চট্টগ্রামে গ্রাহকের শত কোটি টাকা নিয়ে উধাও “ডিজিটাল কিং মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি”

জে.জাহেদ,চট্টগ্রাম ব্যুরো:

প্রায় চার হাজার গ্রাহকের শত কোটি টাকা নিয়ে চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকা থেকে উধাও হয়ে গেছে ‘ডিজিটাল কিং মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ’ নামের একটি সমিতি। যেটি মূলত ডিপিএস,প্যাকেজ ও এফডিআরসহ সঞ্চয় ঋণ দান সমবায় সমিতি নামে পরিচিত। যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়ের অধীনে চলতো।

বিগত কয়েকমাস যাবত নগরীর সি,ই,পি,জেড মোড় ঝনক প্লাজার (৪র্থ তলা) ডবলমুরিং থানা এলাকা থেকে এই সমিতির অফিস বন্ধ করে হাওয়া হয়ে যায়। তবে খবর পাওয়া যায়,অফিস বন্ধ রাখলেও নতুন মোড়কে প্রতারক চক্রের ওবাইদুল্লাহ রুবেল, মঞ্জুরুল করিম (সুমন), রানা আহমেদ, মোছাঃ রেহানা পারভীন, মোঃ তৈয়বুর রহমান, মোঃ ইলিয়াছ হাওলাদার বহাল তবিয়তে ঘুরছে।

এছাড়াও ডবলমুরিং এলাকায় ‘রুপসা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ,নিউ সানি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ, কিং ডিজিটাল রিচার্জ লিমিটেড (কেডিআরএল), ডিজিটাল কিং মাল্টিপারপাস লিমিটেড (ডিকেএমএল) নামে বিভিন্ন সমিতি পুনরায় সুকৌশলে গ্রাহকের পকেট কাটছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়, একাজ গুলো করছে মূলত চট্টগ্রাম ডবলমুরিং থানা সমবায় অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী নেতাদের হাত করে। এভাবে নগরীর ডবলমুরিং এলাকায় গড়ে তোলেছে নামে বেনামে ব্যাঙ্গের ছাতার মত প্রায় অর্ধশত সমবায় সমিতি। যার কোন সঠিক তথ্য থানা সমবায় ও দিতে পারেন নি।

ইপিজেড এলাকার হতদরিদ্র ৪ হাজার গার্মেন্টস কর্মীরা তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের একটু আশা করেছিল। সে আশায় সঞ্চয়ী ঋণ দান এই প্রতিষ্ঠানকে কষ্টে জমানো অর্থ তুলে দিয়ে এখন সহায়-সম্বলহীন। যে সমিতিতে প্রতিদিন জমা পড়ত ২৮-৩০লক্ষ টাকা ,প্রতিমাসে ৯০ কোটির উপরে। অবিশ্বাস্য হলেও তা সত্য অথচ উপায়ন্তু না পেয়ে ভুক্তভোগীরা ডবলমুরিং থানায় মামলা করতে গেলেও টাকা না দেয়ায় পুলিশ মামলা নিতে রাজি হয়নি বলে জানান অনেক গ্রাহক।

একপর্যায়ে গ্রাহকেরা উপায়ন্তর না দেখে সাংবাদিকদের কাছে দাবি জানিয়েছেন, একাধিক বার সমবায় অফিসে এ বিষয়ে সহযোগিতা চাইলেও পাচ্ছেনা । এতে সংশ্লিষ্ট সমবায় অফিসের অসাধু কর্মকর্তা ,সহকারি পরিদর্শক, পরিদর্শক ও সমিতির লোকজনের বিরুদ্ধে দুদকের ব্যবস্থা নিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

মাসিক লাখে তিন হাজার ও অধিক মুনাফা আশায় পুর্বের নাম “বনায়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি লিঃ বর্তমানে ডিজিটাল কিং মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি”তে মেয়ের বিয়ের তিন লাখ টাকা রেখেছিলেন পোশাক শ্রমিক শাহানা। কথা ছিল দুবছর পর ২লাখ দিবে লভ্যাংশ হিসেবে কিন্তু এখন আসল টাকাও পাচ্ছেনা বরং যারা টাকা নিয়েছে তাঁরা নিউ সানি ইলেকট্রনিক্স নামে শো রুম খুলে বসেছে বলে অভিযোগ তার।

