‘ইকোসিস্টেমস পিলার’ এশিয়ান হাতি মহাবিপন্ন!

আহমদ গিয়াস:
কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বনাঞ্চলের ‘ইকোসিস্টেমস পিলার’ বা বাস্তুসংস্থানতন্ত্রের ‘খুঁটি’ বলা হয় বন্য হাতিকে। কিন্তু দিন দিন আবাসস্থল কমে যাওয়ার পাশাপাশি মানুষের হামলায় এখন মহাবিপন্ন আমাদের বৃহত্তম এই স্থলজ বন্য প্রাণীটি। বিজ্ঞানীদের আশংকা, আমাদের পরিবেশ থেকে এই ‘কী-স্টোন প্রজাতি’ (যেসব অঞ্চলে হাতির আবাস রয়েছে) হারিয়ে গেলে সেসাথে বিলুপ্ত হয়ে যাবে আরো বহু প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশে হাতির ৪টি প্রধান সেবা রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হল বীজ পরিবহনকারী হিসাবে। হাতির মলে উদ্ভিদ বীজ পরিপূর্ণ থাকে। তারা একস্থানে খাদ্য গ্রহণ ও অন্য স্থানে মল ত্যাগের মাধ্যমে একস্থানের বীজ অন্যস্থানে ছড়িয়ে দেয়। জরীপে দেখা গেছে যে, একটি বন্য হাতি এভাবে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরেও বীজ ছড়িয়ে দিতে পারে। আবার কিছু প্রজাতি তাদের বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য পুরোপুরি হাতির উপর নির্ভরশীল বলে জানান গবেষকরা।
রাজধানীর একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ও বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানী রাগিবউদ্দিন আহমদ বলেন,
বন্য হাতি গাছের লতাপাতা খাওয়ার সময় একটি গাছের সাথে অন্য গাছের ফাঁক তৈরি করে। এতে সেই ফাঁকগুলি নতুন গাছকে বাড়তে দেয় এবং অন্যান্য ছোট প্রাণীর ব্যবহারের জন্য পথ তৈরি করে। হাতিরা খাওয়ার সময় গাছের শাখাগুলো এমনভাবে নীচে নামিয়ে আনে, যাতে ছোট প্রাণীগুলির জন্য সেই গাছে ওঠার ও খাবার গ্রহণের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়।
তিনি বলেন, হাতির মল হ’ল উদ্ভিদ ও কিছু প্রাণীর জন্য পুষ্টি সমৃদ্ধ সঠিক সার। হাতির মল বীজ অঙ্কুরিত হতে ও বৃদ্ধি পেতে সহায়তা করে। মলের মাধ্যমে হাতির বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে উদ্ভিদের নতুন অঞ্চলে উপনিবেশের সুযোগ হয়, যা শেষ পর্যস্ত বিভিন্ন প্রাণীর জন্য নতুন আবাস এবং খাদ্য তৈরি করে। হাতিরা তৃণভ‚মিতে গাছের স্প্রাউট ও গুল্মগুলির জন্য খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে সমভূমি উন্মুক্ত রাখতে সহায়তা করে। এভাবে বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যকে বৃদ্ধি করে এই বাস্তুসংস্থানতন্ত্রে বসবাসকারী অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।
বিজ্ঞানী রাগিব বলেন, শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব মেটাতে হাতিরা বনাঞ্চলে গভীর কুপ খনন করে। হাতিরা তাদের পা, কান্ড ও টিস্ক ব্যবহারের মাধ্যমেই কুপ খনন করে থাকে। এভাবে জলাধার তৈরি করে খরা মৌসুমে শুধু হাতিরা টিকে থাকে না, অন্য প্রাণীদের টিকে থাকার জন্যও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। এছাড়া অরণ্যে গাছপালা পদদলিত করে ‘ক্লিয়ারিং’ তৈরি করে বন্য হাতিরা। এই ক্লিয়ারিংগুলির নীচের অংশের গাছগুলিকে আরও উন্নত করার সুযোগ দেয়, বনের তলায় আরও আলো পৌঁছায়। এভাবে বনে উদ্ভিদ প্রজাতির বাড়িয়ে তোলার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর জন্যও খাদ্যসংস্থান তৈরি করে হাতিরা। কিন্তু দিন দিন আবাসস্থল কমে যাওয়ার পাশাপাশি মানুষের হামলায় আমাদের বৃহত্তম এই স্থলজ প্রাণীটি এখন মহাবিপন্ন বলে মনে করেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীদের মতে. আমাদের বনাঞ্চল থেকে এই ‘কী-স্টোন’ প্রাণীটি হারিয়ে গেলে টিকে থাকতে পারবে না আরো ব্যাপক প্রাণ-উদ্ভিদ রাজ্য।
