আমদানি বন্ধ ও দেশীয় লবণ শিল্প বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চায় ব্যবসায়ীরা

ইমাম খাইরঃ
মাঠ ও মিল মিলে প্রায় ৬ লক্ষ মেট্রিক টন লবণ মজুদ। এক মাস পরেই লবণের নতুন মৌসুম শুরু হচ্ছে। পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও দেশীয় লবণের ঘাটতি দেখিয়ে আমদানির চক্রান্ত করছে অসাধু সিন্ডিকেট। তারা ইতোমধ্যে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছে। দেশীয় লবণ শিল্পকে বিদেশ নির্ভর করতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে অসাধু মিল মালিক সিন্ডিকেট। তারা সংখ্যায় কম হলেও অতি কৌশলে লবণের কৃত্রিম সংকট দেখাচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন মহলে ভুল তথ্য উত্থাপন করছে। অস্তিত্বহীন ৭ জন মিল মালিক লবণ শিল্প বিরোধী চক্রান্তের সাথে জড়িত।

বিসিকের তথ্য অনুসারে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৪ লক্ষ মেট্রিক টন মাঠে এবং প্রায় ২ লক্ষ মেট্রিক টন লবন মিলে লবণ মজুদ আছে। এরপরও সংকট দেখাচ্ছে আমদানিকারক সিন্ডিকেট।

শনিবার (৭ অক্টোবর) বিকালে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য দিয়েছেন কক্সবাজার লবণ চাষী ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক এডভোকেট এইচ.এম শহিদ উল্লাহ চৌধুরী।

তিনি বলেন, সম্প্রতি ভার্চুয়াল সভায় বিসিকের দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে দেশে লবণ ঘাটতি দেখিয়ে নতুন করে বিদেশী লবণ আমদানির চক্রান্ত করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে ষড়যন্ত্র বন্ধ করা না গেলে দেশীয় লবণ শিল্প আবারও ধ্বংসের মুখে পড়বে।

কক্সবাজার ও বাঁশখালীর কিছু অংশ নিয়ে প্রায় ৫৭ হাজার ২৭০ একর জমিতে অন্তত ৫৫ হাজার লবণ চাষী লবণ চাষের সাথে যুক্ত। এছাড়াও লবণের উপর বিভিন্ন ব্যবসা করে কক্সবাজারের আরও ৬০শতাংশ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। ফলে দেশীয় লবণ শিল্প ধ্বংস হয়ে গেলে বেকার হয়ে যাবে হাজার হাজার মানুষ, যাদের আর কোন পেশা নেই।

বিসিকের তথ্য অনুসারে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাঠে লবণ মজুদ আছে প্রায় ৪ লক্ষ মেট্রিক টন ও লবণ ইন্ডাস্ট্রিতে লবণ মজুদ আছে প্রায় ২ লক্ষ মেট্রিক টন। মোট লবণ মজুদ আছে প্রায় ৬ লক্ষ মেট্রিক টন। কিন্তু প্রতিমাসে চাহিদা প্রায় ২ লক্ষ মেট্রিক টন। সেই হিসাব অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত লবণ মজুদ আছে। আগামি একমাস পর অর্থাৎ নভেম্বরের শুরুর দিকে নতুন মৌসুমের লবণ উৎপাদন শুরু হবে। লবণ উৎপাদন শুরু হলে দেশে লবণের ঘাটতি হওয়ার কোন আশংকা নেই। অথচ এই মুহূর্তে গুটিকয়েক অসাধু মিল মালিক সিন্ডিকেট মিথ্যা তথ্য দিয়ে আবারও লবণ আমদানি করার চক্রান্ত শুরু করেছে।

লবণ চাষীদের তথ্য মতে, দেশে আবহাওয়া অনুকূল থাকায় চাহিদার চেয়েও বেশি পরিমাণে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। দেশে এই মুহূর্তে এবং আগামিতেও লবণের ঘাটতি হওয়ার কোন আশংকা নেই। বরং দেশে প্রচুর পরিমাণে লবণ উৎপাদন হওয়ায় চাষীরা আরও নতুন নতুন জমিতে লবণ চাষ করতে শুরু করেছেন। চাষীরা নিস্ফলা জমিকে চাষযোগ্য করে এ বছর আরও বেশি জমিতে লবণ উৎপাদনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

