গায়েবি মামলার সদর-অন্দরের ক্ষয়ক্ষতি

গোলাম মাওলা রনি

গায়েবি মামলা করার বুদ্ধি সরকারকে যে বা যারা দিয়েছে, তারা যে কত্ত বড় ধুরন্ধর এবং মীর জাফরি চরিত্রের মানুষ তা যখন ক্ষমতাসীনেরা অনুধাবন করবেন, তখন আর তাদের করার কিছুই থাকবে না। এ যাবৎকালে যতগুলো গায়েবি মামলা হয়েছে সেগুলোর হালহকিকত এবং প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে যেমন কর্তা ব্যক্তিরা বেখবর, তেমনি রাষ্ট্রীয় মদদে মিথ্যা মামলা দায়ের করে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে গিয়ে সরকার কিভাবে নিজেদের সর্বনাশ ঘটাচ্ছে তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না। রাজনীতির একটি চিরন্তন সত্য হলো চরিত্রহীন আমলা-কামলা যদি রাজনীতির নিয়ামক শক্তি হয়, তখন ঘুষ-দুর্নীতি, জুলুম-অত্যাচার রাক্ষুসে রূপ নিয়ে রাজনীতির আপন আলয়ের লোকজনকে গ্রাস করতে থাকে রূপকথার গল্পের মতো করে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা বিশ্লেষণ করলে রাষ্ট্রীয় অনাচারের ভয়াবহ অবস্থার যে প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে, তা দলমত নির্বিশেষে সবাইকে আতঙ্কিত করে তোলে।

আপনি যদি পত্রিকার পাতা খোলেন তবে প্রায়ই দেখতে পাবেন ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট, ভুয়া ডিবি কর্মকর্তা, ভুয়া র‌্যাব, ভুয়া মেজর ইত্যাদি নামে দুর্বৃত্তরা অহরহ গ্রেফতার হচ্ছে অথবা গণপিটুনির শিকার হচ্ছে। মাঝে মধ্যে আবার ওই সব নামের আসল লোকজনও অপকর্ম করতে গিয়ে ধরা খাচ্ছেন। এসব কেন হচ্ছে এবং কিভাবে হচ্ছে তা নিয়ে বিস্তারিত বলার আগে গায়েবি মামলার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কিছু বলে নিই।

আমাদের রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতি, অন্যায়-জুলুম-অত্যাচার, দলবাজি-অনিয়ম এবং দুই নম্বরি কর্মের শত কোটি অভিযোগের পাহাড় জমে আছে তাদের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে কারা, তা নিয়ে বোধহয় স্পষ্ট করে কিছু বলতে হবে না। যারা এসব দুর্নীতিপরায়ণ লোককে বিশ্বাস করে এবং তাদের প্রতি নির্ভর করে অথবা তাদের মিথ্যাচারে প্রলুব্ধ হয় তারা অতীতকালে কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়েছিল তার স্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বর্তমানের ক্ষমতাসীনেরা কেন যে বারবার একই ভুল করছেন তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। সরকার কি জানে না যে, দুর্নীতিবাজদের বাবা-মা নেই, নেই স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-পরিজন। তারা কি এ কথাও জানে না যে, দুর্নীতিবাজ সন্তানকে তার বাবা-মা বিশ্বাস করেন না, সন্তানেরা শ্রদ্ধা করে না এবং স্ত্রীরা রীতিমতো ঘৃণা করেন এবং সুযোগ পেলেই তাদের সাথে তেমন আচরণ করেন যা সাধারণত নিকৃষ্ট ও হিংস্র প্রাণীদের সাথে করা হয়। অনেক ক্ষমতাধর এবং অত্যাচারী দুর্নীতিবাজ কিভাবে রাত-বিরাতে আপন স্ত্রীর হাতে ঝাড়–পেটার শিকার হন তা তাদের প্রতিবেশীরা প্রায়ই গভীর রাতের অতি চিৎকারের মাধ্যমে অনুধাবন করে থাকেন।

