ডেস্ক নিউজ:
আইনসিদ্ধ না হওয়া সত্ত্বেও বিচারপ্রার্থীকে জামিন করানোর নামে একটি চক্র সাত লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।ভুক্তভোগীদের দাবি, ‘জামিন প্যাকেজ’র অফারে সাড়া দিয়েই এই হাল তাদের। টাকা হারিয়ে এখন পথে বসেছেন তারা। তবে আইনজীবীর পাল্টা অভিযোগ, ভুক্তভোগীরা দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে তাকেও বিষিয়ে তুলেছেন। তাই উভয়পক্ষ উপায়ান্তর খুঁজতে এসেছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কাছে।
ঘটনাসূত্রে জানা গেছে, বিয়ের পর প্রবাসে কর্মরত স্বামী চলে যান দুবাইয়ে। স্বামীর অবর্তমানে কেরানীগঞ্জের লংকারচর ইটাভাড়া এলাকায় শ্বশুরবাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন এক সন্তানের জননী এক নারী (২২)। পরে প্রতিবেশী মো. রমজান আলীর (৩০) সঙ্গে বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এর ধারাবাহিকতায় বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ওই নারীকে বারবার ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে রমজান আলীর বিরুদ্ধে। পরে ওই নারীর বাবা ধর্ষণের অভিযোগ এনে ২০২০ সালের ৮ আগস্ট রমজানের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় রমজানকে আটক করে পুলিশ।
কিন্তু রমজানের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, গ্রেফতারের পর আইন অনুসারে রমজানকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোর্টে তোলা হয়নি।একাধারে তাকে প্রায় পাঁচ দিন কলাতিয়া পুলিশ ফাঁড়িতে আটকে রাখা হয়। এরপর রমজানের বাবার অনুরোধে তাদের আত্মীয় মো. আবু সাঈদ মামলার খোঁজ খবর নিতে শুরু করেন এবং রমজানের জামিনের চেষ্টা চালান। তবে দীর্ঘদিন ধরে রমজানকে থানা হাজতে আটকে রাখা এবং তার জামিন চাওয়ার সুযোগ না পেয়ে আবু সাঈদ যোগাযোগ করেন তারই প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম সাজুর সঙ্গে। আবু সাঈদকে নিউমার্কেট এলাকার আতিক নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন সাজু। এরই মধ্যে রমজানকে কোর্টের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। তাই রমজানের জামিন করাতে আতিকের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন আবু সাঈদ।
প্রশ্ন আসে, তাহলে কে সেই আতিক? এর জবাবে সাইফুল ইসলাম সাজু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আতিক নিউমার্কেট এলাকায় থাকে। সে একটি টিভি চ্যানেলের প্রেস কার্ড ব্যবহার করে। তবে সে টিভি এখনও সম্প্রচার লাইসেন্স পায়নি। তার সঙ্গে পুলিশের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তাই আমি আতিকের সঙ্গে আবু সাঈদকে যোগাযোগ করতে বলি।
এদিকে অসহায় বিচারপ্রার্থীদের কাছে পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে আতিক। সে রমজানের জামিন করিয়ে দিতে পারবে জানিয়ে খরচ বাবদ আবু সাঈদের কাছে তিন লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে সম্মত হওয়ায় আবু সাঈদ ও রমজানের ভাইকে মতিঝিলে অ্যাডভোকেট মাসুমা খাতুনের চেম্বারে নিয়ে যায় আতিক। ওই চেম্বারে ‘জামিন প্যাকেজ’ হিসেবে বিচারপ্রার্থীদের কাছে আরও তিন লাখ টাকা চাওয়া হয়। তখন দুই ধাপে ৫০ হাজার টাকা করে মোট এক লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। তার কিছুদিন পরে রমজানের জামিন করাতে আরও এক লাখ টাকা আতিককে দেওয়া হয়।
তবে রমজানের জামিন করাতে আরও সাড়ে চার লাখ টাকা দাবি করে আতিক। বিপাকে পড়েন রমজানের স্বজনরা।
