কক্সবাজারে চারদিনে ৫ লাশ

কক্সবাজার আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি

মোঃ নেজাম উদ্দিন,
কক্সবাজারে এই মাসের ১ থেকে ৪ তারিখের মধ্যে ৫ জনের লাশ পেয়েছে পুলিশ। তার মধ্যে দুইজন শিশু একজন কিশোর ও আর দুইজন যুবক। দুই যুবককে সরাসরি হত্যা করা হলেও বাকি তিন জনের হত্যা না অপমৃত্যু সন্দেহ থেকে যায়। মাসের শুরুতেই দুটি সরাসরি হত্যা হলেও আরো ৩টি লাশ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। সোমবার (৪ জুলাই) দিবাগত রাত ১টার দিকে সৈকতের ডায়াবেটিক ও নাজিরারটেক পয়েন্টে জোয়ারের পানিতে ভেসে আসলে তাদের মরদেহ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। মৃত শিশুরা হলো কক্সবাজার শহরের কুতুবদিয়াপাড়ার বাসিন্দা মুফিজ আলমের ছেলে মো. জায়েদ (৫) এবং মোহাম্মদ আলীর ছেলে রিয়াদ (৬)। কক্সবাজার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘সোমবার বিকাল ৩টার দিকে জোয়ার আসে। রাত ১২টার পরে দুই স্থান থেকে দুজনের লাশ পাওয়া যায়।’ তিনি জানান, দুই শিশুকে উদ্ধার করে দ্রæত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তবে হত্যা না অপমৃত্যু তা এখনো জানা যায়নি। অপরদিকে একইদিন বিকালে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে গোসল করতে নেমে তানভীরুল হক তামিম নামের স্কুল ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় মাহিম নামের আরেক ছাত্রকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।নিহত তামিম টেকনাফের হ্নীলা মহেশখালিয়া পাড়ার বাসিন্দা সৌদি প্রবাসী মো. নুরুল হকের ছেলে এবং কক্সবাজার বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া একাডেমির নবম শ্রেণীর ছাত্র। বর্তমানে তাদের বাড়ি কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনাল সংলগ্ন দক্ষিণ লার পাড়ায়। সোমবার (৪ জুলাই) বিকাল ৪টার দিকে সমুদ্রের লাবণি পয়েন্টে দুই বন্ধু গোসল করতে নামে। সেখানে নিখোঁজ হয় তামিম। ঘণ্টাখানেক পরে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে লাইফ গার্ডের সদস্য ও বীচ কর্মীরা।
হঠ্যাৎ এমন কক্সবাজারের আইন শৃংখলার চরম অবনতি হওয়াতে স্থানীয়রা শংকিত। এই মাসের গত তিনদিনে কক্সবাজার সদরে দুই খুন হয়েছে। একজন ভারুয়াখালীর আজিজুল হক, আরেকজন খুরুস্কুল এর ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল উদ্দিন। মাদক অস্ত্র উদ্ধার ও হত্যার মতো কাজ চলছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে। এ নিয়ে পুরো জেলা এখন আতঙ্কে দিন যাপন করছে । অপরদিকে হঠাৎ করে তৎপরতা বেড়ে গেছে মাদক ব্যবসায়ীদেরও দৌরাত্ব। সীমান্ত এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীরা আবারও গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ফলে নানা কৌশলে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে ঢুকছে ইয়াবা ও আইসের মতো মাদকের বড় বড় চালান। বিজিবি,র‌্যাব ও পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানে মাদকের ‘ক্যারিয়ার’রা ধরা পড়লেও মূলহোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এছাড়া জেলার ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার,খুন, গোলাগুলি এবং অপহরণসহ নানা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেই চলেছে।অন্যদিকে র‌্যাব-১৫ গত মাসে টেকনাফের জাদিমুরা থেকে ডাকাত সর্দার সৈয়দ হোসেন প্রকাশ পুতিয়াকে একটি বিদেশী পিস্তল, ২রাউন্ড গুলি ম্যাগজিনসহকারে আটক করে। গত রবিবার (৩ জুলাই) সাড়ে ৬টার পর কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল ইউনিয়নের ডেইলপাড়া এলাকায় খুরুশকুল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্মেলন থেকে ফেরার পথে ফয়সাল উদ্দিন (২৫) নামে এক ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ফয়সাল খুরুশকুলের দক্ষিণ ডেইলপাড়ার মৃত লাল মোহাম্মদের ছেলে। তিনি সদর উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাকে হত্যার প্রতিবাদে কক্সবাজার জেলা শহরে ৩জুলাই রাতে তাৎক্ষনিক ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে।