পত্রপত্রিকার খবরের মাধ্যমে জানতে পারলাম, সারা দেশের বিভিন্ন থানায় অসংখ্য গায়েবি মামলা দায়ের করা হয়েছে মূলত বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হয়রানি করার জন্য। পত্রপত্রিকার খবরে আরো জানা গেছে, মৃত ব্যক্তি, প্রবাসী লোকজন, নাবালক, পঙ্গু ইত্যাদি মানুষকে আসামির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বোমা হামলা, সন্ত্রাসী কর্ম, সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর আক্রমণ- এমন সব ভুয়া অভিযোগ তুলে মামলাগুলো করা হয়েছে, যা নিয়ে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় বয়ে চলেছে। যে ঘটনা আদৌ ঘটেনি এমন কল্পিত কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে এমন সব লোককে আসামি করা হচ্ছে, যারা পৃথিবীতে নেই অথবা বাংলাদেশে নেই কিংবা যাদের হাঁটাচলা করা ও কথাবার্তা বলার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই। ফলে গায়েবি মামলার ঘটনাটি নজিরবিহীনভাবে হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। এ অবস্থায় পুলিশ সাম্প্র্রতিককালে কিছু সাজানো বোমা হামলা, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদির নামে মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে যাচ্ছে। পুলিশের এই কর্ম বিরোধী দলের চেয়ে সরকারি দলকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে। নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী দলকে মাঠ ছাড়া করার নামে পুলিশ এবং তাদের দোসররা ত্যাগী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এলাকা ছাড়া করে দিচ্ছে।

বর্তমানকালের বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো- কয়েকটি মহানগর, কয়েকটি জেলা এবং কিছু অঞ্চল ছাড়া দেশের কোথাও বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক তৎপরতা নেই। সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের অন্তর্দ্বন্দ্ব, কলহ, এমপি প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মারামারি, উপজেলা চেয়ারম্যান, চেয়ারম্যান, পৌরমেয়র, সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বার, যারা সরকারদলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত হয়েছেন তাদের সঙ্ঘাত, সুবিধাভোগী নব্য আওয়ামী লীগের তথা কাউয়া, হাইব্রিড মুরগি বনাম ত্যাগী নেতাকর্মীদের দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাত ইত্যাদির কারণে পুরো দেশের শহর-বন্দর-জনপদে সীমাহীন অস্থিরতা ও অশান্তি বিরাজ করছে। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে সৎ ও নাক উঁচু প্রকৃতির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধি ও নেতাকর্মীদের উঠতে বসতে তুচ্ছতাচ্ছ্বিল্য এবং অপমান করে যাচ্ছেন। অন্য দিকে, দুর্নীতিবাজেরা সরকারদলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বে বিরোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে উভয় পক্ষের কাছ থেকে দেদার অর্থকড়ি কামিয়ে নিচ্ছে।

গত পাঁচ বছরে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে পুলিশি তৎপরতার খবর পত্রপত্রিকায় যেভাবে এসেছে- ঠিক সেভাবে আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্বের কাহিনীগুলো আসেনি। অথচ বিভিন্ন কারণে তারাই ছিল দুর্নীতিবাজদের মূল টার্গেট। কারণ পরপর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণে তৃণমূলের সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা যেভাবে সচ্ছল হয়েছেন ঠিক তার সাথে পাল্লা দিয়ে উল্টোটি ঘটেছে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ক্ষেত্রে। ফলে মামলার জালে ফেলে বিরোধী দলের লোকজনের কাছ থেকে অর্থ আদায় প্রায়ই লাভজনক বলে বিবেচিত হয় না। অধিকন্তু, যারা ইতোমধ্যে একাধিক মামলার আসামি হয়েছেন এবং দুই-চারবার জেল খেটেছেন, তারা থানা পুলিশ প্রশাসনকে দুই পয়সার ভয় পান না। পুলিশ এক দিকে মামলা করে, আর তারা অন্য দিকে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এ অবস্থায় সরকারের ওপর মহল থেকে যখন নতুন নতুন মামলা করার নির্দেশ জারি হয়, তখন বিরোধী দলের লোকজনের নাম লোক দেখানোর জন্য রেখে বিপুল অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে টাকাওয়ালা নিরীহ জনগণ এবং সরকারদলীয় সমর্থক, নীরব ভোটার এবং নম্রভদ্র কর্মীদের টার্গেট করে ঘুষ আদায়ের মহোৎসব চালানো হয়।

একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সারা দেশে নতুন করে বিস্ফোরক আইনে মামলা দায়েরের মহোৎসব হচ্ছে। রাতের আঁধারে কয়েকটি ককটেল ফুটিয়ে একটি নাটক মঞ্চায়িত করার জন্য আলামত তৈরি করা হয়। তারপর বিভিন্ন শ্রেণীপেশা ও দলের ৩০-৩৫ জনকে আসামি ও আরো শ’খানেক অজ্ঞাতকে আসামি করে মামলা দায়ের হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। এসব মামলা এক দিকে যেমন নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করছে, তেমিন বিরোধী দলের লোকজনের মনে সরকার সম্পর্কে ঘৃণা ও বিদ্বেষ উসকে দিচ্ছে। অধিকন্তু, যেসব মামলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জড়ানো হচ্ছে সেসব মামলার কারণে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের সর্বনাশ ঘটে যাচ্ছে। বিষয়টি তদারক করার মতো কোনো একক ও শক্তিশালী নেতৃত্ব ক্ষমতাসীনদের তৃণমূলে নেই বললেই চলে। কোনো এমপি বা উপজেলা চেয়ারম্যানের কথায় বাংলাদেশের কোনো থানা পুলিশ চলে বা তাদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে পাত্তা দেয় এমন ঘটনা কালে ভদ্রে ঘটে থাকে। ফলে ভুক্তভোগী নেতাকর্মীরা প্রতিকার না পেয়ে টাকা-পয়সা দিয়ে সমঝোতা করতে বাধ্য হয় নতুবা বিএনপি-জামায়াতের লোকের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জেলখাটা, কোর্ট কাচারিতে দৌড়াদৌড়ি এবং জামিন লাভে তৎপর হতে নিজ দলের প্রতি অবাধ্য হয়ে পড়েন।

সরকার কেন এবং কী কারণে গায়েবি মামলা অথবা সাজানো মামলা দিয়ে জনজীবনের শান্তি দুর্নীতিবাজদের ওপর ছেড়ে দিয়েছে তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। সীমিত পরিসরে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা অথবা শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ৫৪ ধারার অধীন গ্রেফতার, বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার ইত্যাদি ঘটনা আমাদের দেশে বহু দিন ধরে চলে এসেছে এবং যা রাজনীতিসংশ্লিষ্ট লোকেরা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু গায়েবি মামলা অথবা সাজানো মামলার ঘটনা দীর্ঘ মেয়াদে যে ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসবে তা সামাল দেয়া যাবে না। ইতোমধ্যে এই মামলা কেন্দ্র করে বিরাট এক চক্র গড়ে উঠেছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে। দুর্নীতিবাজ ও ঘুষখোরদের ফড়িয়া, দালাল ও এজেন্টরা পথে-প্রান্তরে নেমে গেছে তাদের মালিকদের জন্য শিকার খোঁজার কাজে। কাকে মামলায় ফাঁসালে বেশি টাকা পাওয়া যাবে কিন্তু কোনো প্রতিরোধ আসবে না এমন সব লোকের খোঁজে ঘুষ শিকারিরা মাঠঘাট তছনছ করে দিয়েছে। বিষয়টি বুঝানোর জন্য আমার নির্বাচনী এলাকার দুই উপজেলার দু’টি সাজানো মামলা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা ও দশমিনা উপজেলা নিয়ে পটুয়াখালী-৩ সংসদীয় আসন গঠিত। নবম সংসদ নির্বাচনে আমি বরিশাল বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যবধানের ভোটে বিজয়ী হওয়ার পর হিসাব করে দেখলাম, আওয়ামী লীগের বাইরে অন্তত ষাট হাজার লোক আমাকে ভোট দিয়েছেন। কাজেই নির্বাচনের পর আমি সহাবস্থানের যে নীতি গ্রহণ করেছিলাম যার কারণে বিএনপি-জামায়াতের লোকের সাথে আমাদের এলাকার আওয়ামী লীগের সাথে মামলা-মোকদ্দমা তো দূরের কথা- একটি জিডি এন্ট্রি পর্যন্ত হয়নি। অন্য দিকে, বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতো গলাচিপা-দশমিনার আওয়ামী লীগেও অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং উপদলীয় কোন্দল ছিল। এমপি পদে সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন ৩০-৩৫ জন এবং আমাকে পছন্দ করেন না এমন নেতাকর্মীর সংখ্যাও কম ছিলেন না। তারা দলবেঁধে আমার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কুৎসা রটনা করতেন, বাবা-মা তুলে গালাগাল দিতেন এবং আমার সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সাধ্যমতো বাধা দিতেন। তারা জেলা আওয়ামী লীগ, বিভাগীয় আওয়ামী লীগ এবং কেন্দ্রে এসে সদলবলে নানান কটুবাক্য এবং মিথ্যাচারে ঊর্ধ্বতন নেতাদের কান ভারী করতেন। তার পরও আমি পাঁচ বছরে আমাদের দলীয় কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়রি পর্যন্ত করিনি। উল্টো বিগত দিনে অর্থাৎ অষ্টম পার্লামেন্টের সময় বিএনপি কর্তৃক দায়েরকৃত বহু মামলা-মোকদ্দমা নিজে উদ্যোগ নিয়ে নিষ্পত্তি করে আমার ঘোরতর রাজনৈতিক শত্রুদেরও অবমুক্ত করে দিয়েছিলাম।

