এরশাদের মাথা সত্যি খারাপ হয়ে গেছে

এরশাদের মাথা সত্যি খারাপ হয়ে গেছে জাতির কাঁধে চেপে বসা এই জগদ্দল স্বৈরাচারকে সরাতে ৯ বছর লেগেছে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থানের মুখে এরশাদের পতনের পর আমরা কেউ ভাবিনি, আমার ধারণা এমনকি এরশাদ নিজেও ভাবেননি, তিনি আবার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হতে পারবেন। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দুর্বলতা আর বিভক্তির ফাঁকে এরশাদ আজ আবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সে স্বপ্নের ঘোষণাও দেন।

২৪ মার্চ দিনটিতে এরশাদের লজ্জায় ঘর থেকে বেরোনোর কথা নয়। শুধু যে জনগণ তাকে ঘাড় ধরে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছে, তাই নয়। আদালতও তার ক্ষমতা গ্রহণকে অবৈধ বলে রায় দিয়েছে।

২৪ মার্চ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কালো দিন। ১৯৮২ সালের এই দিনে তখনকার সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ বন্দুকের মুখে নির্ব্যাচিতক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমততা দখল করেন। জাতির কাঁধে চেপে বসা এই জগদ্দল স্বৈরাচারকে সরাতে ৯ বছর লেগেছে।

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থানের মুখে এরশাদের পতনের পর আমরা কেউ ভাবিনি, আমার ধারণা এমনকি এরশাদ নিজেও ভাবেননি, তিনি আবার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হতে পারবেন। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দুর্বলতা আর বিভক্তির ফাঁকে এরশাদ আজ আবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সে স্বপ্নের ঘোষণাও দেন।

২৪ মার্চ দিনটিতে এরশাদের লজ্জায় ঘর থেকে বেরোনোর কথা নয়। শুধু যে জনগণ তাকে ঘাড় ধরে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছে, তাই নয়। আদালতও তার ক্ষমতা গ্রহণকে অবৈধ বলে রায় দিয়েছে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে আজ এক তামাশা চলছে। পতিত স্বৈরাচার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করে তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার দিবস উদযাপন করে। আর জনপ্রিয় দল বিএনপি তাদের চেয়ারপারসনকে কারাগারে নেয়ার প্রতিবাদে বারবার অনুমতি চেয়েও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি পায়নি।

বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি- দুটি দলের জন্মই ক্যান্টনমেন্টে,বিকাশও একই স্টাইলে। কিন্তু এরশাদের বিরুদ্ধে ৯ বছর রাজপথে আন্দোলন করে বিএনপি নিজেদের অনেক দুর্নাম ঘুচিয়ে গণতান্ত্রিক ধারায় শামিল হয়। কিন্তু বাংলাদেশে আজ বিএনপির চেয়ে জাতীয় পার্টি বেশি গণতন্ত্রী।

এরশাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃৃত্বে ৮ দলীয় জোট এবং বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট যুগপৎ আন্দোলন করেছিল। কিন্তু এরশাদের পুনর্বাসনও সম্পন্ন হয়েছে এই দুই দলের সৌজন্যেই। পতনের পর কারাগাওে যেতে হয়েছিল এরশাদকে। ৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সাথে জোট বেধে মুক্তি মেলে। আবার কিছুৃদিনের মধ্যেই বিএনপির সাথে চারদলীয় জোট কওে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন।

একবার আওয়ামী লীগ, একবার বিএনপি, একবার আওয়ামী লীগ, একবার বিএনপি- এভাবেই পেন্ডুলামের মত দুলছে আদর্শহীন জাতীয় পার্টি। যাকে কেউ কেউ যাত্রা পার্টিও বলে। রাজনীতিতে যাদের উপস্থিতিই দারুণ এক বিনোদন। কেউ কেউ বলছেন জাতীয় পার্টি জাতীয় সংসদেও নির্বাচিত বিরোধী দল। আর বিএনপি কোথাও নেই।

জাতীয় পার্টি কেমন বিরোধী দল, সেটা নিশ্চয়ই আপনারা জানেন। কয়েকদিন আগে বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশান এরশাদ জাতীয় পার্টিকে বাঁচাতে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেভাবে কান্নকাটি করেছেন, তা লোক হাসিয়েছে। রওশান এরশাদ ৯ বছর বাংলাদেশের দাপুটে ফার্স্ট লেডি ছিলেন। স্বৈরশাসক এরশাদের বৈধ স্ত্রী হিসেবে পদাধিকারবলে তিনি বাংলাদেশের ফার্স্ট লেডি হয়েছিলেন।

অবশ্য রওশন আদৌ এরশাদের ‘ফার্স্ট লেডি’ ছিলেন কিনা বা এরশাদের জীবনে আগে পরে আরো কত ‘লেডি’ এসেছে; তা নিয়ে বিশাল গবেষণা হতে পারে। এমনিতে রাষ্ট্রপতির স্ত্রীই পদাধিকারবলে ফার্স্ট লেডি। তবে রওশন এরশাদের আগে-পরে তারচেয়ে দাপুটে, তারচেয়ে সক্রিয় বা পরিচিত কোনো ফার্স্ট লেডি ছিলেন না। বাংলাদেশে আসলে ফার্স্ট লেডি বলতে মানুষ একজনকেই চেনে।

