বলছে, তারা প্রতিহিংসামুক্ত সহমর্মী সমাজ চায়। ঐক্যফ্রন্টও বলছে, ‘প্রতিহিংসা বা জিঘাংসা নয়, জাতীয় ঐক্যই লক্ষ্য’। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার। বিএনপি ক্ষমতায় আসলেই লাখ লাখ লোক মেরে ফেলবে, আওয়ামী লীগ নেতারা এমন একটা ভয় ছড়াতে চাইছেন। তাই জান বাঁচাতে তারা যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। কিন্তু বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট বারবার বলছে, প্রতিহিংসা নয়। দারুণ অঙ্গীকার। ঐক্যফ্রন্টের আশ্বাসে না হয় আস্থা রাখা যায়। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনের পরের বাংলাদেশের স্মৃতি মনে এলে বিএনপির অঙ্গীকারে বিশ্বাস রাখা কঠিন।
দুটি ইশতেহারই অসাধারণ কথামালায় সাজানো। কিছু সংশয় জানালাম বটে, তবে আমি আশাবাদী মানুষ। আশা করি বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে আমার সংশয় উড়িয়ে দিয়ে তাদের ইশতেহার বাস্তবায়ন করবে। তবে ইশতেহারে শুধু ক্ষমতায় গেলে কী হবে, তার অঙ্গীকার আছে। তবে বিরোধী দলে গেলে কে কতটা দায়িত্বশীল হবেন, কতটা জনগণের পাশে থাকবেন; তারও অঙ্গীকার দরকার ছিল। কারণ গত ১০ বছরে আমরা সাধারণ মানুষ কাউকে পাশে পাইনি, পাইনি একটা দায়িত্বশীল বিরোধী দলও।
বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারের সবচেয়ে বড় অমিলটা দিয়েই শেষ করি লেখাটা। ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বিএনপি স্পিকটি নট। এখন জামায়াতের সাথে অভিন্ন প্রতীকে নির্বাচন করে ঐক্যফ্রন্ট কোন মুখে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়? ১৯ আসন নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর দলের পক্ষে কীভাবে সম্ভব ২৪১ আসনের দলের ইচ্ছার বাইরে কিছু করার? এ প্রসঙ্গ বরং বিএনপি অনেক সৎ। যেটা তারা পারবেন না, সেটা তারা বলেনওনি। আমি শুধু ভাবছি, ধানের শীষ জিতলে কার ইশতেহার বাস্তবায়িত হবে- বিএনপির না ঐক্যফ্রন্টের?
প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.