ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজার জেলায় তিন হাজারের বেশি বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত
#২০৯৬ মে.টন লবণের ক্ষয়ক্ষতি
#ঝুঁকিতে সেন্টমার্টিন জেটিঘাট
#ভেঙেছে বেড়িবাঁধ
ইমাম খাইর:
ভরা পূর্ণিমা ও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে পানির উচ্চতা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় কক্সবাজার জেলায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উপকূলীয় এলাকাগুলোতে উপড়ে পড়েছে গাছপালা। বিধ্বস্ত হয়েছে তিন হাজারের বেশি বসতবাড়ি, স্থাপনা। ভেসে গেছে চিংড়িঘেরের মাছ।
জোয়ারের পানির ধাক্কায় ভেঙে পড়ছে সেন্টমার্টিনের প্রধান জেটিঘাট। শাহপরীরদ্বীপ বাঁধের ব্লক সরে ঝুঁকিতে ৪০ হাজার মানুষ। সদরের ইসলামপুর, চৌফলদন্ডি ও পোকখালীর বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে পানিতে ডুবেছে ঘরবাড়ি।
কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া ও টেকনাফের ১৬ ইউনিয়নে ২০৯৬ মে.টন লবণের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যার অর্থের ক্ষতি অনুমান ৮৪ লাখ ৩৬ হাজার ৪০০ টাকা।
ঘুর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর প্রভাবে সমুদ্রে জোয়ারের পানি বেড়ে মেরিন ড্রাইভ প্রায় ছুঁয়েছে। ঢেউয়ের শেষ আচড়টা পড়ছে সোজা মেরিন ড্রাইভ সড়কে। কিছু এলাকায় সাগরতীরের মাটি ভেঙে পড়েছে।
তবে, মেরিন ড্রাইভ সড়কের কোথাও ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া য়ায় নি।
ইনানী রয়েল টিউলিপ এলাকা থেকে আনসার বাহিনীর এক সদস্য জানিয়েছেন, বুধবার (২৬ মে) সকাল ৯টা থেকে সাগরে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ঢেউ আছড়ে পড়ছে মেরিন ড্রাইভে। সমানতালে বাতাসও বইছে। বের হওয়া দায়। পানিতে প্রায় ডুবে গেছে নৌবাহিনীর নির্মিতব্য জেটিঘাট। তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও সাগরপাড়ের গাইডওয়ালে চড়ে জোয়ারের পানি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বেড়িবাঁধ ভেঙে কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডি, পোকখালী, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের শতাধিক গ্রামে ঢুকে পড়েছে জোয়ারের পানি। কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়া, নুনিয়ারছড়া পানিরকুপপাড়া, গোদারপাড়াসহ অন্তত ৮টি এলাকায় ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারো মানুষ।
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে প্রবল জোয়ারের পানিতে উপড়ে গেছে গাছপালা। ভাঙন ধরেছে জেটির পল্টুনে ও রাস্তাঘাটে। তবে মানুষের জানমাল রক্ষায় সব ধরণের প্রস্তুুতি রয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপে বেড়িবাঁধের ব্লকে ধ্বস নেমেছে।
সেন্টমার্টিনের ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হাবিব খান বলেন, দ্বীপে অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপড়ে গেছে গাছপালা। গত তিন দশকে এত বেশি পানি সেন্টমার্টিনবাসি আর দেখেনি জানিয়ে দ্বীপ রক্ষায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা না হলে যে কোনসময় সেন্টমার্টিন তলিয়ে যাবে বলে শংঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
মাতারবাড়ির ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাস্টার মাহমদুল্লাহ্ জানিয়েছেন, জোয়ারের পানিতে মাতারবাড়ির ইউনিয়নের ৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বিভিন্ন অংশ ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে পানি। ইতোমধ্যে ৫০ থেকে ৮০ টি ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। উপড়ে গেছে গাছপালা। স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে খাদ্য সহয়াতা দেওয়া হচ্ছে। রাতে জোয়ারে পানির উচ্চতা আবারও বৃদ্ধি পেলে এবং তা লোকালয়ে ঢুকে পড়লে তাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে বলে আশংকা করেছেন তিনি।
দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া থেকে বাসিন্দা ও স্থানীয় সংবাদকর্মী কায়সার সিকদার জানান, কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরুং, আলী আকবরডেইল ও কৈয়ারবিল ইউনিয়নে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ ভেঙে ২০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে করে প্রায় শতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ।
একইভাবে মহেশখালীর ধলঘাটাসহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রায় অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি তলিয়েগেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সংবাদকর্মী রকিয়ত উল্লাহ।
টেকনাফ উপজেলার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল মোস্তাফা জানান, শাহপরীরদ্বীপে জোয়ারের পানি ও ঝড়ো বাতাসে কিছু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেড়িবাঁধ। সেন্টমার্টিনের অবস্থা ভয়াবহ। তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে রাক্ষুসে সাগর। ভেঙে যাচ্ছে জেটির পন্টুন।
এদিকে ঘুর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর ঝুঁকি থেকে কক্সবাজার মুক্ত বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারি আবহাওয়াবিদ মো. আবদুর রহমান। তিনি বলেন, কক্সবাজারে ৩ নং সতর্ক সংকেত বহাল রয়েছে। সাগরের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর প্রভাবে সাগর এখন খুবই উত্তাল।
এদিকে, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ মামুনুর রশীদ জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে গত ২ দিনে কক্সবাজার জেলায় ২৫৭০ টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রাথমিকভাবে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
তিনি জানান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার নির্ধারিত ফরমে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ নিরূপণ করা হচ্ছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে লবণ, মাছ, কৃষিজ, ঘরবাড়ি, বেড়ীবাঁধ, পানেরবরজ, বনজ সহ সবকিছু আনা হবে। আগামী ২/৩ দিনের মধ্যেই ক্ষয়ক্ষতি চুড়ান্ত নিরূপণ করা যাবে।
জেলা প্রশাসক জানান, বৃহস্পতিবার (২৬ মে) মাতারবাড়ী এলাকার ৪ টি ক্ষতিগ্রস্ত পয়েন্ট এবং কক্সবাজার শহরের জলমগ্ন পশ্চিমাংশ নিজেই পরিদর্শন করেছেন। মহেশখালী, কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ী, সেন্টমার্টিনে ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধের বিষয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ারকে অবহিত করেছেন। ক্ষয়ক্ষতি দেখতে খুব শীঘ্রই তিনি কক্সবাজার সফরে আসতে পারেন।
তিনি আরো বলেন, সমস্যাসমুহ চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে কিভাবে বেড়িবাঁধগুলো টেকসই ও স্থায়ীভাবে নির্মাণ করা যায়, তা চিন্তা করা হবে। এজন্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের সময় তাঁর সাথে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী, স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ছিলেন।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.