আবু সাঈদ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘জামিন প্যাকেজে’র কথা বলে তারা আমাদের কাছে আরও সাড়ে ৪ লাখ টাকা দাবি করে। আতিক আমাদের জানায়, যেদিন দুপুর ১২টার মধ্যে টাকা পাওয়া যাবে সেদিনই বিকাল ৪টার মধ্যে রমজানের জামিন করিয়ে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসা হবে। আবার সাইফুল ইসলাম সাজু আমাদের জানায়, আরও এক লাখ টাকা দিতে হবে। আইন সচিবের পিএ জাকির হোসেনকে দিতে হবে এই এক লাখ টাকা। একইসঙ্গে সচিবের বাসায় দই, মিষ্টি ও ফলমূল পাঠাতে হবে বলে আরও আট হাজার টাকাসহ মোট এক লাখ আট হাজার টাকা সাজুর হাতে তুলে দেই।’
তিনি বলেন, ‘তাদের কথায় বিশ্বাস করে অনেক কষ্টে রমজানের বাবা জমি বিক্রি করে চার লাখ টাকা মাসুমা ম্যাডামের (আইনজীবী) হাতে তুলে দেন। বান্ডিলগুলোতে মোট চার লাখ টাকা আছে কিনা, তা নিয়ে ম্যাডাম নিজের চেম্বারে বসে আতিকের সঙ্গে উপহাস করতে থাকেন। তিনি আতিককে বান্ডিলগুলো দেখিয়ে বলতে থাকেন, এই চার বান্ডিলে কি চার লাখ টাকা আছে আতিক? তাদের এমন আচরণ চেম্বারের সিসি টিভি ফুটেজেও রেকর্ড আছে। এরপর থেকে আমরা জামিনের খোঁজ-খবর নিতে শুরু করি। কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বার বার বলছেন, আজ-কালের মধ্যে জামিন করাবেন। আবার কখনও কখনও ফোনও রিসিভ করেন না। প্রায় চার মাস হতে চললো, তারা জামিন না করিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে এ পর্যন্ত সাত লাখ আট হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আমাদের নিঃস্ব করে পথে বসিয়েছে।’
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট মাসুমা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শুরু থেকেই মনে হয়েছিল এ মামলায় বেশ কিছু দালাল যুক্ত হয়ে পড়েছে।আর রমজানের শ্বশুর এবং ভাইয়ের মধ্যকার সম্পর্ক ভালো না থাকায় তারা জামিন নিয়ে টালবাহানা করছিল। তাই আমিও এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি আবেদন দিয়েছি। একইসঙ্গে আমি মামলার টাকা ফেরত দিতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।’
রমজানের আরেক আত্মীয় আব্দুল কাফি অভিযোগ করেন, ‘টাকার জন্য আমিও আতিককে বারবার ফোন করেছি। কিন্তু সে বাড়িতে কয়েকবার লোক পাঠিয়ে আমাকে তুলে আনার চেষ্টা করেছিল। এজন্য আমি প্রায় দেড় মাস বাড়িছাড়া ছিলাম। এমনকি কিছুদিন আগে আতিক আমাকে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে এনে গুলি করে মেরে ফেলার ভয় দেখায়। তাই কোনও উপায় না পেয়ে আমরা অন্য আরেকজনের পরামর্শে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেই।’
জামিন করানোর ক্ষেত্রে কোন ‘প্যাকেজ’ পদ্ধতি আইনসিদ্ধ কিনা জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির অন্যতম কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট মো. হুমায়ুন কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একজন আইনজীবী আইনগতভাবে তার মক্কেলের কাছ থেকে ফি নিতে পারেন। তবে মামলা জিতিয়ে দেবেন, রায় এনে দেবেন বা অবশ্যই জামিন করিয়ে দেবেন- এমন শর্তে বা প্যাকেজে কখনোই মক্কেলের থেকে আইনজীবী টাকা নিতে পারেন না। এরপরও যদি কোনও আইনজীবী এভাবে প্যাকেজের কথা বলে টাকা নেয় তবে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে লিখিত অভিযোগ দায়েরের সুযোগ রয়েছে।’
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.