এখন বুঝছি, রওশন যাতে তার অপকর্মে ঝামেলা না করেন; সে কারণে তাকে কিছুটা ক্ষমতা দিয়ে, কিছুটা ব্যস্ত রাখতেই এরশাদের এই অপকৌশল। শাহবাগে পথকলি ট্রাস্টের নামে একটি অফিস ছিল, যেখানে ফার্স্ট লেডি অফিস করতেন। তখন রওশনকে মা ডেকে, তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে অনেকে মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন; এমন কথাও শোনা যায়।

এরশাদের পতনের পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে পতন ঘটে ফার্স্ট লেডিরও। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে হটিয়ে রাষ্ট্রের ওপর চেপে বসায় এরশাদ ছিলেন ঘৃণিত। ফার্স্ট লেডি হিসেবে রওশন এরশাদও স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই ঘৃণার ভাগ পেতেন। কিন্তু পরে যখন রওশান এরশাদকে কাছ থেকে দেখি, আমি চমকে যাই। গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৯০এর ডিসেম্বরে পতনের পর গ্রেপ্তার হন এরশাদ। মুক্তি পান ১৯৯৭ সালে।

মুক্তির পর এরশাদ প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন জাতীয় সংসদের লবিতে। ভোরের কাগজের রিপোর্টার হিসেবে আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আমার খালি হাত নিশপিশ করছিল। যার বিরুদ্ধে আন্দোলনে ব্যয় করেছি যৌবনের অনেকটা সময়। তাকে হাত ছোঁয়া দূরত্বে পেয়েও পেশাগত কারণে সংযত থাকতে হয়েছিল। তখন দেখেছি এরশাদের পাশে দাড়িয়ে পত্রিকা দিয়ে তাকে বাতাস করছিলেন রওশন।

দেখে আমার মনে হয়েছে একদম আটপৌড়ে বাঙালি নারী। এত বছর স্বামী ফিরে এসেছে, থাকলে তিনি তাকে তাল পাতার পাখা দিয়েই বাতাস করতেন, আচলে মুছিয়ে দিতেন ঘাম। এরশাদের মত এমন একটা ধূর্ত, চরিত্রহীন, লম্পট, খুনী, নিষ্ঠুর মানুষের স্ত্রী কিনা এমন সাধাসিধা, সহজ সরল। বিস্ময়কর! প্রথম দেখার সেই বিস্ময় আমার কাটেনি।

যত দেখেছি, যত তার কথা শুনেছি; তার সারল্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। তার কথা বলার ধরণও সহজ সরল। কিন্তু যতই সহজ সরল হন না কেন, কপালের ফেরে তিনি এখন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী। কাগজে-কলমে রাষ্ট্রের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বাস্তবে তিনি কোথাও নেই। তাকে কেউ পাত্তাই দেয় না। বিদেশী অতিথিরা এলে কেউ বিরোধী দলীয় নেতার সাথে সাক্ষাতের প্রটোকল মানেন না।

রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তার কোনো পাত্তা নেই, সংসদে কেউ গোণায় ধরে না। সংসারে তার অবস্থান আদৌ আছে কিনা, কেউ জানে না। দলে তার পদ সিনিয়র কো-চেয়ারপারসন, কিন্তু কেউ তার কথা শোনে বলে মনে হয় না।

ফার্স্ট লেডি হিসেবে তার যে লোক দেখানো দাপট ছিল, এখন কাগজে-কলমে তারচেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাস্তবে তার ছিটেফোটাও নেই। একসময় দাপুটে ছিলেন, আসলে সহজ-সরল গৃহবধূ। কিন্তু এতটা অসহায় তাকে কখনো লাগেনি।

গত ২৭ ফেব্রয়ারি জাতীয় সংসদে তিনি যেভাবে জাতীয় পার্টিকে বাঁচানোর আকুতি জানাচ্ছিলেন; তা লজ্জার, গ্লানির। বিশের কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সংসদ নেতার কাছে বিরোধী দলীয় নেতা এই ভাষায় আকুতি জানান না। জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই। সেদিন রওশন এরশাদ তাতে শেষ পেরেক ঠুকলেন।

জাতীয় পার্টি সরকারি দল না বিরোধী দল, এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল শুরু থেকেই। রওশান সংসদে দাড়িয়ে সেই বিভ্রান্তি ঘুচিয়ে দিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমন হিজড়া বিরোধী দলের কোনো নজির নেই। আজ রওশন এরশাদ বাঁচার জন্য কান্নাকাটি করছেন। কিন্তু লাভ কি। এই মৃত্যু ফাঁদে তো স্বেচ্ছায় পা দিয়েছেন তিনি। জেনেশুনেই বিষ পান করেছেন।

