কালুরঘাট সেতুর ‘ভাগ্য’ নির্ধারণ রোববার

ডেস্ক নিউজ:
কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাটে এক সেতুর জন্য অপেক্ষা দীর্ঘ দুই দশকের। সড়ক কাম রেল সেতুর দাবিতে এলাকাবাসীর আন্দোলন আর ‘সেতু, সেতু’ করতে গিয়ে প্রয়াতও হয়েছেন ১১ বছরের সাংসদ মইন উদ্দীন খান বাদল। সবশেষে প্রয়াত এমপির প্রচেষ্টায় আর প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের পরও উচ্চতা জটিলতার প্যাঁচে পড়ে শুরু হচ্ছে না নতুন সেতুর কাজ। নতুন প্রচেষ্টায় এবার যোগ দিয়েছেন বাদলের বদলি হিসেবে উপ নির্বাচনে জিতে আসা মোছলেম উদ্দিন আহমদ এমপি।

অবশ্য গত বুধবার রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জরাজীর্ণ এই সেতু পরিদর্শনে এসে জানিয়ে গেছেন, প্রস্তাবিত নকশায় ৭ দশমিক ২ মিটার থাকলেও যেহেতু বিআইডব্লিউটিএর আপত্তি আছে, সেহেতু এই নতুন সেতুটি ৯ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত করার সুযোগ রয়েছে রেলওয়ের। পূর্বাঞ্চলের প্রকৌশল বিভাগও বলছে একই কথা।

তবে বিআইডব্লিউটিএ বলছে, নদীর ওপর সেতু করতে গেলে সরকারি নিয়ম অবশ্যই মানতে হবে নদীর নাব্যতা ও নদী শাসন অনুযায়ী। সরকারি গেজেট অনুযায়ী কর্ণফুলীর যে অংশে সেতু হবে সেখানে ১২ দশমিক ২ মিটারের নীচে সেতু করতে হলে পুরা গেজেটই পাল্টাতে হবে। এসব সম্ভব একমাত্র আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তেই। রোববার ঢাকায় কারিগরি কমিটির সাথে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে সেতুর উচ্চতার বিষয়টি। মূলত এদিনই নির্ধারণ হবে কালুরঘাট সেতুর ভাগ্য। সেতু নির্মাণে বিলম্বিত হবে নাকি রেলওয়ের দাবি মেনে বিআইডব্লিউটিএ তাতে সায় দেবে তা এখন দেখার বিষয়। যদি বিআইডব্লিউটিএ সায় দেয় কালুরঘাট সেতু নির্মাণে আর কোনও বাধা থাকবে না। আর যদি সংস্থাটি আগের অবস্থানে অটুট থাকে তাহলে ঝুলেই থাকবে বোয়ালখালীবাসীর স্বপ্নের এ সেতু নির্মাণের প্রকল্পটি।

তবে এর আগে সেতুর উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার করার শর্ত জুড়ে দিয়েছিল নৌপথের মালিক বিআইডব্লিউটিএ। অন্যদিকে রেলওয়ে বলছে, বর্তমান রেল লাইন অ্যালাইনমেন্টে সর্বোচ্চ ৯ মিটার পর্যন্ত করা যাবে। কাজেই বলা চলে ধোঁয়াশা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। কারিগরি কমিটির এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে সেতুর উপর নির্ভরশীলরা।

উচ্চতা জটিলতার বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. সবুক্তগীন বলেন, ‘রোববার আমাদের একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক আছে। আশা করি এরপরে উচ্চতা কত হবে তা জানাতে পারবো।’

রেলপথ মন্ত্রী গত বুধবার কালুরঘাটে এসে ৯ মিটার পর্যন্ত বাড়ানোর কথা বলেছেন। বিষয়টি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘স্যার (রেলমন্ত্রী) যে কথা বলেছেন তা হলো আমরা প্রয়োজনবোধে ৯ মিটার পর্যন্ত বাড়াতে পারবো। তবে তা এখনো ফাইনাল না।’ তবে আগামী বৈঠকে এ নিয়ে ধোঁয়াশা কেটে যাবে বলে আশা রাখেন তিনি।

