কারাগারে খালেদা জিয়া, শিক্ষা সবার
সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে কারাগারে যেতেই হলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। তবে এবারই প্রথম নয়, ওয়ান-ইলাভেনের সময়ও বেগম খালেদা জিয়াকে কারাভোগ করতে হয়েছে। তখন কারাগারে যেতে হয়েছিল আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও। তবে তখন সংসদ ভবন এলাকায় দুটি ভবনকে সাবজেল ঘোষণা করে দুই নেত্রীকে রাখা হয়েছিল। তখনকবার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি এক নয়। তখন তারা ছিলেন অভিযুক্ত। আর এবার বেগম জিয়াকে কারাগারে যেতে হয়েছে দুর্নীতির দায়ে দন্ডিত হয়ে। কোনো সাবজেল নয়, খালেদা জিয়াকে এবার যেতে হয়েছে নাজিমউদ্দিন রোডের ঐতিহাসিক কারাগারে।
ব্রিটিশ আমলে নির্মাণ করা নাজিমউদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারটি পরিত্যক্ত হয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। কেন্দ্রীয় কারাগার চলে গেছে কেরানীগঞ্জে। নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারটি ইতিমধ্যেই জাদুঘরে বদলে দেয়ার উদ্যাগ নেয়া হয়েছে। একাধিক উপলক্ষ্যে এর দ্বার খুলে দেয়া হয়েছিল সাধারণ মানুষের জন্য। বাতিল হয়ে যাওয়া সেই কারাগার আবার প্রাণ ফিরে পেল। সম্ভবত এই কারাগারের শেষ অতিথি বেগম খালেদা জিয়া।
সাবেক কোনো সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের কারাগারে যাওয়ার নজির বাংলাদেশে এই প্রথম নয়। দুর্নীতির দায়ে ৫ বছর এই নাজিমউদ্দিন রোডেই থাকতে হয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদকে। দুর্নীতির অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে কারাগারে যেতে হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, মিজানুর রহমান চৌধুরীকে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন ৮৩ দিনের রাষ্ট্রপতি খুনী মোশতাককে। পচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর খুনীচক্র গ্রেপ্তার করেছিল সাবেক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর অালীকে। খুনীচক্র বাগে আনতে না পেরে কারাগারেই খুন করে তাদের। তবে বেগম খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়াটা অন্যদের চেয়ে আলাদা। কারণ তাকে কারাগারে যেতে হলো দুর্নীতির দায়ে ৫ বছরের সশ্রম দন্ড মাথায় নিয়ে।
খালেদা জিয়া করাগারে যাওয়ায় জাতীয় পার্টির কারো কারো সধ্যে চাপা উল্লাস দেখা যাচ্ছে। তারা বলতে চাইছেন, বেগম জিয়া অন্যায়ভাবে এরশাদকে জেল খাটিয়েছেন। এখন তার পরিণতি ভোগ করছেন। মুক্তি পাওয়ার পর এরশাদ খালেদা জিয়াকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, কারাগারে বরই গাছ লাগিয়ে এসেছি। তবে খালেদা জিয়া এরশাদকে কারাগারে নেননি, অন্যায়ভাবে তো নয়ই। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এরশাদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আর এরশাদের পতন ঘটেছিল গণঅভ্যুত্থানে। এরশাদের যা অপরাধ, তাতে তার বাকি জীবনটা জেলেই থাকার কথা।
এমনকি মঞ্জুর হত্যার সঠিক বিচার হলে অনেক আগেই এরশাদের ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুই বড় দলের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এরশাদ অনেক আগেই রাজনীতিতে পুনর্বাসিত। পতিত স্বৈরাচার আজ মন্ত্রীর পদমর্যাদা পায়, আবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। তাই খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়াকে কেউ এরশাদকে কারাগারে রাখার পরিণতি ভাববেন না।