আরেক গার্মেন্টসকর্মী রহিমা এক বছর আগে প্রতিবন্ধী সন্তানের কথা ভেবে ৮৫হাজার টাকা রেখেছিলেন মুনাফা তো দ‚রের কথা, এখন আসল টাকাই ফেরত পাবেন কিনা, তা নিয়ে চিন্তায় রাতের ঘুম ছেড়ে দিয়েছেন।

শুধু কি ওরা, ওদের মতো হাজারো নারী গার্মেন্টস শ্রমিক আজ ফকির । যারা টাকা তুলতো তাঁরা আজ কোটিপতি ,বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স শো রুমের মালিক বনে যায় রাতারাতি। কেউ বা ওবাইদুল্লাহ রুবেল এর মত ১৩ মেইন রোড মোহাম্মাদীয়া হাউজিং মোহাম্মাদপুর ঢাকায় “আলো ফাউন্ডেশন” এর মালিক হয়ে যায় কেমনে? এরকম হাজার হাজার মানুষের জমা রাখা কোটি কোটি টাকা নিয়ে উঁধাও হয়ে গেছে ভ‚ঁইফোড় ডিজিটাল কিং মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির অফিস।

সমবায় অফিসের রহস্যজনক নীরবতায় ৪হাজার গ্রাহক আজ পথে বসেছেন । অন্যদিকে মুনাফার আশায় টাকা জমা রেখে এখন দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন গ্রাহকরা। জমা দেওয়া আমানত ফেরত পাবেন কিনা- তা নিয়ে রীতিমত শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন হাজার হাজার গ্রাহক।

এদিকে, টাকা ফেরত না দিয়ে উল্টো গ্রাহককে নানা হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগও রয়েছে। এতে বিক্ষুব্ধ গ্রাহকরা স¤প্রতি ডিজিটাল কিং মাল্টিপারপাস সমিতির অফিস ঘেরাও করেন। কি›তু অফিসে কাউকে পাওয়া যায়নি।

আমাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে চাঞ্জল্যকর তথ্য, ২০০৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর এই সমবায় সমিতিটি আতœপ্রকাশ করে কার্যক্রম শুরু করে “বনায়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি লিঃ”নামে যার গভঃ রেজি নং ছিলো -৮১৯৫। তখনকার অফিস দেখিয়েছিল নগরীর দেওয়ানহাট পাঠানটুলী এলাকায়।

এরা প্রথমে গ্রাহক আকৃষ্ট করতে মাঠে কিছু ঋণ ও ছাড়েন সমিতির ২০জন কৌশলী অংশীদার। যাদের মধ্যে মোঃ আবু তাহের সভাপতি, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর রেহান উদ্দিন রানা, অর্থ সম্পাদক সেজেঁ মোঃ আবুল কালাম আজাদ সমবায় সমিতি থেকে কাগজে কলমে অনুমোদন নেয়। কিন্তু রুপসা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ এর চেয়ারম্যান ওবাইদুল্লাহ রুবেল কৌশলে এই সমিতিকে ঘায়েল করে নেয়।

এক পর্যায়ে কয়েক হাজার’ গ্রাহকের ২৯ কোটি টাকা নিজের ব্যক্তিগত হিসাবে জমা রেখে ২০১৫ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর অফিসের অসাধু ব্যক্তিদের আতাঁত করে এমএনমেন্ট প্রক্রিয়ায় সংশোধিত নাম পাল্টিয়ে ফেলে সমিতি।

নতুন করে নাম হয়ে যায় “ডিজিটাল কিং মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ” ফলে নতুন গভঃ রেজি নং-৪৩২ এবং অতি সহজে গ্রাহকের টাকা মেরে লাপাত্তা হওয়ায় সুর্বণ সুযোগ করে নেয়।এতে মাথায় বাজ পড়ে যায় দুর্বল এই সমবায় সমিতিতে যারা টাকা রেখেছিলো। একাজে যারা জড়িত ছিলো বলে ধারণা করছে তাঁরা হলেন ডবলমুরিং থানা সমবায় অফিসের রুস্তম,পরিদর্শক সুদীপ দাশ,জয়নাল আবদীন, থানা অফিসার শহিদুল ইসলাম। কেননা তারা কোন ধরনের আইনী ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো নতুন সমিতি গড়ার সুযোগ দেয় বলে গ্রাহকের ক্ষোভ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকে দুদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক মোঃ শেখ ফরিদ বলেন, লাখে ৩ হাজার টাকা মুনাফা দেওয়ার কথা। গত দুই আড়াই বছর ধরে কোনো মুনাফা দিচ্ছে না। আবার ডিপোজিটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও তাঁরা ম‚ল টাকা ফেরত দিচ্ছে না। এখন আমরা কি করবো বুঝতে পারছি না। আমার তিন লাখ টাকা জমা রয়েছে।