নকশা অনুযায়ী বর্তমান সেতুটির ৮০ মিটার উত্তরে তৈরি হতে যাচ্ছে নতুন সেতুটি। নতুন সেতুর প্রস্থ হবে ২০ ফুট, আর লম্বা ৭৮০ মিটার। ৯টি থাম বা স্প্যান দিয়ে এ সেতু নির্মাণ করা হবে। সেতুটিতে নৌযান চলাচলের জন্য প্রয়ােজনীয় উচ্চতা ও স্পেস রাখা হবে। ফলে সেতুর নিচে জাহাজ চলাচলে সুবিধা হবে। সেতুটি নির্মিত হলে নিরবচ্ছিন্ন রেল পরিবহন সেবা নিশ্চিত করা যাবে। তাছাড়া সেতুর ডাবল লাইন সড়কে যানবাহন তো চলবেই। এ সেতু দিয়ে ১২০ কিলো স্প্রিডে ট্রেন আর ৬০ কিলো স্প্রিডে গাড়ি চলতে পারবে।

অন্যদিকে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কোনও কর্মকর্তাই এবিষয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, দেশের সব নদীকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্তকরণ করে গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। একাজটি তদারকি করে থাকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। দেশের প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ বেশ কয়েকটি নদী প্রথম শ্রেণীভূক্ত। তেমনি বঙ্গোপসাগর থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর অংশকে প্রথম শ্রেণিভূক্ত করা হয়েছে। শাহ আমানত সেতু থেকে হালদা নদীর মোহনা পর্যন্ত দ্বিতীয় শ্রেণীভূক্ত করা হয়েছে।

প্রথম শ্রেণির নদীতে সেতু করতে হলে উচ্চতা হতে হবে ১৮ দশমিক ৩ মিটার, দ্বিতীয় শ্রেণীর নদীতে সেতু হলে উচ্চতা হতে হবে ১২ দশমিক ২ মিটার আর তৃতীয় শ্রেণীর নদীতে সেতু হলে উচ্চতা হতে হবে ৭ দশমিক ২ মিটার। বর্তমানে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্ণফুলী নদীতে রেলওয়ে সেতু করতে চাচ্ছে তৃতীয় শ্রেণীর হিসাবে ৭ দশমিক ২ মিটার উচ্চতায়। এরকম হলে সরকারি গেজেট লঙঘন হবে আর নদী মরে যাবে, এমন দাবি নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের। বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত শাহ আমানত সেতুটির উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার। যেটি নদীর দ্বিতীয় শ্রেণী অংশে পড়েছে।

অন্যদিকে বুধবার জরাজীর্ণ এই সেতুটি পরিদর্শনে আসেন রেল মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। মূলতো মন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করেই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরুর নতুন স্বপ্ন দেখছেন চট্টগ্রামবাসী। মন্ত্রী চট্টগ্রামে এসে সোজাসাপ্টা বলে গেছেন, দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ‘ভুল বুঝাবুঝি’ হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর সেটাও আর নেই৷ মূলতো এই সেতুর উচ্চতা নিয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের সাথে নৌপরিবহন অধিদপ্তর উচ্চতা নিয়ে মতের অমিল ছিল। তবে মন্ত্রী এমন বলে গেলেও নৌপরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কথায় বিষয়টি সেরকম মনে হচ্ছেনা। সহসাই এ জটিলতা নিরসনেরও কোনও পথ দেখা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ও সরকারি গেজেট সংশোধনই সেতু নির্মাণে আলোর পথ দেখতে পারে।

রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিআইডব্লিউটিএ নেভিগেশন চ্যানেল ১২ দশমিক ২ মিটার ক্লিয়ার চেয়েছিল। কিন্তু কালুরঘাটে বর্তমান সেতুর উচ্চতা ৪ দশমিক ২ মিটার। যেটি বৃটিশরা তৈরী করেছিল। তা যদি আরো ৮ মিটারও উচু করা হয় তাহলে নতুন সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। শুধুমাত্র চাইলেই রেললাইন উঁচু করে ফেলা যায় না। বেশ দূর থেকে ক্রমান্বয়ে উঁচু করতে হয়। বেশ দূরে গিয়ে স্ল্যাভ মিলাতে হয়। কেননা এর সাথে জড়িত রয়েছে ট্রেনের গতি সহ কারিগরি বিভিন্ন বিষয়। জনবহুল এলাকায় ট্রেন চলাচলের বিষয়টি তো আছেই। তাই প্রস্তাবিত কালুরঘাট সেতুর উচ্চতা যদি ১২ দশমিক ২ মিটার করতে হয় সেক্ষেত্রে নগরের অংশে জানালী হাট স্টেশন এবং বোয়ালখালী অংশে গুমদণ্ডি রেলওয়ে স্টেশনকে বহু উঁচু করতে হবে। যা অনেক কঠিন এবং ব্যয়বহুল।