এমন মুহূর্তে যদি বিদেশি লবণ আমদানি করা হয়, তাহলে নতুন করে মাঠে নামতে উদ্যোগী হওয়া চাষীরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বে। চলতি বছর উৎপাদনে থাকা চাষীরাও হতাশ হয়ে মাঠ ছেড়ে দেবেন। তখন দেশকে বিদেশী লবণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে। এতে ধ্বংস হবে দেশীয় লবণ শিল্প।

সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজার লবণ চাষী ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ আবু তৈয়ব, মিজানুর রহমান চৌধুরী (খোকন মিয়া), সিরাজুল মোস্তফা, আলী হোছাইন, জামিল ইব্রাহিম, আজিজুল হক, মুহাম্মদ শোয়াইবুল ইসলাম সবুজসহ লবণ চাষী ও ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।

লবণ চাষীরা জানান, বর্তমানে দেশে লবণের কোন ঘাটতি নাই। আবার লবণের উচ্চমূল্যও নাই। বর্তমানে মিল পর্যায়ে দুই মণ লবণ ১,০০০ টাকা থেকে ১০৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা চাষীদের জন্য ন্যায্যমূল্যের চেয়েও কম। তারপরও অসাধু সিন্ডিকেটটি দেশীয় লবণ শিল্পকে ধ্বংস করতে বিদেশী লবণ আমদানির চক্রান্ত করছে।

এভাবে প্রতিবছর দেশীয় লবণ চাষীদের বারবার অসাধু সিন্ডিকেটের চক্রান্তের মুখে পড়তে হয়। দেশীয় লবণ শিল্পকে বাঁচাতে তাদের দৌঁড়ঝাপ করতে হয়।

এই চক্রগুলো দেশীয় লবণ শিল্পকে বাঁচাতে চায় না, তারা নিজেদের আখেরগোচাতে চায়। ফলে দেশে উদ্বৃত্ত থাকার পরও চাষীদের লবণ বিক্রি করতে না পেরে অভাব-অনটনে পড়তে হয়। অনেকেই এই চক্রান্তের শিকার হয়ে লবণ চাষ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। এভাবে সাধারণ মানুষকে এসব সিন্ডিকেট চক্রের কারণে উচ্চমূল্যে লবণ খেতে হয়।

জীবন-জীবিকার তাগিদে দেশীয় লবণ শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে লবণ নীতি অনুসরণের আকুল আবেদন জানিয়েছেন চাষীরা।

সেই সঙ্গে অসাধু সিন্ডিকেটের দেশবিরোধী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে ৫৫ হাজার চাষীকে রক্ষা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

পর্যাপ্ত মজুদ থাকতে কেন লবণ আমদানি করা হচ্ছে, জানতে চাইলে বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির বলেন, এ বছরের লবণ উৎপাদন এবং চাহিদের মধ্যে ঘাটতি রয়েছে এক লক্ষ পঞ্চান্ন হাজার মেট্রিক টন। সরকার ইতোমধ্যে এক লক্ষ মেট্রিক টন আমদানির অনুমতি দিতে যাচ্ছে। বাজার কন্ট্রোলের জন্য আর বৃষ্টি বাদলের কারণে এই বছর লবণ উৎপাদন কিছুটা পিছনে যাবে। কারণ, লবণ উৎপাদনের ইতিহাসে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তেমন লবণ উৎপাদন হয় না।

তিনি দাবি করেন, চাষীদের হাতে কোন লবণ নাই। মজুদদের হাতে কিছু লবণ আছে, যেগুলা তারা বিক্রি করছে না। যে কারণে বর্তমানে ১৩২০ টাকা পর্যন্ত মিলগেটে লবণ কিনতে হচ্ছে।

নুরুল কবির বলেন, গত বছর এই সময় লবণ মূল্য ছিল ৯৫০ থেকে ১০০০ পর্যন্ত। আজকে সেই বাজার ১৩২০ টাকা থেকে ১৩৫০ টাকা পর্যন্ত হয়েছে। সুতরাং এই দামের জন্যই সরকার এখন এক লক্ষ টন লবণ আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাও এক মাসের মধ্যে বাজারজাতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চাষীরা মাঠে নামার আগেই আমদানি লবণ বাজারজাত করতে পারবে বলে আশা করেন তিনি।

আমদানি না চাইলে চাষীদেরকে ১০০০ থেকে ১১০০ টাকার মধ্যে লবণের দাম  নিয়ন্ত্রণ ও নতুন লবণ উৎপাদন হওয়া পর্যন্ত সরবরাহের নিশ্চয়তা চান সভাপতি নুরুল কবির।

 

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.