এক্ষুণি হয়তো খালেদা জিয়াকে পুরো ৫ বছর কারাভোগ করতে হবে না। তার সামনে সুযোগ আছে আপিল করার। হয়তো রোববার বা সোমবার আপিল করে জামিনও পেয়ে যাবেন তিনি। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার মত পরিপাটি জীবনযাপন করা অভিজাত নারীকে নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারে ৫ দিন থাকতে হলেও তা তার জন্য অনেক বড় সাজা। সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সাথে বিয়ের পর থেকে খালেদা জিয়া কোনো বিঘ্ন ছাড়াই অভিজাত ও আয়েশী জীবনযাপন করে আসছেন। সেনা কর্মকর্তা, উপ সেনাপ্রধান, সেনা প্রধান, রাষ্ট্রপতির স্ত্রী বেগম জিয়া নিজেও তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, ছিলেন বিরোধীদলীয় নেত্রী।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করায় অনেকদিন পর বেগম জিয়া প্রটোকল হারান। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী নন, বিরোধী দলীয় নেত্রী নন, এমনকি এমপিও নন। কিন্তু তবুও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সবসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভিআইপি- ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট পারসন। স্বামীর মৃত্যুর পর রাজনীতিতে নামা বেগম জিয়া এরশাদেরর বিরুদ্ধে আপসহীন আন্দোলন করলেও তার আভিজাত্যে, স্বাচ্ছন্দ্যে কোনো ঘাটতি হয়নি কখনো। মইনুল রোডের বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে উৎখাতের পর সারাদেশের মানুষ সেই বাড়ির ভেতরের আভিজাত্য আর বিলাসী আয়োজন দেখে চমকে গিয়েছিলেন।
সেই খালেদা জিয়াকে নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারে থাকতে হবে, এটা অকল্পনীয় ছিল। কল্পনাকে সত্যি করে এখন তিনি সেই কারাগারের দোতলায় থাকছেন। সরকার তার গুলশানের বাড়িকেই সাবজেল ঘোষণা করতে পারতো। ওয়ান-ইলাভেনের মত অন্তত সংসদ ভবন এলাকার কোনো ভবনকে সাবজেল ঘোষণা করে তাকে সেখানে রাখতে পারতো। সত্তরোর্ধ বয়সের একজন অসুস্থ সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে কারাগারে পাঠানোটা ঠিক শোভন মনে হয়নি।
সবকিছু আদালতের রায়ে হয়েছে, তবু কোথায় যেন একটা প্রতিহিংসার ঝাঝ। সরকার চাইলে খালেদা জিয়াকে নাজিমউদ্দিন রোডে না পাঠিয়েও রায় কার্যকর বরতে পারতো। রায়ে বিচারক বেগম খালেদা জিয়ার বয়স, সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছেন। তাই একই অপরাধে অন্যদের ১০ বছরের কারাদন্ড হলেও বেগম জিয়ার হয়েছে ৫ বছর। বিচারক তার এই সুবিবেচনায় বেগম জিয়া কোথায় থাকবেন, তাও ঠিক করে দিলে ভালো করতেন।
তবে শুরুর দিকে না হলেও শেষ দিকে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন বলেই মনে হয়। রায়ের তারিখ ঘোষণার পর থেকে তিনি দল ও জোটের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাকে খুব দৃঢ়প্রত্যয়ী মনে হয়েছে। আর কোনো উপায় না থাকলে মানুষ যেমন ডেসপারেট হয়ে যায়, অনেকটা তেমন। রায় শুনতে আদালতে যাওয়ার আগে পরিবারের সদস্যদেরও তিনি সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন। দলীয় নেকাকর্মীদের বলে গেছেন শান্ত থাকতে, হঠকারি কোনো কর্মসূচি না নিতে।
