গণমাধ্যম ও আমলাতন্ত্র মুখোমুখি কেন?

ফারাবী বিন জহির:
প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের কিছু নথি চুরি অভিযোগে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের এক উপসচিব। বিষয়টি এ পর্যন্ত শুনতে বেশ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে । কারণ প্রত্যেক নাগরিকের আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার রয়েছে। প্রত্যেক নাগরিকের বিচার চাওয়ার অধিকার রয়েছে। সে হিসেবে মন্ত্রণালয় যদি মনে করেন যে, তার আইনি অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে অথবা কোনো অপরাধ সংগঠিত হয়েছে— তাহলে কারো বিরুদ্ধে মামলা করতেই পারেন। তবে সেই মামলা করতে গিয়ে মন্ত্রণালয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তা অনভিপ্রেত।

সংবাদপত্র হচ্ছে সমাজের চতুর্থ স্তম্ভ। এই চতুর্থ স্তম্ভ (সাংবাদিকরা) যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে, তাহলে রাষ্ট্রের বাকি তিন স্তম্ভ (আইন সভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ) সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে দেওয়া সাজার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিটের শুনানিকালে ১৬ মার্চ বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। সমাজের সেই চতুর্থ স্তম্ভের একজন প্রতিনিধি হিসেবে রোজিনা ইসলাম বিভিন্ন ইস্যুতে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরার স্বার্থে কাজ করে যাবেন। জনগণ তার কাছে সেই প্রত্যাশাই করেন। সেই কাজ করতে গিয়ে তিনি এমন কারো দ্বারা বাধার সম্মুখীন হন, যে বা যারা কিনা সমাজে আইন বাস্তবায়নে সহায়তা করেন, যাদের কাজ সমাজে উন্নয়নে সাহায্য করা। সেই তারাই যদি এমন কাণ্ড ঘটিয়ে বসেন যা সমাজের জন্য মঙ্গলজনক নয় , যা সমাজের প্রচলিত আইনকে তোয়াক্কা করে তাহলে বিষয়টি সত্যি উদ্বেগজনক। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে আনা অপরাধের অভিযোগ সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় ঠিক আমার বোধগম্য হচ্ছে না ।

রোজিনা ইসলামকে ঠিক কোন আইনের বলে ৫ ঘণ্টার ও অধিক সময় মন্ত্রণালয়ের কক্ষে আটকে রাখা যায়। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে নিকটস্থ থানা থেকে পুলিশ ডেকে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা যেত। তাহলে কি নিকটস্থ থানা থেকে সচিবালয়ের দূরত্ব ৫ ঘণ্টা?

রোজিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি সচিবের পিএসের রুমের টেবিল থেকে গোপন নথির ছবি তুলেছেন। আচ্ছা যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে কি গোপন নথী সচিবের পি এস এর রুমে টেবিলের উপর সাজানো অবস্থায় পড়ে থাকে? এই নথী তো থাকার কথা উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তার সুরক্ষিত কোনো লকারে। এই ধরনের গোপন নথী এমনভাবে কেন রাখা হল যেখান থেকে ছবি তোলা যায়? কারাই বা রাখল? এই বিষয়ে কিছু জানা গেছে?

আমরা জানি রোজিনা ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। যেখানে একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামীও যদি অসুস্থ হয়ে যান তার ক্ষেত্রে ও দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। আর সেখানে শুধুমাত্র অভিযোগ আনা হয়েছে তাও প্রমাণিত হয়নি এরূপ ব্যক্তির ক্ষেত্রে তিনি অসুস্থ হলে কিন্তু কেউ বিন্দুমাত্র মানবিকতা দেখানোর প্রয়োজন মনে করলেন না ? এই অমানবিকতার শিক্ষা আমরা কোথা থেকে পেলাম?