স্থানীয় পরিবেশবাদীদের মতে, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে প্রতিবছর মানুষের হাতে অপমৃত্যুর শিকার হচ্ছে অসংখ্য বন্য হাতি। কেবল পক্ষকালের ব্যবধানেই কক্সবাজার বনাঞ্চলে গুলী ও বিদ্যুৎ স্পৃষ্ঠ হয়ে ৩টি বন্য হাতির মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। একই কারণে আরো একাধিক হাতি মারা গেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বনাঞ্চলে।
কক্সবাজারের পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রণমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) কক্সবাজার এর প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন
দাবী করেন গত ২ বছরে কক্সবাজার ও আশেপাশের বনাঞচেলে অন্তত ১৫টি বন্য হাতিকে হত্যা করা হয়েছে । তিনি বলেন, ধানখেত রক্ষার জন্যই লোকজন বৈদ্যুতিক শক ও গুলি করে বন্য হাতি হত্যা করছে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের বনসংরক্ষক আবদুল আওয়াল সরকারও মনে করেন কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বনাঞ্চলের ‘ইকোসিস্টেমস পিলার’ বন্য হাতি এখন মহাবিপন্ন।
তিনি বলেন, কক্সবাজার থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম হয়ে সিলেটের মৌলভীবাজার ও জামালপুর পর্যন্ত অঞ্চলে বিস্তৃত রয়েছে আমাদের বন্যহাতির আবাসস্থল। কিন্তু সম্প্রতি বনাঞ্চল কমে যাওয়া এবং খাদ্য সংকটে পড়ে লোকালয়ে হানা দেয়ার কারণে মানুষের সাথে সংঘাতে মহাবিপন্ন হয়ে পড়েছে এই প্রাণীটি।
তিনি জানান, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজার্ভ ন্যাচারের মাধ্যমে সর্বশেষ জরীপে দেশে ২৬৮টি এশিয়ান হাতি পাওয়া গেছে। এই হাতিকে যেন হত্যা করা না হয় এবং হাতি সংরক্ষণে এগিয়ে আসে তার জন্য খুব শীঘ্রই সচেতনতা কার্যক্রম শুরু করা হবে। পাশাপাশি হাতি হত্যাকারীদের বিরুদ্ধেও কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, গত ৬ নভেম্বর চকরিয়ার খুটাখালী বনাঞ্চলে গুলী করে ৩ বছর বয়সী একটি হাতিকে হত্যা করা হয়। এরপর গত ১৫ নভেম্বর রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি বনাঞ্চলে বৈদ্যুতিক শকে ও গুলী করে হত্যা করা হয় একটি বয়স্ক হাতিকে। এর দুইদিন পর রামুর জোয়ারিয়ানালাতে একইভাবে আরো একটি বন্যহাতিকে হত্যা করা হয়েছে। এই তিনটি ঘটনায় থানায় মামলা হলেও এখনও কোন আসামী ধরা পড়েনি।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, শক্তিশালী আবেগ সক্ষম যেসব প্রাণীর সাথে মানুষ এ গ্রহতে ভাগাভাগি করে বাস করে, সেই প্রাণীদের মধ্যে হাতি অন্যতম বুদ্ধিমান। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত টিকে থাকা বৃহত্তম এই স্থলজ প্রাণীটি প্রবোসিডাই (Proboscidea) বর্গের এ্যালিফেন্টডাই (Elephantidae) পরিবারের একমাত্র সদস্য। আফ্রিকার সাব সাহারান অঞ্চল এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই কেবল বন্যহাতির দেখা মেলে। মাত্র ৩ প্রজাতির হাতিই এখন পৃথিবীতে টিকে আছে। তারমধ্যে আফ্রিকান হাতি আকারে এশিয়ান হাতির চেয়ে বড়। আফ্রিকান হাতি আবার দুই প্রকারের; আফ্রিকান বুশ এ্যালিফেন্ট ও আফ্রিকান ফরেস্ট এ্যালিফেন্ট। এশিয়ান এ্যালিফেন্ট আকারে ছোট হলেও পরিবেশে তার সেবাটি আফ্রিকান এ্যালিফেন্টের চেয়ে কোন অংশেই কম নয় বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আনসারুল করিম বলেন, দেশের দুর্গম পার্বত্য এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ-পরিবহণের গুরুত্বপূর্ণ বাহন হতে পারে হাতি। এছাড়া হাতি সংরক্ষণের মাধ্যমে পর্যটন থেকেও আয় হতে পারে। কিন্তু হাতি বিলুপ্ত হয়ে গেলে এ অঞ্চলের জলবায়ু, পরিবেশ ও প্রকৃতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.