জিয়া অরফ্যানেজ ট্রাস্ট মামলায় একটা বিষয় প্রমাণিত, কেউই আইনের উর্ধ্বে নন। অপরাধ করলে তাকে সাজা পেতেই হয়। তবে এই মামলাটি অনেকটা পচা শামুকে পা কাটার মত। মাত্র ২ কোটি ১০ লাখ টাকা ভুল ব্যবহারের দায় মাথায় নিয়ে বেগম জিয়াকে কারাগারে যেতে হলো।ম! বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষমতার সময় সরকার ও হাওয়া ভবনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যত অভিযোগ শোনা গিয়েছিল, সে তুলনায় ২ কোটি ১০ লাখ টাকা তসরুফের মামলা পচা শামুকই বটে। তবে শুনানীর সময় বেগম জিয়ার আইনজীবীরা বারবার বলার চেষ্টা করেছেন, এ ঘটনায় বেগম জিয়ার কোনো সস্পৃক্ততা নেই।
তাদের যুক্তি শুনে মনে হয়েছে, তারেক রহমানসহ অন্যরা দোষী হোক, বেগম জিয়া সাজা না পেলেই হয়। তাদের যুক্তি ধোপে টেকেনি। রায়ের আগে থেকেই সরকারের মন্ত্রী আর জোটসঙ্গীরা, খালেদা জিয়াকে কারাগারে যেতেই হচ্ছে, বারবার এই কথা বলে মামলার মেরিট কিছুটা কমিয়ে দিয়েছেন। তাদের বক্তব্যের রেফারেন্সে বেগম জিয়াও বলেছেন, রায় বিচারক নয়, সরকার ঠিক করে দিয়েছে। কিন্তু ১০ বছর ধরে চলা মামলাটিকে একেবারে মেরিটলেস মনে হয়নি। আমি সোজা বাংলায় যেটা বুঝেছি, এতিমদের জন্য টাকা এসেছে। কিন্তু সেই টাকা এতিমদের জন্য ব্যয় হয়নি, এতিমখানা হয়নি।
এই রায় শুধু কয়েকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কারাদন্ড নয়। এর অনেক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া আছে। দুর্নীতির দায়ে ৫ বছর কারাদন্ড হওয়ায় বেগম জিয়া আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। আর বেগম জিয়া এবং তারেক রহমান অংশ নিতে না পারলে বিএনপি তাতে অংশ নেবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তবে বেগম জিয়ার নির্বাচনে অংশ না নেয়ার বিষয়টি এখনও ফয়সালা হয়ে যায়নি। বেগম জিয়া আপিল করার সুযোগ পাবেন। আপিলে যদি রায় স্থগিত করা হয়, তাহলে আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তার নির্বাচন করতে বাধা থাকবে না।
বেগম জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর পর বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা আইনগতভাবে না হলেও রাজনৈতিকভাবে কঠিন বলেই মনে হচ্ছে। তবে বেগম জিয়া না থাকলে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারবে কিনা, সংশয় আছে তা নিয়েও। সরকার নিশ্চয়ই এই সুযোগে বিএনপি ভাঙ্গার চেষ্টা করবে। আর ভাঙ্গা বিএনপির কোনো একটা অংশ হয়তো বেগম জিয়াকে ছাড়াই নির্বাচনে যেতে চাইবে।
বিএনপি বলছে, এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা। আমি এরসঙ্গে একমত নই। তবে এটাও ঠিক বেগম জিয়া রাজনীতি না করলে বা বিএনপি চেয়ারপারসন না হলে হয়তো এই মামলা পরিণতি পেতো না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হলেও এই রায়কে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহার করা হবে। অনেক লোক হাজার কোটি চুরি করে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুদকের আরো অনেক মামলা ডিপফ্রিজে পরে অাছে।
কিন্তু ২ কোটি ১০ লাখ টাকা তসরুফের মামলায় বেগম জিয়াকে কারাগারে যেতে হয়। তবে অন্যায় সবসময়ই অন্যায়। এক টাকা চুরি করলেও অন্যায়, ১০ কোটি টাকা তসরুফ করলেও অন্যায়। রাজনীতিবিদ করলেও দুর্নীতি, ব্যবসায়ীরা কররলেও তা দুর্নীতিই। বেগম জিয়ার রায় থেকে সবারই এটা শিক্ষা নেয়া উচিত- কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়। আর অন্যায় করে, দুর্নীতি করে কখনো পার পাওয়া যায় না।
প্রভাষ আমিন : সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তা প্রধান : এটিএন নিউজ।
probhash2000@gmail.com
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.