একজন শিক্ষকের গল্প

আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এই দিবসে রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তার নিজস্ব ফেসবুক ওয়ালে একটি লেখা পোস্ট করেন। তা হুবহু পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

 

আজকে ৫ অক্টোবর ,বিশ্ব শিক্ষক দিবস..এদিনে পৃথিবীর সকল শিক্ষকের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ সালাম এবং কৃতজ্ঞতা।এই দিবস নিয়ে ভাবনার পুরোটা জুড়ে আছে আমার আব্বু,আমার প্রথম শিক্ষক।আব্বু উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে আসা একজন মানুষ,বাস্তবতার সাথে তাঁর যোগাযোগ নিতান্তই বাস্তবতার বিপরীত!

একজন শিক্ষকের গল্প 💛💛💛

আমার আব্বু মুস্তফা সলিমুল্লাহ্..চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৩-৭৪ ব্যাচের অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে বিএ (সম্মান) এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। পেশাগত জীবনে তিনি চট্টগ্রামের ওমরগনি এমইএস কলেজে শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতা তার ধ্যান-জ্ঞান..সারাজীবনে কখনোই তাঁকে আমি কখনই সময়-সিলেবাস ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষাকে আবদ্ধ করতে দেখি নাই..সবসময়ই তিনি তাঁর সামনের শিক্ষার্থীদের( আমি আর আমার দুই বোনসহ) কাছে শিক্ষাকে উপস্থাপন করেছেন সীমানার সীমা ছাড়িয়ে উন্মুক্ত ভাবে..ক্লাস ৫/৮ না একাদশ দ্বাদশ এসব নিয়ে আব্বুর তেমন মাথা ব্যথা দেখতাম না..আগে খুবই বিরক্ত হতাম..এখন বুঝি এটাই শিক্ষক হিসেবে আব্বুর সার্থকতা… আমার শিক্ষক আব্বুকে আমি খুবই শৌখিন এবং আবেগপ্রবণ মানুষ হিসেবে দেখেছি,তবে লৌকিক বিষয়ে তাঁর আগ্রহ কম বলেই জানি। তাঁর সৌখিনতার একটা পরিচয় পাওয়া যায় আমাদের তিন বোনের নামকরণ দেখলে,স্বর্ণা,সেঁওতি,সাদ্ধী..
তাঁকে দেখে শিখেছি জীবনের প্রতিটা তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে কীভাবে শিক্ষা নিতে হয়।
তিন তিনটা কন্যা সন্তানের বাবা হিসেবে সবার কাছে কটুক্তি শুনলেও আমার আব্বু সকলের অলক্ষ্যে সচেতনভাবেই চেষ্টা করেছেন আমাদেরকে ছেলে-মেয়ে ইত্যাদি পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে মানুষ হিসেবে নতুন পরিচয় দেয়ার..আর সেই পরিচয় পরিবর্তনের বীজ তো বপন হয়েছিলো আমার আব্বু আম্মুর হাতেই।অথচ আব্বু কখনোই আমাদের কাছে কিছু আশা করেন নাই,কেবলি দিয়ে গিয়েছেন নিঃস্বার্থ ভাবে।
একজন আদ্যোপ্রান্ত ভালো মানুষের জীবনাচরণ লেখা আমার মতো “অলেখক” এর কাজ নয়, তাই লিখতে পারছি না..আব্বু রবীন্দ্র সংগীত শুনতে যেমন পছন্দ করেন,তেমনি আবার ছোট বেলা থেকে দেখেছি নামাজের জামাতে প্রথম কাতারেই আব্বুকে দাঁড়াতে। অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করে এসেছেন সর্বদাই।এ বয়স অব্দি নিয়মিত পড়াশুনা করেন।এখনো উনার কোন অবসর নাই, বৃথা বসে না থেকে আমার শিক্ষক আব্বু কিছু বাচ্চা পড়ান।আমি এই ভেবে অবাক হই ঐ বয়সে আমি কী পারবো এরকম গতিশীল থাকতে…
আর দশজন ভালো মানুষের মতোই আমার আব্বুও অত্যন্ত অভিমানী,যেকোন মানুষকে অতি অল্পেই বিশ্বাস করেন,এবং অধিকাংশ সময়েই পৃথিবীর রূঢ় বাস্তবতায় বিশ্বাস ভংগ হয়,এবং তিনি অত্যন্ত কষ্ট পান।তবে অবাক করার মতো ব্যপার হলো এরপরেও তিনি আবারো মানুষেই আস্থা রাখেন।
আব্বুর সাথে শৈশবে বাজার করতে যেতাম,তখন দেখেছি আব্বু মুখে মুখে ছড়া বানিয়ে আমাদের শুনাতেন।আবার আমি মেয়ে হবার পরেও আমাকে কোরবানীর গরুর হাটে নিয়ে যেতেন প্রতি বছরেই।এমন একটা বন্ধের দিন থাকতো না যেদিন আমরা সবাই মিলে বেড়াতে যেতাম না।অনেক রঙীন ছিলো আমাদের ছেলেবেলা যার প্রতি পরতে রঙ এর কারিগর ছিলেন আমার শিক্ষক আব্বু।

আব্বু ইদানীংকালের শিক্ষার মান নিয়ে প্রায়শই আক্ষেপ করেন।আমি ভাবি কী হবে এত ভেবে…!

আজকের বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এ পৃথিবীর সকল শিক্ষককে সালাম।মানুষ গড়ার মহান ব্রতে নিয়োজিত সকল শিক্ষকসহ আমার সকল শিক্ষকের প্রতি হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা অনিঃশেষ।

লেখকঃ ফাহমিদা মোস্তফা স্বর্ণা

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা

রামু উপজেলা, কক্সবাজার।

  1. তাজল বড়ুয়া বলেছেন

    এক কথায় অসাধারন!

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.