গল টেস্টে হারল লজ্জাজনকভাবে ২৫৯ রানে!

ওয়ান নিউজ ক্রীড়া ডেক্সঃ গল ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামটি ভারত মহাসাগরের কুল ঘেষা। স্টেডিয়াম থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে উঁকি মারলেই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় সাগরের নীল জলরাশির বুক চিরে উঠে আসা সাদা ঢেউয়ের ঝাপ্টা। তবে এবার আর অভ্যর্থনা জানানো নয়, উল্টো সাগরের সেই ফণা তোলা ঢেউ ছোবল মেরে যেন বাংলাদেশ দলের প্রতিরোধ গড়ার শক্তিটুকুও শুষে নিয়ে যায়! তাই তো গল টেস্টে মুশফিকুর রহীমের দল প্রতিরোধ গড়ে তোলা দূরের কথা, কোমড় সোজা করে দাঁড়ানোর সাহস পর্যন্ত দেখাতে পারল না!

প্রথম, দ্বিতীয়- দুই ইনিংসেই লেজ গুটিয়ে নিয়ে গল টেস্টে হারল লজ্জাজনকভাবে ২৫৯ রানে! শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এর আগেও ১৪টি টেস্টে হেরেছে বাংলাদেশ। যার ৮টিই ইনিংস ব্যবধানে। রানের হিসেবেও এর চেয়ে বড় পরাজয় আছে দুটি। তবে আগের সেই হারগুলোকে ছাপিয়ে গলের এই হারটাই বাংলাদেশের কপালে লজ্জার সবচেয়ে বড় তিলকটা এঁটে দেওয়ার কারণটাও স্পষ্টই। এর আগে কখনোই প্রত্যাশার এতো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট খেলতে নামেনি বাংলাদেশ। বরং টেস্ট পরিবারের বড় ভাই হিসেবে শ্রীলঙ্কাকে সব সময় নমস্ব করেই টেস্ট দ্বৈরথে নেমে ছোট ভাই বাংলাদেশ।

কিন্তু এবার? চিত্রপটটা পুরোই উল্টো। কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়াবর্ধনে, তিলকরত্নে দিলশানরা অবসর নেওয়ায় শ্রীলঙ্কার এই দলটি একেবারেই অনভিজ্ঞ। সিরিজ শুরুর আগে আগে চোট নিয়মিত অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসকে কেড়ে নিলে শ্রীলঙ্কার শক্তিটা কমে যায় আরও। উল্টো পিঠে গত কয়েক বছরের ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে বাংলাদেশ দল এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ভারসাম্যপূর্ণ। দুটো ছবিকে এক ফ্রেমে বেঁধে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হতাশার টেস্ট ইতিহাসটা নতুন করে লেখার ব্যাপারে প্রত্যাশিত হয়ে উঠে বাংলাদেশ শিবির। নিজেদের সেই প্রত্যাশার কথাটা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলেও বেড়ান বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কান কোচ হাথুরুসিংহে এবং অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম।

 

বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বলে তো গেছেনই, শ্রীলঙ্কা গিয়েও হাথুরু-মুশফিকু বারবার বলেছেন, ‘এবার সুযোগ আছে ভালো কিছু করার।’ সেই ভালো কিছুর এই নমুনা! সিরিজ জেতা দূরের কথা, সিরিজ বাঁচানোই এখন পাহাড়সম কঠিন। অনেক প্রত্যাশার সিরিজটা ড্র করতে হলেও ১৫ মার্চ থেকে শুরু হতে যাওয়া কলম্বো টেস্টে বাংলাদেশকে জিততে হবে। কিন্তু গল টেস্টে মুশফিকের দল যেভাবে লেজ গুটিয়ে ফেলল, তাতে জয়ের স্বপ্ন দেখার সাহস হয় না! শ্রীলঙ্কার এই অনভিজ্ঞ দলের কাছেই কিনা ২৫৯ রানের হার!

হারের এই ব্যবধানটাও আসলে গল টেস্টে লঙ্কানদের দাপট আর বাংলাদেশের মাথা নোয়ানোর চিত্রটা ঠিক ফুটিয়ে তুলতে পারছে না। প্রথম সকাল বাদে টেস্টের পুরো সময়েই বাংলাদেশের উপর ছড়িয়ে ঘুরিয়েছে লঙ্কানরা। পাল্টা হুমকি দূরে থাক, ম্যাচে নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষার লড়াইটুকুও করতে পারেনি মুশফিকের দল। বাংলাদেশি বোলারদের হতাশ করে শ্রীলঙ্কা খেলেছে ৪৯৪ ও ২৭৪/৬ রানের ইনিংস। সেখানে প্রথম ইনিংসে টেনেটুনে ৩১২ রান করা বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে ১৯৭ রানেই অল আউট।

