প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ
আইন ও নিয়ম তর্ক বা কুতর্ক মানে না। মানে যুক্তি ও বৈধ প্রমাণপত্র। কিন্তু আমাদের দেশে যুক্তির জায়গা দখল করে তর্ক। কিংবা বলা যায় কুতর্ক, যা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে এবং বহুজন তা দেখেছেনও। লকডাউনে উপযুক্ত, আইনানুগ, কাগজপত্র তথা পরিচয় পত্র চাওয়ার পর পুলিশের সাথে একজন ডাক্তারের তর্ক বা কুতর্কের বিবরণ রয়েছে ভিডিওটিতে।
এ রকমের একটি বিষয় ভিডিও হয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার কথা নয়, বিষয়ও নয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে সাধারণ পৌরনীতি পড়ানো হয়, সেখানে আইনকানুন মান্য করার পাশাপাশি নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য শিক্ষা দেওয়া হয়। সে শিক্ষা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, অফিসার নির্বিশেষে সকলেরই জানা থাকার কথা।
বিধান অনুযায়ী, সকল নাগরিক আইন বা নিয়ম মেনে চললে নাগরিক বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তথা কারোই কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাংলাদেশে সব সময় তা হয় না। বৈধ কাগজ বা পরিচয়পত্র না থাকলেও অনেকে একে অপরাধ মনে করেননা এবং তর্ক থেকে কুতর্ক শুরু করে দেন। অথচ বৈধ ও প্রকৃত মানুষটিকে চিহ্নিত ও শনাক্ত করার জন্য পুলিশের পক্ষে নজরদারি ও তল্লাশি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি একটি কাজ এবং এতে সহযোগিতা করা সকল নাগরিকের একান্ত কর্তব্য।
কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। বাস্তবে পরিস্থিতি জটিল, উতপ্ত ও তর্কাতর্কি ইত্যাদির মাধ্যমে স্পর্শকাতর আকার ধারণ করে। এমনকি, আইন না মানার একটি প্রবণতাও কারো কারো মধ্যে দৃশ্যমান হয়। বিশেষত, কোনো কোনো ‘নামধারী’ সাংবাদিক, চিকিৎসক বা অন্য পেশাজীবীরা একটি বিশেষ সুবিধা নিতে চায়। কিংবা সামাজিক বা পারিবারিক বা আঞ্চলিক পরিচিতির সুবাদে আইনকে অগ্রাহ্য করতে চায়। অথচ বৈধ পরিচয়পত্র দেখালেই সমস্যা মিটে যায়। তা না করে হৈচৈ-এর মাধ্যমে ‘সিন ক্রিয়েট’ করা অনেকের নিম্নরুচি ও কুঅভ্যাসের অংশ।
ভাবখানা এমন যে, আমি ডাক্তার তাই আমার আইন মানার দরকার নাই। আমি অমুকের তমুক, তমুকের অমুক, তাই আইন মানার দরকার নাই। আমি পদবীতে সিনিয়র, তাই আমারও দরকার নাই। আমার বাবা, নানা, দাদা অমুক-তমুক, তাই আমার জন্য আইনের দরকার নাই। প্রশ্ন হলো, তাহলে আইন কার জন্য প্রযোজ্য?
যে ভিডিও নিয়ে কথা হচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, একজন নিজেকে চিকিৎসক দাবি করে পরিচয়পত্রের বদলে গাড়ির স্টিকার, অ্যাপ্রোন দেখাচ্ছে। এতে তার পরিচয় সুনির্দিষ্ট হয় না। অনেক জালিয়াত স্টিকার, অ্যাপ্রোন পরিধান করে আইনের চোখকে ফাঁকি ও ধাপ্পা দিতে পারে। স্বাস্থ্য সেক্টরে ভয়ঙ্কর প্রতারক সাহেদ ও সাবরিনা গং তেমনই করেছে। ফলে, যেকেউ বৈধ কাগজেপত্রের ভিত্তিতে নিজেকে প্রকৃত পেশাজীবী প্রমাণ করতে বাধ্য এবং তার তেমন সুযোগ ও অধিকার রয়েছে। এবং তিনি যে জালিয়াত নন, সেটা সঠিক প্রমাণপত্রের ভিত্তিতে প্রমাণ করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দায়িত্ব। আর প্রকৃত পেশাজীবীর অবশ্যই বৈধ পরিচয় ও প্রমাণপত্র থাকার কথা, তার পক্ষে ‘সিন ক্রিয়েট’ বা নাটক করে উত্তেজনা ছড়ানোর কোনো কারণই থাকতে পারে না।
বরং মতলববাজ শ্রেণির লোকজন এমন পরিস্থিতিতে জল ঘোলা করতে আগ্রহী হতে পারে, প্রকৃত পেশাজীবী নন। কঠোর লকডাউন পরিস্থিতিতে অনেক পেশার মানুষ চলাচলের সুবিধা পেয়েছেন। তাদেরকে উপযুক্ত প্রমাণ দিয়েই সুবিধাটুকু নিতে হবে। হৈ-হাঙ্গামা করে কিংবা উত্তেজনা ছড়িতে কিছু করতে যাওয়াই বরং সন্দেহজনক বলে বিবেচিত হতে পারে।
পাশাপাশি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনির পক্ষ থেকেও অধিক কঠোরতা ও চরম আচরণ কাম্য নয়। প্রকৃত পেশাজীবী এবং সঠিক মানুষ যেন হেনস্থার শিকার না হন, সেটা নিশ্চিত করাও সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য। দেশে এবং সারা বিশ্বেই করোনার কারণে একটি চরম আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি ও জরুরি অবস্থা চলছে। এতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং জনগণকে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সঙ্কট মোকাবেলায় কাজ করতে হবে।
এমতাবস্থায়, ভুল বোঝাবুঝি বা দূরত্ব সৃষ্টির যেকোনো ঘটনাই চরম নিন্দনীয়, অনাকাঙ্ক্ষিত ও পরিত্যাজ্যা। ফলে সংশ্লিষ্টদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে এবং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। এক বা দুইজনের তর্ক, কুতর্ক বা উত্তেজনার মাধ্যমে পুলিশ, ডাক্তার বা অন্যান্য কোনো পেশার মধ্যেই যেন দূরত্ব ও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়, সেটা সকলে মিলেই নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক মানুষকে সঠিক সেবা প্রদান করার এবং ভুয়া বা জালিয়াতকে নিবৃত্ত করার মূল লক্ষ্য সম্পর্কে সরকারি-বেসরকারি সকলে সতর্ক হলেই যাবতীয় সমস্যার পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং তা হতে হবে যথাযথভাবে আইন ও নিয়ম মানার মাধ্যমেই।
প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ
রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.