জয় হোক মানবতার, ক্ষয় হোক জঙ্গিবাদের

চারদিকে বিস্ফোরণ, গুলি, খুন, রক্ত, চিৎকার; প্রায় যুদ্ধক্ষেত্র। এরমধ্যেই জেগে ওঠে মানবতা। সিলেটের শিববাড়ির আতিয়া মহলে আটকেপড়াদের উদ্ধারের সময় নাম না জানা এই সেনা সদস্য পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরেছেন এই শিশুটিকে। হয়তো তার বাসায় ফেলে আসা নিজের সন্তানের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল, হয়তো নয়। সেনাবাহিনীর পোশাক পরা, তারা কিন্তু আমাদের মত রক্তমাংসের মানুষই।

বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটা থেকে অভিশপ্ত আতিয়া মহল ঘিরে রেখেছে পুলিশ। তারপর ঢাকা থেকে সেখানে যায় সোয়াট। শনিবার সকাল থেকে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোরা শুরু করে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। আমরা পুরোটা জানি না, কিন্তু কিছু হলেও তো জানি তারা কতটা ঝুঁকি নিয়ে অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু নিজেদের নিরাপদ বাসায় বসে ফেসবুকে বিপ্লব করে ফেলছি। এত লম্বা সময় লাগছে কেন? কেন ট্যাংক দিয়ে পুরো বাড়ি উড়িয়ে দিচ্ছে না? এটা অভিযান নয় নাটক। সরকারের ব্যর্থতা আড়াল করতেই এ নাটক সাজানো হচ্ছে। ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি করতেই এ নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। ইত্যাদি ইত্যাদি নানান মত।

কেউ সন্দেহবাতিকগ্রস্থ, কেউ বিশেষজ্ঞ। কিন্তু বিপুল পরিমাণ অস্ত্র আর বিস্ফোরক নিয়ে শরীরে সুইসাইড ভেস্ট বেঁধে মরতে তৈরি হওয়া জঙ্গিদের সাথে লড়াই করা আর বাসায় বসে বিপ্লব করা এক কথা নয়। ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ কোনো থ্রিডি সিনেমা বা কম্পিউটার গেমস নয়। এ হলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস্তব যুদ্ধে নামা। অভিযান চালানো নিশ্চয়ই আনন্দের ব্যাপার নয় যে তারা ইচ্ছা করে প্রলম্বিত করবেন।

আমরা নিশ্চয়ই হলি আর্টিজানের কথা ভুলে যাইনি। সেখানে প্রথম প্রতিরোধেই প্রাণ দিয়েছিলেন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। সবকিছুর আগে জীবন বাঁচানো। এত সতর্কতা স্বত্বেও কিন্তু সিলেটে প্রাণহানি ঠেকানো যায়নি। শনিবার সন্ধ্যায় সেনাবাহিনীর ব্রিফিঙের পরপরই কাছাকাছি এলাকায় এক বিস্ফোরণে দুই পুলিশসহ মারা গেছেন ৬ জন। আপনারা যতই নাটক বলুন জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম এবং পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক চৌধুরী আবু মো. কয়সর জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এ কোনো নাটক নয়। র‌্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। র‌্যাবের মেজর আজাদ চিকিৎসা নিচ্ছেন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। সিলেটের ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরো অনেকে।

atya‘অপারেশন টোয়াইলাইট’-এর প্রথম টার্গেট ছিল আতিয়া মহলে আটকেপড়া মানুষদের নিরাপদে উদ্ধার করা। সেটা তারা করেছেন দারুণ কৌশলে। ৫ তলা আতিয়া মহলের নিচতলায় ছিল জঙ্গি আস্তানা। আর জঙ্গিরা বিস্ফোরক লাগিয়ে ভবনের নিচতলা ঝুঁকিপূর্ণ করে রেখেছিল, যাতে কমান্ডোরা ঢুকতে না পারে। কিন্তু আমাদের দক্ষ কমান্ডোরা পাশের ভবনের ছাদের সাথে আতিয়া মহলের সেতু বানিয়ে ওপর থেকে মানুষদের উদ্ধার করেছে। নিচতলার পাশের লোকদের আনা হয়েছে, দেয়াল ভেঙে আর গ্রিল কেটে। অপারেশন টোয়ালাইটের প্রাথমিক সাফল্য নিরাপদে ৭৮ জনকে উদ্ধার করা। বাকি কাজ করুক তাদের মত। আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।

জঙ্গিবাদ নিয়ে অনেকদিন ধরেই পাল্টাপাল্টি দোষারোপের রাজনীতি চলছে। আওয়ামী লীগে বলছে, জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে বিএনপি। আর বিএনপি বলছে, জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী। কিন্তু যারা দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে জীবন দিয়েছে বা মৃত্যুর সাথে লড়ছে; তাদের কাছে বিষয়টা রাজনীতির নয়, নাটক নয়, দীর্ঘসূত্রতা নয়। নিরেট বাস্তবতা। জীবন-মৃত্যুর লড়াই।

জঙ্গিবাদ আসলে বাংলাদেশের সমস্যা নয়, কোনো দলের সমস্যা নয়; এটা জাতীয় সমস্যা। নিছক জাতীয় সমস্যা নয়, এটা আসলে বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের বিষ থেকে মুক্ত রাখতে হলে সবাইকে এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে জনগণকে সাথে নিয়ে। প্রয়োজনে সশস্ত্রবাহিনী বা আইনশৃঙ্খলাবাহিনী তাদের কাজ করবে। কিন্তু সমস্যাটা যেন আইনশৃঙ্খলা পর্যায়ে না যায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে রাজনীতিবিদদেরই। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়তে হবে।

শুরুতে যে ছবির কথা বলেছি, সেটাই আসলে মানবতার জয়গান গায়। আমরাও নিশ্চিত জানি জয়  হবে  মানবতার,  ক্ষয় হবেই জঙ্গিবাদ।

 প্রভাষ আমিন : সাংবাদিক, কলাম লেখক।

probhash2000@gmail.com

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.