 

তৃতীয় ও চতুর্থ দিনের বৃষ্টি বাংলাদেশের জন্য ম্যাচ বাঁচানোর রাস্তাটা খাটো করে দিয়েছিল। ড্র করতে বাংলাদেশের দরকার ছিল শেষ দিনটি পাড় করে দেওয়া। হাতে ছিল পুরো ১০ উইকেট। যা দেখে চতুর্থ দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে সাকিব আল হাসান বেশ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলে দেন, ড্র করা তাদের জন্য খুবই সম্ভব। কিন্তু পুরো দিন কেন, বাংলাদেশ খেলতে টিকতে পারল না দেড় সেশনও। ১০ উইকেট হাতে নিয়ে পঞ্চম দিনে খেলতে পারল মাত্র ৪৫ ওভার! রান করেছে ১৩০! এই পথের মাঝখানে অধিনায়ক মুশফিক ও উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান লিটন দাসের ৫৪ রানের জুটিটা বাদ দিলে চিত্রটা আরও ভয়াবহ! ভয়াবহ নয়, চিত্রটা আসলে লজ্জার।

শনিবার সেই লজ্জার ঘটনাটাই ঘটেছে গলে। বিনা উইকেটে ৬৭ রান নিয়ে দিন শুরু করে ১০৪ রানে যেতেই ৫ উইকেট হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। শনিবার সকালে মাত্র ৩৭ রান তুলতেই ৫ উইকেট হাওয়া। বাংলাদেশ শিবিরে তখন মধ্যাহ্ন বিরতির আগেই অল আউট হওয়ার শঙ্কা! সেটা হয়নি মুশফিক-লিটনের ৫৪ রানের ষষ্ঠ উইকেট জুটির সুবাদে। তবে মধ্যাহ্ন বিরতি থেকে ফিরেই আবার মোড়ক লাগে বাংলাদেশ ইনিংসে। মাত্র ৪০ রানের মধ্যেই শেষ ৫ উইকেট হারিয়ে অল আউট ১৯৭ রানে। এই ৪০ রানের মধ্যে মেহেদী হাসান মিরাজ একাই করেন ২৮ রান!

 

শ্রীলঙ্কার এই অনভিজ্ঞ দলে একমাত্র রঙ্গনা হেরাথকেই মনে করা হচ্ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাঁধা। তবে সিরিজ শুরুর আগে মুশফিক শুনিয়েছিলেন আশার বাণী। বলেছিলেন হেরাথকে উইকেট দিতে এবার খুবই সতর্ক থাকবেন তারা। মুমফিক বলেছিলেন হেরাথকে নিয়ে ‘হোমওয়ার্ক’ করার কথাও। কিন্তু ময়দানে নেমে মুশফিকদের সেই ‘হোমওয়ার্ক’কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হেরাথ ঠিকই আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করেছেন তিনিই। ৫৯ রানে ৬ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে মুড়িয়ে দেওয়ার পথে গড়েছেন বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ড। টপকে গেছেন নিউজিল্যান্ডের সাবেক বাহাতি স্পিনার ড্যানিয়েল ভেট্টোরিকে।

ভেট্টোরি ১১৩ টেস্টে নিয়েছেন ৩৬২ উইকেট। সেখানে হেরাথের ৭৯ টেস্টেই হয়ে গেল ৩৬৬ উইকেট। দুই ইনিংস মিলিয়ে ম্যাচে ৯ উইকেট তার। তার এই পারফরম্যান্সই বলছে, কলম্বো টেস্টের আগে আরও একবার হেরাথকে নিয়ে ‘হোমওয়ার্ক’ করা দরকার বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের!

টেস্টে বাংলাদেশের প্রাপ্তি বলতে অধিনায়ক মুশফিকের ব্যাটিং। কিপিং গ্লাভস ছেড়ে এই টেস্টে মুশফিক নেমেছিলেন শুধুই স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানের তকমা গাঁয়ে। ব্যাটিং অর্ডারে তাই তার হয়ে যায় প্রমোশনও। ৬ এর পরিবর্তে গল টেস্টে ব্যাট করলেন ৪ নম্বরে। তবে এই ভূমিকাতেও সফল। ৮৫ ও ৩৪ রানের ইনিংস খেলে দুই ইনিংসেই সতীর্থদের শিখিয়েছেন দলের বিপর্যয়ের মুখে কীভাবে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ব্যাট করতে হয়! শেখালেন তো, কিন্তু অন্যরা তা শিখল কী?

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.