জেলা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক মারুফ আদনান জানান, প্রশাসনের অনুরোধে আমরা ২৪ঘন্টা বিক্ষোভ বন্ধ রেখেছি। যদি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এর মধ্যে দোষীদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় তবে আমার কোন দলীয় বিক্ষোভ করবো না । যদি তারা ব্যর্থ হয় তবে কঠিন আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, রবিবার ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন ছিল। ডেইলপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হল রুমে নির্ধারিত সময়ে সম্মেলন শেষ হয়। সম্মেলনস্থলে ফয়সালের ওপর হামলার চেষ্টা চালানো হয়। সম্মেলন শেষে বাড়ি ফেরার পথে নুরুল হুদার বাড়ির সামনে অটোরিকশা থেকে নামিয়ে তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় গুলিবর্ষণও করা হয় বলে জানা যায়।তবে স্বজনদের অভিযোগ, পুলিশের সামনেই ফয়সালকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশের কোন ভুমিকা ছিল না ।
এর দুদিন আগে গত ১ই জুলাই কক্সবাজার সদরের ভারুয়াখালীর ৯ নং ওয়ার্ডের উল্টাখালীতে আজিজুল হক নামের যুবককে কুপিয়ে গলা কেটে হত্যা করে। জানা যায়, গত ১জুলাই কক্সবাজার সদরের কক্সবাজার সদরের ভারুয়াখালীর ৯ নং ওয়ার্ডের উল্টাখালীতে আজিজুল হক নামের যুবককেও কুপিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। শুক্রবার (১ জুলাই) দিবাগত রাত সোয়া একটার দিকে বাড়ির পাশে লাশ দেখতে পায় স্থানীয়রা। খবর পেয়ে লাশটি উদ্ধার করে হাসপাতাল মর্গে পাঠায় পুলিশ। নিহত আজিজুল হক ওই এলাকার আব্দুর রহিমের ছেলে। ঘটনার রহস্য এখনো বের করতে পারেনি পুলিশ ।গত ৩জুলাই কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্মেলন থেকে ফেরার পথে ফয়সাল উদ্দিন (২৫) নামে এক ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা জেলাবাসিকে ভাবিয়ে তুলেছে। পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সমাজের সচেতন মহল । স্থানীয়রা বলছে সপ্তাহের মাথায় কক্সবাজার সদরে দুই খুন এতে আমরা নিজেদের চরম অসহায় মনে করছি ।
কক্সবাজার সিভিল সোস্ইাটির ফোরাম এর সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন জানান, শুক্রবার (১ জুলাই) রাত ৮টার দিকে কক্সবাজারের টেকনাফে নাফনদীর টেকনাফের উনচিপ্রাং আন নূরের ঘের এলাকায় অভিযান চালিয়ে এক কেজি ৬০ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ (আইস) ও ৫০ হাজার পিস ইয়াবাসহ মো. ফারুক (৩০) টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ৩নম্বর ওয়ার্ড উনচিপ্রাংয়ের নুর আহমেদের ছেলেকে আটক করেছে বিজিবি। ঠিক ঐদিন ভারুয়াখালীতে হত্যা করা হয় আজিুল হক নামের যুবককে। একদিকে মাদক ও অন্যদিকে হত্যা এ যেন অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে কক্সবাজারে। আবার গতকাল ৩জুলাই রাতে ছাত্রলীগ হত্যা! আমরা শংকিত ।
একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, গত এপ্রিল মাসে আরো অবস্থা চরম আকার ধারণ করেছিল আইন শৃংখলা পরিস্থিতি গত এপ্রিল মাসে জেলায় ৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৩ এপ্রিল বুধবার দুপুরে উখিয়া উপজেলায় কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাওনা টাকা চাওয়াকে কেন্দ্র করে ছুরিকাঘাতে জাহিদুল ইসলাম (২৩) নামে রোহিঙ্গা তরুণ নিহত হয়েছেন। একই দিন কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুলে জমিজমার বিরোধের জের ধরে ভাতিজার