উপকূলে হাহাকার, দায় কার?

– জুনাইদ আল হাবিব

বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী ১৯টি জেলা নিয়ে উপকূল। ৫ কোটি মানুষের জনপদ ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা। ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণপানি, খাবার পানি সংকট এখানকার মানুষের নিত্যগল্প। উপকূলের এ মানুষগুলোকে বছরের প্রায়টা সময় সংগ্রাম করে বাঁচতে হয়। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে এখানকার মানুষের পাশে থাকে না কেউ।

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ইয়াস নয় শুধু, আম্পানসহ বিগত দিনের ঘূর্ণিঝড়গুলো বারবার উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের গুরুত্ব মনে করিয়ে দিয়ে গেছে। তবুও আজ পর্যন্ত উপকূলের বিশাল এ সংকটকে ঘিরে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় কার্যকরী কোন প্রদক্ষেপ নিতে পারেনি৷ কেবল ঘূর্ণিঝড় ঘূর্ণিঝড় আসলেই গণমাধ্যমের ক্যামেরার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের চোখ যায় উপকূলে। এত পানি, মানুষের কষ্ট দেখে কতো মাতামাতি চলে৷ দু’দিন পর ঘূর্ণিঝড় শেষে সবাই উপকূলের কথা ভুলে যায়৷

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

অথচ স্বাভাবিক সময়েও উপকূলে নদীভাঙন একটা অস্বাভাবিক চিত্র। বছরজুড়ে উপকূলে নদীভাঙনের শিকার হয়ে লাখ লাখ মানুষ ঠিকানা বদল করে৷ অসহায় মানবেতর জীবনযাপন করে, খোলা আকাশের নিচে। কিন্তু কারো টনক নড়ে না। নদীভাঙনের শিকার নিঃস্ব মানুষের ঠাঁই হয় বেড়িবাঁধের পাশে, অন্যের আশ্রয়ে।

গেল আম্পান উপকূলজুড়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ঘূর্ণিঝড়ের সে ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে পশ্চিম উপকূলের সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের মানুষ। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওখানকার বেড়িবাঁধ। লবণ পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। বছর খানেক পরেও লোকালয়ে বিশুদ্ধ পানির সংকটের খবর মিলেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে। বেশ কিছু দিন আগেও খবরের শিরোনামে দেখা গেছে, মানুষের হাহাকারের করুণ চিত্র। আম্পানের ক্ষয়-ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই উপকূলজুড়ে গেল আগষ্টে যে জলোচ্ছ্বাস হয়েছে, তাতে মানুষের জীবন মাটিতে মিশে যায়। পূর্ব উপকূলের লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, মধ্য উপকূলের ভোলা, বরিশাল, চাঁদপুরে আকষ্মিকভাবে ৭ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। এ জলোচ্ছ্বাসে প্রতিটি পরিবার পথে বসেছে৷ পুকুরের লাখ টাকা মাছ ভেসে গেছে বানের জলে, জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বসতভিটা, চলাচলের সড়ক ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ে। যেখানে ব্রিজ ছিল, ব্রিজের বদলে সাঁকো তৈরি করে মানুষ চলাচল হচ্ছে।

জলোচ্ছ্বাসের ৯মাস গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা নিয়ে কোন ধরণের উদ্যোগ চোখে পড়েনি। জলোচ্ছ্বাসের পর চলাচলের সড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙেছে, সেভাবেই পড়ে আছে।

নদীভাঙনে উপকূলে মানুষের হাহাকার যেন থামেনা কোন কালে। জিওব্যাগের নামে হরিলুট হয়। শুষ্ক মৌসুমে জিওব্যাগ না ফেলে জোয়ারের মুখে জিওব্যাগ ফেলা হয়। এতে জোয়ারের স্রোতে জিওব্যাগগুলো নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগরের ৩২কিলোমিটার এলাকা নদীভাঙনে ভাঙছে ৩৬বছর ধরে। চাঁদপুর, নোয়াখালী, হাতিয়া, শরিয়তপুর, বরিশাল, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন স্থানে নদীভাঙনের শিকার হয়ে মানুষ খোলা জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছে রীতিমত। নদীভাঙনের শিকার হলে একটি পরিবার পথে বসে যায়। আর্থিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। ধারদেনা বাড়ে, সংসারে অনটন সৃষ্টি হয়। এসব নিয়ে নীতিনির্ধারণী মহলে তেমন কোন জোরালো আলোচনা হয় না।

নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস, লবণ পানির আধিক্য, উপকূলের মানুষের জীবনে যেন এক মহা বিপর্যয় নিত্যদিনের। ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগে উপকূলবাসীর প্রাণবন্ধু হয় সুন্দরবন। অথচ এ সুন্দরবনের পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, আমাদেরই খামখেয়ালিতে৷ বর্ষা মৌসুমেও বৃষ্টি নেই। কেন, কারণ কী? কেউ কী বিবেচনায় নিয়েছে ব্যঙের ছাতার মতো ইটভাটাগুলো গড়ে উঠছে। অনাবৃষ্টির কারণে উপকূলে বিশুদ্ধ পানির একদা যেমন সংকট বেড়ে চলেছে, অন্যদিকে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানান পানিবাহিত রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এখানে ভুক্তভোগী মা ও শিশুরাও। ফলে আগামী প্রজন্মের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

এখন কথা হচ্ছে, সমাধানের পথ কী? উপকূল বাংলাদেশের প্রাণ। সুন্দরবন, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, চট্টগ্রাম বন্দর দেশেরই অন্যতম চালিকাশক্তি। এছাড়া ইলিশ সম্পদ, অন্যান্য মৎস্য আহরণ এ উপকূল থেকেই হয়ে যাকে। মোট কথা, সংকটের মাঝেও আমাদের বিশাল এক সম্ভাবনা রয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে উদ্যোগ নিয়ে উপকূলের উন্নয়ন সম্ভব নয়। দরকার সরকারের টেকসই প্রদক্ষেপ। উপকূল নিয়ে সরকারের বিশেষ পরিকল্পনা থাকতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। উপকূলের জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় হতে পারে। উপকূল মন্ত্রণালয় নামে। এতে সুবিধা হচ্ছে, সবসময় উপকূল নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে উপকূল নিয়ে মাথাব্যথা থাকবে। উপকূল এগিয়ে যাবে, যুক্ত হবে মূলধারায়।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.