টাকা জমা রেখে ফেরত না পাওয়া শত শত গ্রাহক ও গার্মেন্টস শ্রমিকেরা জানায়, প্রথম কিছুদিন লাভ দেখিয়ে আসল টাকা নিয়েই লাপাত্তা ডিজিটাল কিং মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ।

এ ব্যাপারে ওবায়দুল্লাহ রুবেলের মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। তবে ডিজিটাল কিং মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ এর মঞ্জুরুল কবির সুমন সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি চাকরি করতাম ওখানে এর চেয়ে বেশি কিছু জানিনা। এখন অসুস্থ পরে কথা বলবো”।

ডবলমুরিং থানাধীন সমবায় সমিতি অফিসার শহীদুল ইসলাম জানান, “ডিজিটাল কিং মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ এর কোন দৃশ্যমান সাইনবোর্ড , ব্যানার নেই। সমিতির নামে সরকারী, বেসরকারী কোন ব্যাংক একাউন্ট নেই। ব্যক্তিগত একাউন্টে গ্রাহকের টাকা জমা রেখেছিলো, যার আয়-ব্যয়ের অডিট নাই”।

এমনকি জনগনের কোটি কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার কোন উৎস না রেখে,সমিতির অফিস বন্ধ রেখে পালিয়ে যায় । তাঁরা কিভাবে একের পর এক নতুন সমিতির অনুমতি পায় এমন প্রশ্নে বলেন, এবিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তখন অন্য অফিসার দায়িত্ব ছিলো। বর্তমানে বিষয়টি তদন্ত করছেন প্রতিবেদন তৈরী করে আইনি ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান”।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা সমবায় কর্মকর্তা কামাল হোসেন মুঠোফোনে জানান, “ডিজিটিাল কিং মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির ফাইলে আমি দেখেছি বহু আগে। তখন সমিতিতে ২৯ কোটি টাকা দেখে ছিলাম। কিন্তু এখন কোন হিসাব না দিয়ে দেউলিয়া রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি”।

অনুসন্ধানে প্রশ্ন থেকে যায়, যে সমিতির কোন ব্যাংক একাউন্ট থাকেনা, সরকারকে কর প্রদান করেনা,সমিতির আয়ের উৎস সম্পর্কে অবগত করেনা, কোনো জয়েন্ট স্টক থেকে নিবন্ধন করেনা, সমিতির রিসিটে সমবায় রেজিস্টার নাম্বার থাকেনা সেসব সমিতি কি করে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়ের অধীনে চলেমান রয় এর কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

তবে এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান সেজেঁ যারা অসহায় গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সে চক্রের কয়েকজনের পরিচয় গণমাধ্যমকর্মীদের হাতে এসেছে। তারা হলেন- নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার বাংলাবাজার বসন্তবাগ গ্রামের আব্দুল মোতালেব’র ছেলে ড্রাইভার ওবায়দুল্লাহ রুবেল, নোয়াখালী জেলার মঞ্জুরুল কবির সুমন ,চট্টগ্রাম মিরসরাই থানার একে আজাদ,বরগুনা পাথরঘাটা কাকচিরার সেলিম জমাদ্দার,বরগুনা তালতলী নিষানবাড়ীয়া গ্রামের মোঃ মিজান, বাগেরহাট মংলা থানার মোঃ আলী হোসেন,বাগেরহাট মোড়েলগঞ্জ থানার মোঃ রাজু প্রকাশ পাংখু রাজু,লক্ষীপুর সদর থানার মাহাবুব আলম বাচ্চু,বাগেরহাট মংলার তরিকুল ইসলাম,মোঃ রফিক।

সাধারণ জনগণ এসব থেকে মুক্তি চায় এবং গ্রাহকের টাকা ফেরত চায় হাজার হাজার ভুক্তোভোগীরা।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.