তবে সেতুর আন্দোলনের সাথে জড়িতরা বলছেন, বিআইডব্লিউটিএ সেতুর উচ্চতা নিয়ে অহেতুক জটিলতা তৈরী করেছে। নদীর ওই অংশটিতে কোনরকম জাহাজ চলাচল নেই। নেভিগেশন চ্যানেল রক্ষার নামে এই ধরনের জটিলতার কারণেই বেড়েছে দীর্ঘসূত্রতা।

অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিএ’র সংশ্লিষ্ট উপ পরিচালক পদের এক কর্মকর্তা এর জবাবে বলেছেন, ‘তাদের কথায় সরকারি গেজেট না মেনে নদীকেতো মেরে ফেলা যায়না। এ সেতু একশ বছরে একবারই হবে। পরে চাইলেও উচ্চতা বাড়ানো যাবেনা। এরপরও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ইচ্ছায় শেষ কথা। আমাদেরটা আমরা জানিয়েছি।’

বিআইডব্লিউটিএ’র দাবি হলো, চট্টগ্রাম ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকা। ঝড়ের সময় নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য কর্ণফুলী নদীতে অবস্থান করা নৌবাহিনীর জাহাজসহ বাণিজ্যিক জাহাজগুলো কালুরঘাট সেতু পার হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। ওই দুঃসময়ে জাহাজ পারাপারে সেতুটি যাতে কোনো ধরণের প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে সেজন্য সেতুর উচ্চতা বাড়ানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে। নতুন সেতু নির্মাণ হলে পুরানো সেতুটি অবশ্যই অপসারণ করা হবে।

যদিও এমন দাবির ঘোর বিরোধিতা করে স্থানীয়রা বলছেন, শুধু শুধুই সৃষ্টি করা হয়েছে এমন জটিলতা। কর্ণফুলীর ওই অংশে ঘূর্ণিঝড়ের সময় বড় জাহাজ যায় না বলে দাবি তাদের।

তবে দুই সংস্থার মধ্যে পুরান এই জটিলতা কেটে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বুধবার বলেছেন, ‘কালুরঘাটে প্রস্তাবিত সেতুটি ৭ দশমিক ২ মিটার। তাই একটু জটিলতা তৈরি হয়। যৌথ কারিগরি টিম গঠন করেছি, তারা কাজ করছে। নতুন সেতুটি ৯ মিটার পর্যন্ত উচু করার সুযোগ আছে৷ তাদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধান করা হবে। এটি ডাবল লাইন সড়ক ও এক লাইন রেল পথের সেতু হবে। তাছাড়া ৯ মিটার উচ্চতা রাখলে অন্য জাহাজগুলো আসার সুযোগ থাকবে।’

 

শত বছরের ভারে ন্যুব্জ কালুরঘাট সেতু:
জানা গেছে, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ফ্রন্টের সৈন্য পরিচালনার জন্য ১৯৩০ সালে কর্ণফুলী নদীতে একটি আপৎকালীন সেতু নির্মাণ করা হয়। ব্রুনিক অ্যান্ড কোম্পানি ব্রিজ বিল্ডার্স হাওড়া নামে একটি প্রতিষ্ঠান ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে ৭০০ গজের সেতুটি তৈরি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মোটরযান চলাচলের জন্য সেতুতে ডেক বসানো হয়। ১৯৫৮ সালে এই এক লেনের সেতুটিই সব ধরনের যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

বয়সের ভারে এখন ন্যুব্জ এই সেতু। ফলে ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কালুরঘাট রেল ও সড়ক সেতুটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। জোড়াতালি দিয়ে কোনোভাবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। চরম ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে হাজার হাজার মানুষ। এ অবস্থায় সেতু ব্যবহারকারী বোয়ালখালী উপজেলা ও পটিয়ার একাংশের বাসিন্দারা একই স্থানে নতুন সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন। অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান নতুন সেতু নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই করে।

ব্রিটিশ আমলে নির্মিত কালুরঘাট রেল ও সেতুটি জরাজীর্ণ হওয়ায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে লাখ লাখ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে এবং বর্তমান সরকারের সদিচ্ছায় প্রস্তাবিত চীন, মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে রেল নেটওয়ার্ক স্থাপন এবং কর্ণফুলী নদীর ওপর পুরানো কালুরঘাট রেল সেতু ভেঙে নতুন করে রেল ও সড়ক সেতু নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এ সেতুটি সরকারের মেগা প্রকল্প দোহাজারী-ঘুমধুম রেললাইনের অন্তর্ভুক্ত। রেল কর্মকর্তাদের মতে, প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের যে প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে, তার সুফলও নির্ভর করছে কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণের ওপর। -সিভয়েস।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.