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে ব্যাখ্যা গণমাধ্যমে এসেছে তাতে লেখা আছে মহিলা কর্মকর্তার মাধ্যমে তল্লাশি চালিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে রাখা কাগজপত্র এবং ফাইল পাওয়া যায়। একজন মানুষের শরীররে সম্পূর্ণ একটা ফাইল কিভাবে লুকিয়ে রাখা যায় সেই পদ্ধতি দেখার বিষয়ে অনেকের হয়ত কৌতূহল থাকবে। কিন্তু ওই মহিলা কর্মকর্তা আসলে কোন আইনের বলে এই ভাবে তল্লাশি চালাতে পারেন? সিআরপিসি’ ১০৩ ও ১৬৫ ধারা অনুযায়ী তল্লাশি চালানোর আইনি অধিকার পুলিশের রয়েছে। তবে তল্লাশির সময় কমপক্ষে দু’জন গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে তল্লাশি চালাতে হবে। সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো মালামাল জব্দ করতে হলেও একই নিয়ম মানতে হবে পুলিশকে। এছাড়া, তল্লাশির সময় পুলিশ দলের নেতৃত্বেও কমপক্ষে একজন সাব ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তা থাকতে হবে। অতিউৎসাহী মন্ত্রণালয়ের সেই নারী কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত মোবাইল সেট কেড়ে নিয়ে সেটা পরীক্ষা করার অধিকার কোন আইনের বলে পেয়েছেন? কিভাবে তিনি তার ব্যক্তিগত ব্যাগে হাত দেন? এই বিষয়গুলোর আইনি ব্যখ্যা প্রয়োজন।

যারা অভিযোগ তুলেছেন সাংবাদিক আইন ভঙ্গ করেছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি সেই জন্য সেই সাংবাদিককে আইনের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে এবং আদালতের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ে আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে কিনা সেই বিষয়টি কি স্বাধীন তদন্ত কমিটি দ্বারা তদন্ত করা হয়েছে? এক ই ঘটনায় একপক্ষের বিচার হবে আদালতে আরেকপক্ষ বিষয়ে তদন্ত করবে তার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি? এক যাত্রায় দুই ফল কেন?

আইনের শাসনে বিশ্বাসী একজন মানুষ হিসেবে আমি আস্থা রাখি আদালতের উপর। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা বিচারাধীন।তিনি অপরাধ করেছেন কিংবা করেননি, তিনি আইন লংঘন করেছেন কিংবা করেননি, এই বিষয়গুলো এখন আদালতের বিচারাধীন বিষয়। তাই এই বিচারাধীন বিষয় নিয়ে মন্তব্য হবে আদালত অবমাননার শামিল। আমি বরং বিশ্বাস করি উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে করা মামলায় ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে।

তবে আমি একইসাথে মনেকরি অবশ্যই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনগণের করের টাকায় পরিচালিত মন্ত্রণালয়ে কী হচ্ছে তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। ঠিক তেমনি জনগণের অধিকার রয়েছে মন্ত্রণালয়ের আইন পালনে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা সেটি জানার। আইনের দৃষ্টিতে যেমন সবাই সমান, ঠিক তেমনি আইন লংঘনের ক্ষেত্রে সবার জন্য একই শাস্তি হবে এটাই জনগণের প্রত্যাশা। কোনো বিশেষ পক্ষকে ছাড় দেওয়া হবে জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।

সীমালংঘনকারিকে আল্লাহ্‌পাকও পছন্দ করেন না। ব্যক্তির দায় কখনোই প্রতিষ্ঠানের উপর বর্তায় না। আমাদের দেশের উন্নয়নের স্বার্থে যেমন দক্ষ আমলাতন্ত্রের প্রয়োজন আছে ঠিক তেমনি গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশে চাই শক্তিশালী গণমাধ্যম। তাই কোনো সাংবাদিক যদি সীমালংঘন করে থাকেন তার যেমন বিচার হওয়া উচিত, তেমনি অতিউৎসাহী সরকারি কোনো কর্মকর্তা যদি আইন লংঘন করে থাকেন তারও বিচার হওয়া উচিত। তবে বিচার হতে হবে এক মানদণ্ডে, তা না হলে সেই বিচার জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

লেখক: লেখক ও গবেষক

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.