উপরিউক্ত অবস্থার কারণে আমার নির্বাচনী এলাকার সর্বসাধারণের মধ্যে একধরনের সামাজিক সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়েছিল। আমার ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য আমি দলীয় মনোনয়ন ক্রয় করিনি। আমার স্থলে দল থেকে যাকে মনোনয়ন দেয়া হলো তিনিও সম্প্রীতির ধারাটি বজায় রেখেছেন। ফলে আমার নির্বাচনী এলাকায় গত দশ বছর ধরে বিএনপি-জামায়াতের সাথে আওয়ামী লীগের কোনো বিরোধ নেই। বিরোধী দল বিগত দিনে কোনো মিছিল মিটিং, সভা-সমাবেশ তো দূরের কথা-ঘরোয়া বৈঠকও করেনি। বরং কমিটি নিয়ে স্থানীয় বিএনপি দুই তিন খণ্ডে বিভক্ত হয়ে অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়েছিল। এ অবস্থায় রাজনীতির মাঠ গরম রেখেছে মূলত আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কলহ-বিবাদ। আমার সময়ে ভিন্নমতের আওয়ামী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা না হলেও গত পাঁচ বছরে সেখানে যা হয়েছে তা বরিশাল বিভাগের অন্য কোথাও হয়নি। ফলে আমার এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অন্তত আট-দশটি ভাগে বিভক্ত হয়ে নিজেদের সর্বনাশ ঘটানোর জন্য দশ পায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অন্য দিকে, সাধারণ ভোটাররা একজন ভালো প্রার্থীর আশায় নীরবে অপেক্ষার পাশাপাশি যার যার ধর্মমতে বিধাতার দরবারে মিনতি জানিয়ে আসছেন।

উল্লিখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ করেই গত সপ্তাহে গলাচিপা ও দশমিনা থানায় দু’টি সাজানো মামলা পুলিশ দায়ের করেছে। ঘটনা, সংলাপ এবং আলামত দেশের অন্যান্য প্রান্তের মতো। গভীর রাতে দুই উপজেলায় দু’টি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ হয়। খবর পেয়ে বীরের বেশে পুলিশ ঝটিকা গতিতে উপস্থিত হয়ে দেখে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে গেছে এবং পালানোর সময় পুলিশকে মামলা করার সুযোগ দেয়ার জন্য কয়েকটি ককটেল, বোতলে ভরা কিছু পেট্রল এবং ভাঙা কাচের গুঁড়ো রেখে গেছে। পুলিশ সেগুলো সংগ্রহ করে আপন দায়িত্বে ইচ্ছেমতো দুটো সাজানো মামলায় শত শত লোককে জ্ঞাত ও অজ্ঞাতভাবে আসামি করে আয়েশী ভঙ্গিতে সময় পার করছে। থানা পুলিশের সাথে সংযোগ রাখা দালাল ও ফড়িয়ারা অজ্ঞাত আসামিদের দলে দলে তালিকাভুক্ত করার জন্য যে তৎপরতা শুরু করেছে তাতে শুধু বিএনপি নয়, অনেক নিরীহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যেসব আওয়ামী লীগ কর্মীদের আসামি করা হয়েছে তারা সবাই এলাকা ছাড়া হয়ে গেছেন। অন্য দিকে নিরুত্তাপ বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি সাজানো মামলার কারণে নতুন করে চাঙ্গা হতে শুরু করেছে।

