কাইমুল ইসলাম ছোটনঃ
নদীর নাম কুহেলিয়া। যার তীরবর্তী স্থানে গড়ে ওঠেছে তিনটি ইউনিয়ন। জেলার উজানটিয়া থেকে শুরু হওয়া নদীটি তিন ইউনিয়নের মধ্যদিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরও দখল-দূষণে খরস্রোতা কুহেলিয়া নদী এখন অস্তিত্ব হারাচ্ছে।
এই নদীতে পাঁচ বছর পূর্বে বড় বড় ইঞ্জিনচালিত বোট চলত, মাঝ নদীতে জেলেরা উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে মাছ আহরণ করত। ইজারাদার ছিল। নদীর প্যারাবনের সৌন্দর্য মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নিত। লবণচাষিরা লবণবাহী বোট চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যেত। স্থানীয়রা স্বল্প খরচে মালামাল আনা-নেওয়া করত। জীবিত এই নদীর উপরে নির্ভর ছিল নদীর তীরবর্তী তিন হাজারো মানুষের জীবন-জীবিকা। কিন্তু সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পে যাওয়ার জন্য ব্রীজ থেকে দক্ষিণে ১৩ কিলোমিটার সড়ক তৈরি করতেছে। ১২ কিলোমিটার নদীর ৭ কিলোমিটার নদী ভরাট করে চার লেনের সড়ক নির্মাণ করতেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আকতার হোসেন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। বিভিন্ন সময় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। নদী ভরাট করে সড়ক হওয়ার কারণে নদীটি সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। চলতে পাচ্ছে না বড় নৌকা গুলো। খরস্রোতা নদীটি এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের ময়লা-আবর্জনা, বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে ফেলার কারণে নদী ভরাটসহ দূষিত হয়ে যাচ্ছে নদীর পানি। কমে গেছে মাছের পরিমাণ। এই সুযোগে অনেকে অবৈধভাবে চিংডি প্রজেক্ট নামে নদী দখল করছে। বেড়ে যাচ্ছে নদী দখলদারদের সংখ্যা। এতে বিলীন হওয়ার পথে কুহেলিয়া নদী। এভাবে চলতে থাকলে নদীর অস্তিত্ব থাকবে না বলে দাবি করছেন পরিবেশ কর্মীরা।
এই বিষয়ে স্থানীয় পরিবেশ কর্মী মাষ্টার নুরুন্নবী বলেন, ‘আমরা উন্নয়ন চাই, তবে নদী ধ্বংস করে নই’। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আকতার হোসেন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড আইন উপেক্ষা করে নদী ভরাট করে সড়ক করছে। আমরা প্রতিবাদ করেছি, কোন সুরাহা মিলে নেই। এই নদী ভরাট হয়ে গেলে মানুষ বিভিন্ন সমস্যা মুখোমুখি হবে। ইতোমধ্যে অনেক মামুষ পেশা হারিয়েছেন। বাড়ছে বেকারত্ব।
গত রবিবার ও সোমবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ময়লা আবর্জনা ও দখলের কারণে উত্তাল নদীটি মৃত খালে পরিণত হয়েছে। নদীর বুকে সড়ক হওয়ার কারণে নদীটি অনেক সংকুচিত হয়ে গেছে। বড় কোন নৌকা চলতে পারবে না। মীর আক্তার কোম্পানির অনেকে সুইস গেইটের কাজ করতে দেখা যায়।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, নদীটি অনেক বড় ও গভীর ছিল। স্থানীয়রা লবণবাহী বোট বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেত। মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের দূষিত বর্জ্য নদীতে ফেলানো এবং নদী ভরাট করে সড়ক হওয়ার কারণে নদীটি এখন খালে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়রা পূর্বের মত মাছ পায় না, এখন তীরে নৌকা ভিড়তে পারে না। অনেকে বাধ্য হয়েছেন পেশা বদলাতে। আয় না থাকায় এমন কষ্টে নিরবে কাঁদছেন অনেক পরিবার।
আগে নদীতে জাল ফেললে অনেক সামুদ্রিক মাছ মিলত। এখন নদীতে জাল বসাতে পারি না, জাল নিয়ে নেয়। এভাবে কথা গুলো বলছেন জেলে বাহাদুর আলম। তার মতো এমন বিষাদের চাপ রুবেল দাসের। পূর্বে কাঁকড়া ধরে জীবনধারণ করত। নদীতে কাঁকড়া নেই। এখন কাজ না পাওয়ায় নাপিতের কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। এমনই হাজারো গল্প কুহেলিয়াকে ঘিরে।
কক্সবাজারের পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন শেয়ার বিজকে বলেন, রাস্তার করার জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু সড়ক ও জনপদ বিভাগ অধিগ্রহণকৃত জমিতে না করে নদী ভরাট করে করতেছে। কুহেলিকা নদী রক্ষা করার জন্য আমরা হাইকোর্টে রিট করেছি।
তিনি আরো বলেন, নদী ভরাটের কারণে মাতারবাড়ীতে সুপ্রিয় পানির সংকট দেখা দিবে। বেকারত্ব বাড়ার কারণে অপরাধমূলক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাবে। কাজেই পরিবেশের স্বার্থে দ্রুত নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। না হয় কুহেলিয়ার প্রাণ ফেরানো যাবে না।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.