দায়ের কোপে চাচার দুই হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বুধবার ইফতারের পর খুরুশকুলের হাটখোলা পাড়ায় এঘটনা ঘটেছে। গত ১২ এপ্রিল মঙ্গলবার জেলা শহরের বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় সংবদ্ধ ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন ব্যবসায়ী আবুল কালাম (৪৫)। ১১ এপ্রিল ভোরে মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়ার পথে নবগঠিত ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামাবাদের খোদাইবাড়ি এলাকায় ছুরিকাঘাতে নিহত হন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তারেকুল ইসলাম। ২ দিন নিখোঁজ থাকার পর ১১ এপ্রিল সকালে কক্সবাজার সদরের চৌফলদল্ডী সেতু এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় মোহাম্মদ সায়েম (২২) নামে এক যুবকের মরদেহ। ৮ এপ্রিল সকালে চকরিয়া উপজেলার হারবাংয়ে সংঘবদ্ধ জুয়াড়িরা পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয় যুবক মোহাম্মদ ইউনুসকে। সে রাতেই জেলা শহরের ঝাউতলা গাড়ির মাঠ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম রিগ্যান।৭ এপ্রিল বিকেলে পিএমখালী ইউনিয়নের চেরাংঘর বাজারে ইফতারের আগে প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় প্রবাস ফেরত কৃষি উদ্যোক্তা মোরশেদ আলীকে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা এ হত্যাকান্ডে অংশ নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ৪ এপ্রিল ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় কক্সবাজার সদরের পিএমখালী গ্রামের যুবক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরকে (২৮)। নিখোঁজের ৩ দিন পর গত ৬ এপ্রিল চকরিয়ার মাতামুহুরি নদী থেকে উদ্ধার করা হয় ইজিবাইক চালক সুমন কর্মকারের (২৬) মরদেহ। গত ২৮ মার্চ সন্ধ্যায় জেলা শহরের সিটি কলেজ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে নিহত হন চট্টগ্রাম হাজী মুহসিন কলেজের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রিদুয়ান (১৯)। ৩০ মার্চ ঈদগাঁয়ের একটি ইটভাটা থেকে উদ্ধার করা হয় সোহেল নামে ৭ বছরের এক শিশুর মরদেহ। এদিকে গত ৭ এপ্রিল উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী পূর্ব ফারিরবিল গ্রামে মাদক চোরাকারবারিদের উস্কানিতে গ্রামের অর্ধশত নারী সংঘবদ্ধ হয়ে হামলা চালায় বিজিবি সদস্যদের উপর। এতে ৩ বিজিবি সদস্য মারাত্মকভাবে আহত হন। বিজিবির কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় ৮০ হাজার ইয়াবাসহ আটক এক মাদক কারবারিকে। ৮এপ্রিল টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার এলাকায় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ২ গ্রামের বাসিন্দারা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে ২ পুলিশ সদস্যসহ ২০ জন আহত হয়। এ ঘটনায় উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় টেকনাফ মডেল থানায়। এসব ঘটনা ছাড়াও পুরো জেলায় জমি দখল, চিংড়ি ঘের দখল, ছিনতাই, মারামারি, চাঁদাবাজির মতো অপরাধ নিয়মিত সংঘটিত হচ্ছে।
কক্সবাজার সার্বিক আইন শৃঙ্খলা বিষয় নিয়ে কথা বলতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ( প্রশাসন) রফিকুল ইসলামের সাথে টেলিফোনে কথা হলে তিনি জানান,৩ জুলাই ফয়সার হত্যাকান্ডের ঘটনার দিন তাৎক্ষনিকভাবে সন্দেহজনক ৬জনকে আটক করা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে ফয়সাল হত্যাকান্ডের ক্লু বের করতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। তবে এখনো পর্যন্ত ফয়সালের পরিবার কোন অভিযোগ করেনি (রির্পোট লেখা পর্যন্ত)। যদি অভিযোগ করে তার উপর ভিত্তি করে আমাদের কার্যক্রম আরো বাড়ানো হবে।

 

 

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.