আমরা আজকের আলোচনার একদম শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। নিবন্ধের শুরুতে বলেছিলাম যে, ইদানীং বহু ভুয়া আমলা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা এবং সাধারণ জনগণের কাছে অহরহ ধরা পড়ছে। আমরা জানি যে, কোনো পণ্য তখনই নকল করা হয় যখন সেটির মাধ্যমে অর্থলাভ নিশ্চিত হয়। দুর্নীতি এখন সরকারি সংস্থাগুলোতে এমনভাবে বাসা বেঁধেছে এবং আমাদের সামাজিক জীবনে দুর্নীতিবাজদের জৌলুশ এমনভাবে ঝিলমিল করতে শুরু করছে যে, অন্যান্য সেক্টরের ছিঁচকে অপরাধী, পুঁচকে বাটপাড়, চোর-ডাকাত ও বদমাশেরা নকল দুর্নীতিবাজ আমলা হয়ে দ্রুত সম্পদশালী হওয়ার চেষ্টায় উন্মত্ত হয়ে পড়েছে। তারা চিরাচরিত নিয়মে চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, লুটপাট, দখল, মারামারি ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থকড়ি হাসিলের চেয়ে ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা সেজে অপকর্ম করাটা বেশি নিরাপদ, সহজ ও অধিক লাভজনক বলে বিবেচনা করছেন নিম্ন লিখিত কারণে।

আগেকার জমানায় খুনি, ডাকাত ও লুটেরাদের সাধারণ মানুষ যেভাবে ভয় পেতেন তার চেয়েও বেশি মাত্রার ভয় সৃষ্টি হয়েছে দুর্নীতিবাজ দুর্বৃত্তদের দ্বারা। সনাতনী পদ্ধতির ডাকাতি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, যার জন্য বিশেষ আকৃতির শক্তিশালী দেহ, পোশাক-আশাক ও অস্ত্রশস্ত্র দরকার পড়ে। অধিকন্তু চুরি-ডাকাতি সাধারণত গভীর রাতে এবং নির্দিষ্ট মওসুমে করা সম্ভব। অন্য দিকে, দুর্নীতি করার জন্য ওসবের কিছুই দরকার হয় না। দিন-রাতের চব্বিশ ঘণ্টা এবং যেকোনো স্থানে বসে দুর্নীতি করা সম্ভব, যার জন্য কোনো মওসুম দরকার হয় না- অর্থাৎ বারো মাসই সংশ্লিষ্ট কুকর্মের জন্য মধুমাস বলে বিবেচিত। অন্য দিকে, চুরি-ডাকাতির কাজের জন্য যে সাজসজ্জা ও পোশাক আশাক দরকার পড়ে তা দুর্নীতির জন্য একদমই লাগে না। কোট টাই, পাজামা-পাঞ্জাবির মতো ভদ্রবেশ ধারণ করে যেভাবে অনায়াসে দুর্নীতি করা সম্ভব ঠিক একইভাবে গেঞ্জি ও অন্তর্বাস অর্থাৎ জাঙ্গিয়া পরেও দুর্নীতি করতে সমস্যা হয় না। দুর্নীতির মাধ্যমগুলোও বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। কেউবা দুর্নীতি করে কলম দিয়ে, কেউবা মুখ দিয়ে- অনেকে আবার দেহ দিয়েও দুর্নীতি করে বেড়ায় আদিমকালের একটি ঘৃণিত পেশাজীবীদের মতো করে। কাজেই সার্বিক দিক বিবেচনায় দুর্নীতির রমরমা বাজারে ঢোকার জন্য নকল পণ্য সেজে অপরাধীরা মূলত তাদের মানস পিতা অথবা মানস মাতার কুকর্মের বাণিজ্যিকরণের পরিধি বহু গুণে বাড়িয়ে দেয়।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.