জাতীয় পার্টিতে অনেকদিন ধরেই দুটি ধারা। রওশন নেতৃত্ব দেন সরকারপন্থি অংশের। আর এরশাদ নেতৃত্ব দেন বিদ্রোহীদের। অবশ্য মাঝে মাঝেই এই দুই ধারা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এরশাদ বেশি গাইগুই করলে কোনো একটা মামলার তারিখ পড়লেই আবার পোষ মেনে যান। এরশাদ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যেতে চাননি।

এমনকি জোর করলে আত্মহত্যারও হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এরশাদকে সিএমএইচে আটকে রেখে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে নেয়া হয়। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেও নির্বাচিত হওয়া ঠেকাতে পারেননি এরশাদ। জাতীয় পার্টির সেই নির্বাচনী ধারার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রওশন। পুরস্কারও পেয়েছেন হাতে হাতে, বিরোধী দলের নেতা হয়েছেন।

তখন হয়তো বুঝতে পারেননি এই মণিহার গলার মালা নয়, ফাঁস। সিএমএইচ থেকে এরশাদ সরাসরি বঙ্গভবনে এসেছিলেন। বেরিয়েছেন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়ে। যতই ফোসফাস করুন, এরশাদ কিন্তু এখনও সেই মর্যাদার লোভ ছাড়তে পারেননি। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির তিন সাংসদ ঠাঁই পান মন্ত্রিসভায়।

সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে রচিত হয় এক নতুন ইতিহাস। বিভিন্ন সময়ে এরশাদ এবং রওশন মন্ত্রীদের পদত্যাগ করতে বলেছেন। কিন্তু তারা কারো কথা শোনেননি। সেদিন যখন রওশন তার দলের মন্ত্রীদের উইথড্র করে নিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে করুণ আবেদন জানাচ্ছিলেন, তখন তার পাশে বসে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙা হাসছিলেন, বিদ্রুপের হাসি।

একবার ভাবুন, রওশন কতটা অসহায়। তার দলের মন্ত্রীরা তার কথা শোনে না। পদত্যাগ করে না। তিনি সেই বিচার দেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

সংসদে রওশনের কান্নকাটির দুদিন পর এরশাদ বলেছিলেন, তার এবং তার দলের তিন মন্ত্রীর পদত্যাগ সময়ের ব্যাপারমাত্র। তারপর প্রায় মাস গড়াচ্ছে। সেই সময় আর আসেনি। বরং সেই ঘোষণা ভুলে এরশাদ এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাড়িয়ে গল উচিয়ে বড় বড় কথা বলেন।

অসহায় রওশন এরশাদ সংসদে বলেছেন, তারা দেশে-বিদেশে নিজেদের পরিচয় দিতে পারেন না। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা লাগে। কারণ, সবাই জানতে চায়, জাতীয় পার্টি সরকারি দল, না বিরোধী দল। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বিরোধীদলীয় নেতা প্রশ্ন রাখেন, ‘আমরা সরকারি দল, না রোধী দল, কোনটা আমরা?’ এরচেয়ে হাস্যকর প্রশ্ন আপনারা কখনো শুনেছেন?

হতাশ রওশন এরশাদ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছেন, ‘টানাটানি করে বিরোধী দল হওয়া যায় না। তারা হয় বিরোধী দল হবেন, না হলে সরকারে থাকবেন।’ আর কোনো উপায় না পেয়ে তার অসহায় আত্মসমর্পণ, ‘না হয় আমাদের ৪০ জনকে সরকারে নিয়ে নেন। বিরোধী দল দরকার নেই।’ রওশনের এই আবেদন প্রধানমন্ত্রী রাখবেন কিনা, সেটা আসলে নির্ভর করে আগামী নির্বাচনে বিএনপি আসবে কিনা তার ওপর।

বিএনপি নির্বাচনে এলে জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের সাথেই থাকতে হবে। নইলে জাতীয় পার্টিকে হয়তো আবার এখনকার মত বিরোধী দলের আসনে বসতে হবে। সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রীর অসহায়ত্ব আসলে জাতীয় পার্টির সঙ্কট নয়, সঙ্কট সংসদীয় গণতন্ত্রের।

এরশাদের বয়স এখন প্রায় নব্বই। অনেকদিন ধরেই তিনি উল্টাপাল্টা কথা বলে রাজনীতির ভাড় হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সিএমএইচ থেকে সরাসরি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন শপথ অনুষ্ঠানে।

এর আগে আত্মহত্যার হুমকিসহ নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে এতকিছু বলেছিলেন, এরশাদ বঙ্গভবনে ঢোকার সাথে সাথে সবাই হেসে উঠেছিল, স্বতস্ফুর্ত বিদ্রুপের হাসি। ২৪ মার্চেও সমাবেশে এরশাদ বলেছেন, বয়স হলেও তার মাথা খারাপ হয়নি। তিনি আবার ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছেন। শুনে বুঝলাম এরশাদের মাথা সত্যি খারাপ হয়ে গেছে।

প্রভাষ আমিন: সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তা প্রধান : এটিএন নিউজ।

সুত্রঃ পরির্বতন।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.